চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

জাতির জনকের দেশে ফেরা

ড. মুহাম্মদ ইদ্রিস আলি

১২ জানুয়ারি, ২০২০ | ৫:২৬ পূর্বাহ্ণ

১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশে ফিরে আসেন। আবেগাপ্লুত জাতি তাদের প্রাণের নেতাকে গভীর শ্রদ্ধা ও মমতায় বরণ করে নেয়।

পঁচিশ মার্চ ১৯৭১ সালের মধ্যরাতের পর ইয়াহিয়ার সরকার নিরীহ, নিরস্ত্র ঘুমন্ত বাঙালির ওপর নৃশংস গণহত্যা অপারেশন সার্চলাইট শুরু করার প্রাক্কালে ৩২ নম্বরের বাসভবন থেকে তাঁকে কাপুরুষোচিতভাবে গ্রেফতার করে। তার ২ দিন পর তাঁকে পাকিস্তানে নিয়ে যায়। এর আগে তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। পাকিস্তানের কারাগার থেকে কারাগারে দুইশত ঊননব্বই দিন অতিবাহিত করে এই মহান নেতা নিজভূমে প্রত্যাবর্তন করেন। এই দীর্ঘ সময়ে তাঁকে শারিরীক মানসিক কষ্ট দেয়া হয়। বিচারের প্রহসন করা হয়। কবর খোঁড়া হয় তাঁর জন্য। মৃত্যুর পায়তারা করা হয়। এভাবেই দুইশত ঊননব্বই দিন।
যে মহান নেতাকে মৃত্যুভয় কোনদিনই স্পর্শ করতে পারেনি, যে নেতার প্রতিটি প্রশ^াসে বাঙালি হৃদয়পরশ, যার চেতনার প্রতিটি স্পন্দনে বাংলামানস। তাঁকে বধিবে, রোধিবে কে? দুইশত ছেষট্টি দিনের অসম যুদ্ধে বাঙালি মানসে উপস্থিত মুজিবের চেয়ে অনুপস্থিত মুজিব ছিল বহুগুণে শক্তিশালী। বাঙালি তা প্রমাণ করেছিল। হুমায়ুন আজাদের ভাষায় বললে, ‘ওই রাজনীতির আকাশে একটিই নক্ষত্র ছিল, তাঁর নাম.. শেখ মুজিব। .. ১৯৬৮ থেকে ১৯৭২ পর্যন্ত তিনিই ছিলেন আমাদের রাজনীতির প্রধান পুরুষ, এবং ঐতিহাসিক বিচারেও তাঁর সঙ্গে তুলনীয় আর কোন রাজনীতিবিদ নেই। ..তাঁর পাশে অগ্রজরা মাঝারি, অনুজরা তুচ্ছ..। তিনি শুধু ক্ষমতায় যাওয়ার রাজনীতি করেননি, তিনি যুগান্তর ঘটানোর রাজনীতি করেছেন। ‘তিনি আমাদের রাজনীতির কালোত্তীর্ণ নক্ষত্র। হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি।

তেইশ বছরের উত্তাল পথ পরিক্রমায় পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠি তা বুঝতে পারেনি। বুঝতে পারার মেধা মনন তাদের ছিল না। রঞ্জনের ভাষায়, ‘দেশে দেশে নেতা অনেকে জন্মান। কেউ ইতিহাসের একটি পঙক্তি, কেউ একটি পাতা, কেউ বা এক অধ্যায়। কিন্তু কেউ আবার সমগ্র ইতিহাস। শেখ মুজিব এই সমগ্র ইতিহাস। সারা বাংলার ইতিহাস। বাংলার ইতিহাসের পলিমাটিতে তাঁর জন্ম। ধ্বংস বিভীষিকা, বিরাট বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে সেই পলিমাটিকে সাড়ে সাত কোটি মানুষের চেতনায় শক্ত ও জমাট করে একটি ভূখন্ডকে শুধু তাদের মানসে সয়, অস্থিত্বের বাস্তবতায় সত্য করে তোলা এক মহা ঐতিহাসিক দায়িত্ব। মুজিব মৃত্যুভয় উপেক্ষা করে মৃত্যুঞ্জয় নেতার মতো এই ঐতিহাসিক ভূমিকা গ্রহণ করেছেন, দায়িত্ব পালন করেছেন। ইতিহাসের সন্তান ইতিহাসকে পুনর্নির্মাণ করেছেন। এইখানেই তাঁর নেতৃত্বের ঐতিহাসিকতা।’ উজ্জলতা, উদভাস। এবং একজন ব্যক্তিই শুধু তিনি নন। একের ভিতর অনেক। একটি আন্দোলন, একটি সুদীর্ঘ বিপ্লব। একটি সফল অভ্যুত্থান। গাফফার চৌধুরীর ভাষায় বঙ্গবন্ধু‘ একটি জাতি নির্মাণের সফল কারিগর। একটি প্রতিষ্ঠান। মহাকাব্যের অমর গাথা এবং একটি সচল ইতিহাস।

এই ইতিহাসের ব্যপ্তি হাজার বছর। তাই সমকাল তাকে স্বীকৃতি দিয়েছে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি হিসেবে। ভাবীকাল তাকে স্বীকৃতি দেবে মহাকালের মহানায়ক রূপে।’
বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাসে যিনি রক্তে, বর্ণে, ভাষায়, কৃষ্টিতে এবং জন্মগতভাবে খাঁটি একজন বাঙালি। যিনি যুক্তরাষ্ট্রের নিউজউইকের ভাষায় রাজনীতির কবি। ফিদেল ক্যাস্ট্র্রোর ভাষায় হিমালয়। বাঙালির স্বাধীনতার স্বপ্নের সফল এ কারিগরকে দীর্ঘ দু’শত ঊননব্বই দিন আটকে রাখা হয় পাকিস্তানের বিভিন্ন কারাগারে। তাঁকে মুক্ত করতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী পৃথিবীর ৬৭টি দেশের রাষ্ট্রপ্রধানকে আবেগময় কূটনৈতিক চিঠি লেখেন। ১৯ দিনের বিদেশ সফরে ইউরোপের পাঁচটি দেশ ও যুক্তরাষ্ট্র সফর করেন। এভাবে গভীর আন্তরিকতা ও মেধা প্রয়োগ করে তিনি বিশ^ জনমতকে বাংলাদেশের অনুকুলে আনতে সক্ষম হন।

মধ্যরাতের এ যাত্রায় পাকিস্তানের সামরিক বিমানে তাঁর সফরসঙ্গী হন ড. কামাল হোসেন। যিনি শ^শুরপক্ষের প্রচেষ্টায় নিরাপদে পাকিস্তানে থাকার সুযোগ পান। ভোর প্রায় সাড়ে ছ’টায় তাঁকে বহন করা বিমানটি লন্ডনের হিথরো বিমান বন্দরে অবতরণ করে। তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয় ক্যারিজেস হোটেলে। সেখানে প্রথম সাক্ষাৎ করেন ব্রিটেনের লেবার পার্টি ও বিরোধীদলীয় নেতা পরবর্তীতে প্রধানমন্ত্রী হেরাল্ড উইলিয়াম। তাঁর সম্বোধন ছিল, ‘গুড মনিং মিস্টার প্রেসিডেন্ট। ‘ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথ লন্ডনের বাইরের নির্ধারিত প্রোগ্রাম বাদ দিয়ে এসে তাঁকে ঐতিহাসিক সম্মান দেন। নিজ কার্যালয়ের বাইরে এসে বঙ্গবন্ধুর গাড়ীর দরজা খুলে দাঁড়িয়ে থাকেন।
অন্যান্য আনুষ্ঠানিকতা সেরে তিনি টেলিফোনে কথা বলেন তাজউদ্দীন আহমেদ, ভারতের প্রধানমন্ত্রী মিসেস ইন্দিরা গান্ধীসহ নিকটজনদের সাথে। সারা দুনিয়া সচকিত হয়ে ওঠে তাঁর মুক্তিতে। লন্ডনের বাঙালিরা লন্ডনের রাস্তাঘাট ভরিয়ে তোলে জনতার ঢলে। মাতিয়ে তোলে উল্লাস আর আনন্দ বন্যায়। হোটেলের বাইরে উপস্থিত জনতার সাথে হাত নাড়িয়ে তিনি অভিবাদন বিনিময় করেন।
এভাবে কেটে যায় ৮ জানুয়ারি। ৯ জানুয়ারি তিনি দেশের পথে পাড়ি জমান। ১০ জানুয়ারি দিল্লিতে যাত্রা বিরতি করে তিনি ভারতীয় জনগণ ও সরকারের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। পালাম বিমান বন্দরে (বর্তমান ইন্দিরা গান্ধী বিমান বন্দর) এই মহান নেতাকে সম্মান জানাতে উপস্থিত থাকেন ভারতের রাষ্ট্রপতি ভিভি গিরি, বাঙালির অকৃত্রিম বন্ধু প্রধানমন্ত্রী মিসেস ইন্দিরা গান্ধী, অন্যান্য নেতৃবৃন্দ, সমগ্র মন্ত্রীসভা, তিন বাহিনী প্রধানগণ এবং সে দেশের অগণিত জনতা। তিনি তাদের অনুরোধে সেখানে বাংলায় বক্তব্য দেন। উম্মুখ জনতার উষ্ণ ভালোবাসা নিয়ে তিনি দেশের উদ্দেশে রওয়ানা হন।

লাখ লাখ অপেক্ষমান জনতা তাদের প্রিয় নেতাকে সংবর্ধনা জানান। তেজগাঁও বিমান বন্দর থেকে রেসকোর্স ময়দানে পৌঁছাতে তাঁর সময় লেগে যায় দুই ঘণ্টার ওপরে। বিকাল পাঁচটার দিকে প্রায় দশ লাখ জনতার সমাবেশে তিনি আবেগাপ্লুত, অশ্রুসিক্ত ভাষণ দেন। তিনি তাঁর এ ঐতিহাসিক প্রত্যাবর্তনকে ‘অন্ধকার থেকে আলোর পথে যাত্রা’ আখ্যায়িত করেন। তিনি তাঁর উচ্ছাস, তাঁর শিশুসুলভ আবেগ, তাঁর দু:খ জনতার মাঝে বিদ্যুৎ বইয়ে দেয়। তিনি আবেগাপ্লুত ভাবে বলেন, ‘যে মাটিকে আমি এত ভালোবাসি, যে মানুষকে আমি এত ভালবাসি, যে জাতিকে আমি এত ভালবাসি, আমি জানতাম না সে বাংলায় আমি যেতে পারব কিনা। আজ আমি বাংলায় ফিরে এসেছি বাংলার ভাইদের কাছে মায়েদের কাছে, বোনদের কাছে। বাংলা আমার স্বাধীন, বাংলাদেশ আজ স্বাধীন। ‘তিনি অনুরোধ রাখেন, আবেদন করেন, আহ্বান জানান, দু:খ ও গর্বের কথা বলেন। দিকনির্দেশনা দেন।
গত ১০ জানুয়ারি ছিল তাঁর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস। বাংলাদেশের মানুষ এই মহান নেতার জন্মশতবাষিকী পালনে উন্মুুখ। আমরা গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় আজ তাঁকে স্মরণ করি।

ড. মুহাম্মদ ইদ্রিস আলি মুক্তিযোদ্ধা, শিক্ষক।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট