চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ১৮ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

নারীর প্রতি সহিংসতা বন্ধে অবক্ষয় রোধ ও সুবিচার জরুরি

সৈয়দ মুহাম্মদ জুলকরনাইন

১৩ জানুয়ারি, ২০২০ | ২:০৫ পূর্বাহ্ণ

চষবধংব ঃবষষ সব অস ও ঘবীঃ ? টি.এস.সি চত্বর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। প্লে-কার্ড নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ প্রদর্শন করছেন। একিই বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী ৫ ডিসেম্বর রবিবার সন্ধ্যায় কুর্মিটোলায় ধর্ষণের শিকার হয়। তার মানে আবারো নারীর উপর হায়েনার থাবা। কবে নাগাদ জাতি এ ব্যাধি থেকে মুক্তি পাবে বা মানব নামের দানবগুলির হাত থেকে মানুষ মুক্তি পাবে তার নিশ্চয়তা নেই। গত বছর ৬ এপ্রিল নোয়াখালীর সোনাগাজীতে যে হৃদয়বিদারক ঘটনা ঘটেছিল তা এখনো মানুষের মন থেকে মুছে যায়নি। সোনাগাজী ইসলামিয়া মাদ্রাসার ছাত্রী নুসরাতকে ঐ মাদ্রাসারই অধ্যক্ষ সিরাজউদৌল্লা শ্লীলতাহানি করে পার পেয়ে যেতে চেয়েছিল। কিন্তু নুসরাত তার জীবন দিয়ে প্রতিবাদ করে গেছে। অন্যায়ের কাছে মাথা নত করেনি। অথচ এরিই মধ্যে আরো অনেক নুসরাত পেশী শক্তি কিংবা রাজনৈতিক প্রতাপশালীর কারণে নিবৃতে কেঁদেছে। প্রতিবাদ করার সাহস পায়নি। এ ধরনের পরিস্থিতি আমাদেরকে অন্ধকার যুগে নিয়ে যায়। সে যুগে মুশরিকরা নারী জাতিকে মর্যাদা কিংবা সম্মানের চোখে দেখতো না, যার কারণে তাদের কারো কন্যা সন্তান জন্ম নিলে ক্রোধান্বিত হয়ে জ্যান্ত দাফন করে ফেলত। বিয়ের ব্যাপারেও ছিল অদ্ভুত যত নিয়ম। যেমন- বিনিময় বিয়ে অর্থাৎ দু’জন পুরুষ স্ব স্ব স্ত্রীকে একজন আরেকজনের মধ্যে বিনিময় করা। সাময়িক বিয়ে- এটি কোন প্রকার অনুষ্ঠান ছাড়া নির্দিষ্ট সময়ের জন্যে নির্দিষ্ট মোহর দিয়ে বিয়ে। উল্টা সিধা বিয়ে যার অর্থ কেউ নিজের কন্যাকে একজনের কাছে বিয়ে দিয়ে তার বিনিময়ে নিজে আবার ঐ ব্যক্তির বোনকে বিয়ে করতো। সুন্দর সন্তানের জন্যে বিয়ে- এটি হতো নিজের স্ত্রীর সাথে একজন সুদর্শন পুরুষের কাছে যৌনকর্মের জন্যে প্রেরণ। উদ্দেশ্য ছিল তার বংশে সুদর্শন সন্তান লাভ। দলবদ্ধ বিয়ে- আনুমানিক দশজন লোক একটি মাত্র মেয়ে নিয়ে মেতে উঠত। সুতরাং আমরা দেখতে পাচ্ছি কি ধরনের অত্যাচার নিপীড়ন জাহেলী যুগে নারীদের সাথে করা হতো। তার কিছু নমুনাই হচ্ছে বর্তমানের সমাজে ঘটে যাওয়া সহিংসতা।

নারী সর্বোপরি একজন মানুষ। বিশ্বময় মহান সৃষ্টির যা কিছু কল্যাণকর, অবশ্যই অর্ধেক তার নারী করেছে অর্ধেক করেছে তার নর। নারীর প্রতি সহিংসতা রোধে এবং নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠায় শত শত বছর ধরে সংগ্রাম চলেছে। এ সংগ্রামের নেতৃত্বে যারা ছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম ফ্রান্সের লেখিকা, রাজনীতিবিদ ও বুদ্ধিজীবী ঝরসড়হব ফব ইবধাঁড়রৎ, আমেরিকার সমাজকর্মী ও নারী নেত্রী ঝঁংধহ ই. অহঃযড়হু এবং বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন প্রমুখ। তবে নারী অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করার জন্যে সবচেয়ে বেশি অবদান রেখেছেন আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (দ.)। তিনি ইসলামী জীবন ব্যবস্থায় নারীর উপর সকল অত্যাচার, উৎপীড়ন, অমানবিক আচরণ এবং নারীকে ভোগ্য পণ্য মনে করাকে হারাম (নিষিদ্ধ) করে দেন। বিদায় হজ্বের ভাষণে নবীয়ে করিম (দ.) ঘোষণা করেছিলেন, ‘‘ নারীদের ব্যাপারে আমি তোমাদেরকে সতর্ক করলাম। তাদের সাথে নিষ্ঠুর আচরণ চলবে না। নারীদের উপর যেমন তোমাদের অধিকার রয়েছে তেমনি তোমাদের উপরও তাদের নিশ্চিত অধিকার রয়েছে। সুতরাং তাদের কল্যাণের কথা প্রতিনিয়ত খেয়াল রেখো।’’ পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ বলেন, ‘‘হে লোকেরা! নিজেদের প্রভুকে ভয় কর, যিনি একটি মাত্র প্রাণ থেকে তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন। অতঃপর তা থেকে তার জোড়া সৃষ্টি করেছেন। আবার এ দু’জন থেকেই অনেক পুরুষ ও নারী সৃষ্টি করে বিস্তার করে দিয়েছেন।’’ সূরা আন্-নূর ৩০ নং আয়াতে আল্লাহপাক বলেন, ‘‘ হে প্রিয় রসুল! ঈমানদারগণকে বলে দিন, যেন তাদের দৃষ্টি অবনত রাখে এবং নিজেদের লজ্জাস্থানকে হেফাজত রাখে। এটা তাদের জন্যে সতিত্ব রক্ষার উপায়। আল্লাহ এ সম্পর্কে খুবই অবগত আছেন যা তারা সম্পন্ন করে।’’

আমরা আধুনিক যুগের বাসিন্দা হয়েও কেন যে অন্ধকার যুগের আচরণ করছি তা খতিয়ে দেখা খুবই জরুরী। বিজ্ঞানের উৎকর্ষতার ফলে আধুনিক জীবন ব্যবস্থা আমরা উপভোগ করছি। অথচ সভ্যতার দিক থেকে এখনো আমাদের ধ্যান-ধারণা, বোধ, বিবেক ক্রমান্বয়ে যেন লোপ পাচ্ছে। তা না হলে প্রতিদিন কেন নির্মমতা আর হৃদয়বিদারক ঘটনার মুখোমুখি হচ্ছি। ২০১৯ সালে আইন ও সালিশ কেন্দ্রের পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, পাঁচ বছরে ৩ হাজার ৫৮৭ জন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। একিই সময় পুলিশ সদর দপ্তরে মামলা হয়েছে ১৯ হাজারের অধিক। অর্থাৎ প্রতিদিন গড়ে ১১ টি ধর্ষণ সংক্রান্ত মামলা হয়েছে। তবে আসামিদের সাজা হয়েছে মাত্র ৩ শতাংশ। ২০১৮ সালের জানুয়ারী থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত চৌদ্দটি জাতীয় পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদের উপর ভিত্তি করে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের লিগ্যাল এইড উপ-পরিষদ একটি গবেষণা প্রতিবেদন তৈরি করে।

তাতে ৯৪২ টি ধর্ষণের ঘটনার উল্লেখ করে বলা হয় ২০১৮ থেকে ২০১৯ সালে ধর্ষণ আরো বেড়েছে। একটি প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, রাজনৈতিক নেতা, জনপ্রতিনিধি, সন্ত্রাসী বা মাস্তান এবং উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের হস্তক্ষেপের কারণেও পুলিশ অপরাধী ধরতে পারেন না। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর মোহাম্মদ রেজাউল করিমের নেতৃত্বে পরিচালিত গবেষণা প্রতিবেদনটিতে ৬টি মহানগরের ২২টি থানা অর্ন্তভুক্ত ছিল। দেশের এহেন পরিস্থিতিই ধর্ষণের মতো জঘন্য অপরাধ দমনের ক্ষেত্রে ফলপ্রসূ বা ইতিবাচক ফল বয়ে আসছে না বলে বিজ্ঞজনরা মনে করেন। মানুষ ‘‘আশরাফুল মাখ্লুকাত’’ বা সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব। কিন্তু সে মানুষের আচরণ এখন সর্বনি¤œ পর্যায়ে নেমে যাওয়াতে অনেকে পশুর সাথে তুলনা করছেন। তার পেছনে যথেষ্ট কারণও বিদ্যমান। আমাদের সমাজে নীতি নৈতিকতার অভাব প্রকট হয়ে উঠেছে। অন্যের অসুবিধে কিংবা ক্ষতির তোয়াক্কা না করে যেমন ইচ্ছে তেমন করেই চলতে ফিরতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি। ঘর থেকে বের হয়ে বিকট শব্দে রিক্সা ডাকি। থুথু কিংবা কফ আসলে যেখানে সেখানে ছুঁড়ে মারি। রাস্তায় কারো বোন বা স্ত্রী দেখলে উঁকি-ঝুঁকি দিতে থাকি নিজের মা বোনের কিংবা মেয়ের কথা ভুলে গিয়ে। এমনি অবস্থার পরিবর্তন কিংবা টোটাল সমস্যার সমাধান করতে হলে প্রতিষ্ঠা করতে হবে আইনের শাসন। মানতে হবে ধর্মীয় রীতিনীতি। সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রচলন করতে হবে মূল্যবোধ জাগানিয়া কার্যক্রম। সর্বোপরি ভয় করতে হবে মহান আল্লাহকে। সূরা ক্বেয়ামায় আল্লাহপাক বলেছেন- ‘‘ মানুষ কি মনে করে যে, তাকে এমনি বে- হিসাব ছেড়ে দেয়া হবে?’’

সৈয়দ মুহাম্মদ জুলকরনাইন রাজনীতিক, প্রাবন্ধিক।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট