চট্টগ্রাম শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

স্মরণ : আধ্যাত্মিক সাধক গুরু গোবিন্দ ঠাকুর

সমীরণ বড়–য়া

১৪ জানুয়ারি, ২০২০ | ৩:৪৩ পূর্বাহ্ণ

ঊনবিংশ শতকের মাঝে যে কয়জন ক্ষণজন্মা মহাসাধক পুরুষ এই বাংলার জমিনে সবুজ অরণ্যের বুকে আধ্যত্মিক ধ্যানসাধনায় নিমগ্ন থেকে অন্ধকার সমাজকে আলোকিত করেছেন, তাঁদের মধ্যে আধ্যাত্মিক সাধক ও সিদ্ধিপুরুষ গুরু গোবিন্দ ঠাকুর অন্যতম। তিনি ১৮৮২ খিস্টাব্দে বাংলা গ্রামীণ জনপদে আর্বির্ভূত হন। চট্টলার হাটহাজারী উপজেলার গুমানমর্দ্দন বৌদ্ধ জনপদে ছিল তার পৈত্রিক নিবাস।

তাঁর পিতা ফেজারাম বড়–য়া এ জনপদ থেকে ছুটে আসেন জোবরা গ্রামে। পিতা-মাতার তিনপুত্র ও দুই কন্যার মধ্যে তিনি ছিলেন দ্বিতীয় পুত্র। তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে জোবরা গ্রামে। মাত্র ১৫ বছর বয়সে ১৮৯৭ খ্রিস্টাব্দে তিনি শ্রামণ্য ধর্মে দীক্ষিত হন। তাঁর উপ-সম্পদা গুরু ছিলেন চাকমা ভিক্ষু রাম মনি মহাস্থবির। মাত্র ২১ বছর বয়সে ১৯০৩ খ্রিস্টাব্দে তাঁরই প্রিয় গুরু ভান্তের নিকট এই উপ-সম্পদা লাভ করেন। তিনি শ্মাশানিক ধুতাঙ্গ চর্চার মাধ্যমে লোকাত্তর মার্গ ধর্মের অমৃত স্বাদ পেয়েছিলেন।
সুদীর্ঘ ২৬ বছরের ভিক্ষু জীবন ধ্যান-সাধনায় কেটেছিল তাঁর। উল্লেখ্য যে, গোবিন্দ ভিক্ষু আটাশ বছর বয়োপূর্তিতে স্বর্ণালী যৌবনের সকল বীর্য শক্তি, পঞ্চ নিবারণ শক্তিকে কাজে লাগিয়ে ধ্যান অনুশীলনে স্বীয় আধ্যাত্মিক অনুভূতির উন্নতি সাধনে খুবই বিভোর ছিলেন।
পর্যায়ক্রমে তিনি অলৌকিক শক্তি অর্জন, শ্রোতাপত্তি, সকৃদাগামী ও অনাগামী মার্গ ফলে অধিষ্ঠিত হন।
তিনি অহোরাত্র ধ্যান আসনে শ্মশান ভূমিতে পূর্বের মত সময় না কাটিয়ে স্মৃতির সাধনায় নিজস্ব ধ্যানপদ্ধতি উদ্ভাবন করেন। ডান হাতের মধ্যমা উপরে রেখে তর্জনী নিচে থেকে ঘর্ষণের প্রক্রিয়ায় যে ‘তুড়ি’ উৎপন্ন হতো তার সাথে তিনি যোগ করতেন ‘হুমমারেমাপাপ’ এই অমোঘ উচ্চারণ। তার লব্দ অনুভূতির নিরিখে পরের অনুভূতি নিজের মধ্যে স্পষ্ট করতে সমর্থ হতেন।

এ ছাড়াও শীল, সমাধি, প্রজ্ঞা এবং আত্মাধিকতায় একজন পরিপূর্ণ আলোকিত মানুষ হওয়ায় তিনি সকলের কাছে খুবই জনপ্রিয়তা লাভ করেন। ১৯৩০ খিস্টাব্দ থেকে আমৃত্যু তিনি রাউজান উপজেলাধীন বিনাজুরীস্থ ইদিলপুরে সর্বানন্দ বড়ুয়ার গৃহে অহোরাত্র যাপন করতেন। অনুভূতির গভীরতায় তিনি সমৃদ্ধ ছিলেন। তাই কোনোগ্রামে কোন ভক্ত তাকে স্মরণ করলে তিনি তা জানতে পারতেন। পরে ঐ ভক্তের কাছে ছুটে যেতেন। এভাবে তাঁর আধ্যাত্মিকতায় বহিঃপ্রকাশ ঘটে।
এই মহাসাধক ৩১শে আগস্ট ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে পারলৌকিক নির্বাণ যাত্রা করেন। এভাবে তাঁর জীবনের বহু বিচিত্র ঘটনা অবনীর উদ্ভাসিত রূপ প্রদীপ্ত হয়। যা আকৃষ্ট করেছে সকল গুণগ্রাহী ভক্তবৃন্দকে। অনুপ্রাণিত করেছে মানুষের সৎ জীবন যাপনের প্রয়াসকে। বর্তমানে এ গুরু ঠাকুরের সেবায় নিত্যপূজা নিবেদন ছাড়াও তাঁর প্রতিবিম্ব সংরক্ষণে শোভা পাচ্ছে জোবরাস্থ স্মৃতিমন্দির।

আজ গুরু ঠাকুরের পূজায় ও সেবায় হাজার হাজার মানুষের পদাচারণায় মুখোরিত গুণালংকারের জোবরা গ্রাম। তাঁর মৃত্যুর পরবর্তী সময়ে রাউজানের ইদুলপুরে এবং হাটহাজারীর জোবরা গ্রামে দুইটি পৃথক স্মৃতিমন্দির গড়ে উঠেছে। প্রতিবছর তাঁর স্মৃতিমন্দির এলাকা জুড়ে ১৫ই জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হয় সাধক গুরু গোবিন্দ ঠাকুর ও উপ-সংঘরাজ গুণালকার স্মরণে ধর্মীয় উৎসব ও মেলা।

সমীরণ বড়–য়া শিশুসাহিত্যিক, শিক্ষক; মহাপরিচালক, চলন্তিকা সাহিত্য একাডেমি, হাটহাজারী।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট