চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

৭-২৫ মার্চ পর্যন্ত ঘটনাবলি ও বঙ্গবন্ধুর গ্রেফতার প্রসঙ্গ

নাওজিশ মাহমুদ

১২ জানুয়ারি, ২০২০ | ৫:২৬ পূর্বাহ্ণ

১ মার্চ ১৯৭১ ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রতি জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত আবেগের বর্হিপ্রকাশ। রাস্তায় মিছিল শ্লোগান এবং ব্যারিকেড দিয়ে জনতা আবেগকে শক্তিতে রূপান্তর করে। ৭ মার্চের বঙ্গবন্ধুর ভাষণ ছিল জনতার আবেগ এবং পাকিস্তানের সামরিক শাসকদের উৎকন্ঠার মধ্যে সেতু বন্ধন। সেই সাথে “এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম ও এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম”কে প্রকান্তরে পরোক্ষভাবে স্বাধীনতা ঘোষণা হিসেবে গণ্য করা যেতে পারে।

সরাসরি স্বাধীনতা ঘোষণা না করে জনগণকে স্বাধীনতার বার্তা পৌঁছে দেয়ার একটি অনন্য কৌশল। ৭ মার্চ ১৯৭১ থেকে ২৫ মার্চ পর্যন্ত ছিল উভয় পক্ষের প্রস্তুতি পর্ব। ৭ মার্চের বঙ্গবন্ধুর ভাষণের পর পাকিস্তানের উপর দায়িত্ব বর্তায় তারা পরিস্থিতিকে কিভাবে মোকাবিলা করে। শান্তিপুর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তর না বলপ্রয়োগের মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতার আকাক্সক্ষাকে মোকাবিলা করবে। ৭ মার্চ যাতে বঙ্গবন্ধু মুজিব স্বাধীনতা ঘোষণা না করেন, ৬ মার্চ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান বঙ্গবন্ধুর সাথে দীর্ঘক্ষণ টেলিফোনে আলাপ করে একটি টেলিপ্রিন্টার বার্তা পাঠালেন। দ্রুত সিদ্ধান্ত না নেয়ার জন্য প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান আশ^াস দেন। জনগণের আশা আকাক্সক্ষা ও জনগণকে দেয়া প্রতিশ্রুতির মর্যাদা দেয়া হবে।

বঙ্গবন্ধুর প্রত্যাশার চেয়ে বেশি দেয়ার ব্যাপারে আশ^স্থ করেন। সেই সাথে ২৫ মার্চ ঢাকায় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বসার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করা হয়। মার্কিন রাষ্ট্রদূতও বঙ্গবন্ধু মুজিবকে জানিয়ে দিলেন বাঙালিদের স্বাধীনতার পক্ষে নয় আমেরিকা। তেমনি যুব ও ছাত্রলীগের নিউক্লিয়াসপন্থীরাও স্বাধীনতা ঘোষণার জন্য বঙ্গবন্ধুর উপর চাপ অব্যাহত রাখেন। বঙ্গবন্ধু কৌশলে সিদ্ধান্ত নিতে পাকিস্তানে সামরিক সরকারের কাছে ছেড়ে দিলে, পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ সামরিক সরকারের সিদ্ধান্তের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ এক অনিশ্চৎ অবস্থায় পড়ে। প্রতিমুহূর্ত উৎকণ্ঠায় কাটে। উভয় পক্ষ পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য প্রস্তুতি এবং পরিকল্পনা সাজাতে থাকে। যুবকদের প্রশিক্ষণ দিয়ে পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য প্রস্তুত করতে পারে এই জন্য বঙ্গবন্ধু ইতিপূর্বে যুবনেতাদের নিয়ে গঠিত বিএলএফ হাইকমান্ড পুনর্বিন্যাস করেছিলেন। সিরাজুল আলম খান, আব্দুর রাজ্জাক ও কাজী আরেফ আহমদের পরিবর্তে শেখ ফজলুল হক মনি, সিরাজুল আলম খান, আব্দুর রাজ্জাক ও তোফায়েল আহমদকে নিয়ে বিএলএফ এর নতুন হাই কমান্ড গঠন করেন। ছাত্রলীগের সভাপতি নুরে আলম সিদ্দিকী, সাধারণ সম্পাদক শাহজাহান সিরাজ এবং ডাকসুর সহসভাপতি আ শ ম রব এবং সাধারণ সম্পাদক আব্দুল কুদ্দুস মাখনকে নিয়ে ৪ (চার) সদস্যের ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। বঙ্গবন্ধুর ভাষণ সরাসরি সম্প্রচার করতে না দেয়ায় বেতারকর্মীরা বেতার ভবন ত্যাগ করলে পূর্ব পাকিস্তানের সকল কেন্দ্র বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। ৮ মার্চ সকালে আবার বঙ্গবন্ধুর ভাষণ প্রচারের সুযোগ দিলে বেতারের সম্প্রচার শুরু হয়। ৮ মার্চ ১৯৭১ সালে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সভায় “স্বাধীন সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশ” গঠনের প্রস্তাব সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্য অনুমোদন দিলেও সভাপতি নুরে আলম সিদ্দিকী স্বাক্ষর থেকে বিরত থাকেন। ৯ মার্চ ১৯৭১ মাওলানা ভাসানী স্বাধীনতার প্রশ্নে বঙ্গবন্ধুকে সমর্থন করেন। বিদেশিদের ঢাকা ত্যাগের হিড়িক পড়ে যায়। সিনেমা হলে পাকিস্তানের জাতীয় সংগীত প্রদর্শন বন্ধ এবং উর্দু সিনেমা তুলে নেয়া হয়। ১০ মার্চ ১৯৭১ সিলেটে সেনাবাহিনীর রসদ সংগ্রহে জনতা বাধা দেয়। জাতিসংঘ তার কর্মচারিদের সরিয়ে নেয়ার নির্দেশ দেয়।

বঙ্গবন্ধু আওয়ামী লীগ নেতাদের নিয়ে একটি হাই কমান্ড গঠন করেন। যার সদস্য ছিলেন বঙ্গবন্ধু ছাড়াও সৈয়দ নজরুল ইসলাম, খন্দকার মোশতাক আহমেদ, কামরুজ্জামান, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী এবং তাজউদ্দিন আহমদ। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ হাই কমান্ড, বিএলএফ হাইকমান্ড এবং ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ স্বাধীনতা কিভাবে দ্রুত ও কম রক্তপাতের মাধ্যমে অর্জন করা যায় সেজন্য বিভিন্ন উপায় খুঁজতে থাকেন।
বঙ্গবন্ধু জাতীয় পরিষদের সদস্য কর্নেল ওসমানীকে বাঙালি সেনাদের সংগঠিত করার দায়িত্ব দেন। কর্নেল ওসমানীর সাথে যাদের সাথে যোগাযোগ হয়েছিল তাঁরা হলেন ব্রিগেডিয়ার মাহমুদুর রহমান মজুমদার চট্টগ্রাম বেঙ্গল রেজিমেন্টর অধিনায়ক। লে, কর্নেল মাসুদ হাসান, লে. কর্নেল ইয়াসিন, মেজর জলিল, মেজর খালেদ মোশারফ, মেজর মইন এবং কেপ্টেন রফিক। এছাড়া বিএএলএফ এর পক্ষে থেকে যুবক, ছাত্র এবং স্বেচ্ছাসেবকদের প্রশিক্ষণের উদ্যোগ নেয়া হয়। কর্নেল ওসমানী ঢাকা বিমান বন্দর ও চট্টগ্রাম বন্দর দখল, ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় ঘাঁটি করে পূর্ব পাকিস্তান রাইফেল ও পুলিশ, আনসার তরুণ ও ছাত্র সমন্বয়ে প্রতিরোধ বাহিনী গড়া বিদ্রোহী ইপিআর এবং বেঙ্গল রেজিমেন্টর সহায়তায় ক্যান্টনমেন্ট আক্রমণ করার পরিকল্পনা করেন। প্রাক্তন সৈনিকরাও বৈঠক করে আসন্ন প্রতিরোধ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করার আগ্রহ প্রকাশ করেন এবং বঙ্গবন্ধুর কাছে গিয়ে নিজেদের সম্পৃক্ত করার অভিপ্রায়ও জানিয়ে দেন। এই সময় পরিস্থিতি যদি ভিন্ন দিকে মোড় নেয় তখন ভারতীয় কর্তৃপক্ষের সাথেও যোগাযোগ করা হয়। ভারতীয়দের পক্ষ থেকে গ্রিন সিগন্যাল দেয়া হয়।

পাকিস্তানের সামরিক শাসকদের সাথে একমত হতে না পেরে পদত্যাগ করলেন বুদ্ধিজীবী ও বহু ভাষাবিদ এবং বাঙালির প্রতি সহানভূতিশীল পূর্বাঞ্চলের কমান্ডার এবং পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক আইন প্রশাসক লেফট্যানেন্ট জেনারেল সাহেবজাদা ইয়াকুব খান। যিনি উদ্দেশ্যমূলক সংকট সৃষ্টি এবং অপ্রয়োজনীয় নির্যাতন চালাবার বিরোধী হিসেবে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে সুনামের অধিকারি ছিলেন। এর পর বেলুচিস্তানের কসাই টিক্কা খানকে নিয়োগ দেয়া হলো গভর্নর, সামরিক আইন প্রশাসক এবং পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডার হিসেবে। কিন্তু হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি তাঁর শপথ অনুষ্ঠান পরিচালনা করতে অস্বীকার করেন। ফলে পূর্ব পাকিস্তানে পাকিস্তানের শাসকদের নিয়ন্ত্রণ সেনাবাহিনী ছাড়া আর কোথাও ছিল না। বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে তাজ উদ্দিনের স্বাক্ষরে ১৫টি (মতান্তরে ২৩টি) নির্দেশনামা জারির মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তান তথা বাংলাদেশের প্রশাসন চলতে থাকে।

৭ মার্চের পর বাঙালি ধরতে গেলে পাকিস্তানী শাসনকে অগ্রাহ্য করে বঙ্গবন্ধু এবং আওয়ামী লীগের নিদের্শে পরিচালিত হতে থাকে। তখনই বাংলাদেশ পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারকে অস্বীকার করে। পরিস্থিতির বিবেচনা করে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান আলোচনার জন্য ১৫ মার্চ ঢাকায় আসেন। এই আগমনের পূর্বে প্রেসিডেন্টরা আসতেন যে ধরনের সম্বর্ধনা পেতেন, এবারের আগমন একবারে ভিন্নভাবে। এবারের আগমনে ছিল নিরবে ও উৎকন্ঠার।
বঙ্গবন্ধুর ভাষায় একজন মেহমান হিসেবে এসেছেন পশ্চিম পাকিস্তানের পক্ষ থেকে পূর্ব পাকিস্তানের নেতা বঙ্গবন্ধুর সাথে আলেচনা করার জন্য। সন্ধায় তিনি পূর্ব পাকিস্তানে উর্দ্ধতন সামরিক কর্মকর্তাদের সাথে বসলেন। যদি বঙ্গবন্ধুর সাথে আলোচনা ব্যর্থ হয়, তাহলে বলপ্রয়োগের মাধ্যমে বাঙালিদের নিশ্চিহ্ন করার প্রস্ততি ও রণকৌশল নিয়ে আলোচনা করলেন। শুধুমাত্র জেনারেল মিঠ্ঠা খান প্রতিবাদ করলেন। এটা রাজনৈতিভাবে সমাধানের জন্য অনুরোধ করলেন। নতুবা হাজার হাজার নিরপরাধ নারী-পুরুষ ও শিশু নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে মতামত দিলেন। এর পর মিঠ্ঠা খানকে কমান্ড থেকে সরিয়ে দেয়া হলো।
পরের দিন ১৬ মার্চ প্রেসিডেন্ট হাউজে ইয়াহিয়া খান ও বঙ্গবন্ধু মুজিবের মধ্যে একান্তে অনানুষ্ঠানিক আলোচনায় বসলেন। হয়তোবা ইয়াহিয়া খান প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালনের ব্যাপারে নিশ্চয়তা চেয়েছিলেন। যা বঙ্গবন্ধু পূর্বে ইঙ্গিত দিলেও ১লা মার্চ থেকে ১৫ মার্চ পর্যন্ত নতুন পরিস্থিতিতে পরস্পরের প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলেছেন। (আগামী রবিবার সমাপ্য)

নাওজিশ মাহমুদ রাজনীতি বিশ্লেষক
ও কলামিস্ট।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট