চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ১৮ এপ্রিল, ২০২৪

পাকিস্তানের কারাগারে বঙ্গবন্ধু এবং স্বদেশ প্রত্যাবর্তন

মো. মোরশেদুল আলম

১০ জানুয়ারি, ২০২০ | ৩:৪৬ পূর্বাহ্ণ

আজ ঐতিহাসিক ১০ জানুয়ারি, বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস। পাকিস্তান কারাগার থেকে মুক্তি লাভ করে ১৯৭২ সালের আজকের এই দিনে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্থপতি, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করেন। বাঙালির মুক্তিসংগ্রামকে নিশ্চিহ্ন ও নেতৃত্বহীন করার জন্য ইয়াহিয়া খানের নির্দেশে মেজর জেনারেল খাদিম হোসেন রাজা এবং মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী ‘অপারেশন সার্চ লাইট’ নামক বাঙালি হত্যার জঘন্য এক নীল নকশা তৈরি করে। একটি স্বতন্ত্র জাতি হিসেবে বাঙালির অস্তিত্বকে পৃথিবীর বুক থেকে চিরতরে মুছে ফেলার জন্য পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী এ নীল নকশা অনুযায়ী ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ নিরস্ত্র বাঙালির উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে অত্যাচার, নির্যাতন, নিপীড়ন, ধর্ষণ, লুণ্ঠন ও গণহত্যা চালায়। পাকিস্তানি সেনাদের হাতে আটক হওয়ার পূর্বে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ২৫ মার্চ দিবাগত রাত ১২:২০ মিনিটে ট্রান্সমিটারের মাধ্যমে প্রেরিত বার্তায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আহ্বানে সাড়া দিয়ে দলমত নির্বিশেষে বাংলাদেশের জনগণ এ বর্বরোচিত হামলাকে প্রতিহত করার জন্য পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে সর্বশক্তি দিয়ে ব্যাপক প্রতিরোধ যুদ্ধ গড়ে তুলে।

জেনারেল টিক্কা খানের এডিসি মেজর এসজি জিলানির ভাষ্য মতে, ‘গ্রেপ্তারের পর শেখ মুজিবুর রহমানকে রাখা হয়েছিল ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে। তিনি ছিলেন অতীব গুরুত্বপূর্ণ নিরাপত্তাবন্দি। পাকিস্তানি বাহিনীর ভয় ছিল যে, কোনো বিদেশি রাষ্ট্র, বিশেষভাবে ভারত, তাঁকে পালিয়ে যেতে সাহায্য করতে পারে। এ জন্য তাঁর অবস্থান গোপন রাখা হয়েছিল এবং এক জায়গাতেও তাঁকে রাখা হতো না। তাঁকে পশ্চিম পাকিস্তানে পাঠাবার ব্যবস্থা দু’বার বাতিল করা হয়েছিল এ ভয় থেকে যে, খবরটা ভারতে পাচার হয়ে যেতে পারে এবং মধ্যআকাশে বিমানকে ভারত ধাওয়া করতে পারে। বাড়ি থেকে তুলে তাঁকে নেওয়া হয়েছিল নির্মীয়মান জাতীয় সংসদ ভবনে। নিয়ে যাওয়ার এক ঘণ্টা পর আবার বঙ্গবন্ধুর বাসায় আরেকটি আর্মি ট্রাক আসে। এবারকার সৈনিকদের দায়িত্ব ছিল ভিন্নতর। তারা বাড়িটি ধ্বংস করতে এসেছে। অর্পিত দায়িত্বটি তারা দখলদার বাহিনীর মতোই সমাধা করে।’ সাপ্তাহিক নিউজউইক পত্রিকায় প্রদত্ত এক সাক্ষাৎকারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানি কারাগারে তাঁর নয় মাসের বন্দি জীবনের নানা অগ্নিপরীক্ষার এক লোমহর্ষক বিবরণ প্রদান করেন। ডেভিড ফ্রস্টকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বঙ্গবন্ধু বলেন, রাওয়ালপি-ি থেকে প্রায় ১৫০ মাইল দক্ষিণে লায়ালপুরের একটি কারাগারে একতলা লাল ইটের ভবনে বিচার অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়েছিল। এটা ছিল একটি কোর্ট মার্শাল। কারণ ন্যায়ানুগ কোনো বিচারই এখানে ছিল না। এ কোর্ট মার্শালে ৫ জন সামরিক কর্মকর্তা ছিল। বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল রাষ্ট্রদ্রোহিতা, পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে বাংলাদেশকে স্বাধীন করা প্রভৃতি। তাঁর বিরুদ্ধে আনীত ১২টি অভিযোগের মধ্যে ৬টির শাস্তি ছিল মৃত্যুদ-। ১৯৭১ সালের ১০ আগস্ট পাকিস্তানের দ্য ডন পত্রিকায় প্রকাশিত এক সংবাদে প্রদত্ত তথ্য অনুযায়ী ‘একটি সরকারি প্রেসনোটে জানানো হয় যে, শেখ মুজিবুর রহমানকে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার অপরাধ এবং অন্যান্য অপরাধের জন্য একটি বিশেষ সামরিক আদালতে বিচার হবে।’ বঙ্গবন্ধু ডেভিড ফ্রস্টকে বলেন, পাকিস্তান তাঁর পক্ষে একজন এডভোকেট দিতে চাইলেও তা নিতে তিনি অস্বীকৃতি জানান। কারণ তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে, বিচারটি ছিল একটি প্রহসনমূলক নাটক। কারণ বিচারের রায় আগে থেকেই তৈরি করা ছিল। সামরিক জান্তা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করতে বদ্ধপরিকর ছিল। ৭ সেপ্টেম্বর পাকিস্তানের ফায়জালাবাদ (লায়ালপুর) জেলে বঙ্গবন্ধুর গোপন বিচার করে তাঁকে দেশদ্রোহী হিসেবে আখ্যায়িত করে মৃত্যুদ- রায় প্রদান করে। পাকিস্তান সরকার বঙ্গবন্ধুকে ফাঁসি দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। তাঁর কারাকক্ষের নিকটেই কবর খোঁড়ে রাখে। ঘটনাটি ছিল: ‘একদিন ভারতীয় বন্দিদের ব্যারাকে এলেন ডেপুটি সুপারিনটেনডেন্ট ফজলদাদ। পুরো সেল থেকে তিনি আটজন বন্দিকে বাছাই করলেন। পুলিশ কর্মকর্তা তাদের হুকুম দিলেন আট ফুট লম্বা, চার ফুট প্রশস্ত ও চার ফুট গভীর গর্ত খুঁড়তে। তারা দ্রুত বুঝে নিলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সে রাতেই ফাঁসি দেয়া হবে।’ এভাবে বঙ্গবন্ধুর জন্য তিনবার কবর খোঁড়া হয়েছিল।

বঙ্গবন্ধু ফ্রস্টকে আরো বলেন যে, ‘জুলফিকার আলী ভুট্টো বঙ্গবন্ধুকে জানায়, ভুট্টোকে ক্ষমতা হস্তান্তর করার আগে ইয়াহিয়া খান জানান যে, তার সবচেয়ে বড় ভুল হয়েছিল শেখ মুজিবুর রহমানকে মেরে না ফেলা। ইয়াহিয়া খান ভুট্টোকে আরো বলে যে, ক্ষমতা হস্তান্তরের আগে তাকে শেখ মুজিবুর রহমানকে মেরে ফেলার অনুমতি দেয়া হোক এবং তাকে বলতে দেয়া হোক যে, অনেক আগের তারিখেই তাঁকে ফাঁসি দেয়া হয়েছে।’ ১৯৭১ সালের ডিসেম্বর মাসে লায়ালপুর থেকে মিয়ানওয়ালি জেলে বঙ্গবন্ধুকে স্থানান্তর করা হয়। বিভিন্ন দেশ ও বিশ্বের মুক্তিকামী জনগণ বঙ্গবন্ধুর জীবনের নিরাপত্তার দাবি জানায়। ২৭ ডিসেম্বর সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে অবিলম্বে নিঃশর্ত মুক্তি প্রদানের জন্য দাবি জানানো হয়। ভারত, সোভিয়েত ইউনিয়নসহ বিভিন্ন দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থার পক্ষ থেকে বঙ্গবন্ধুর মুক্তির জন্য পাকিস্তান সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলা হয়, শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি। তাঁকে বন্দি করে রাখার কোনো অধিকার পাকিস্তানের নেই। ঢাকার তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর জেনারেল নিয়াজী যখন আত্মসমর্পণ করছিল, ‘তখনো বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কারা-কুঠুরিতে মৃত্যুর প্রহর গুনছেন।…বঙ্গবন্ধুকে ফাঁসি দেয়ার প্রস্তুতি গ্রহণের জন্য ইয়াহিয়া খান কারা কর্তৃপক্ষের নিকট নির্দেশ পাঠিয়েছিলেন। জানিয়েছিলেন মৃত্যুদ- কার্যকর করার জন্য বিশেষ টেলিগ্রাম যাবে তাদের কাছে। কিন্তু তার আগেই পরাজিত হলো পাকিস্তানি বাহিনীর এবং সে বিশেষ টেলিগ্রাম আর পাঠানো হলো না।’ ইয়াহিয়া খান ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পরেও সামগ্রিক রাজনৈতিক অবস্থা সম্পর্কে কোনো সঠিক তথ্য এবং নিজের অবস্থান সম্পর্কে বঙ্গবন্ধুর কোনো ধারণা ছিলো না। ২৬ ডিসেম্বর আর্মির একটি হেলিকপ্টার তাঁকে রাওয়ালপি-ির বাইরে একটি বাংলোয় নিয়ে যায়। ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু মুক্তি না হওয়া পর্যন্ত সেখানে আর্মি কমা-োদের প্রহরায় ছিলেন। অবশেষে এলো বহু প্রতীক্ষিত মুক্তির দিন। পাকিস্তান সরকার আন্তর্জাতিক চাপে ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে বঙ্গবন্ধু ভোরে বিমানযোগে রাওয়ালপি-ি থেকে যুক্তরাজ্যে গমন করেন। ১০, ডাইনিং স্ট্রিটে ৮ তারিখ রাতে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হীথ-এর সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর এক ঘন্টাব্যাপী একটি বৈঠক হয়। এ বৈঠকে বঙ্গবন্ধু যুক্তরাজ্যসহ বিভিন্ন দেশের স্বীকৃতি অর্জনের ব্যাপারে সহযোগিতা কামনা করেন। ৯ জানুয়ারি প্রত্যুষের পর ব্রিটিশ বিমান বাহিনীর একটি কমেট জেট বিমানে ঢাকার উদ্দেশ্যে লন্ডনের হিথ্রো বিমানবন্দর ত্যাগ করেন। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি ঢাকার পথে দিল্লির পানাম বিমানবন্দরে তিনি যাত্রাবিরতি করেন। বাংলাদেশের এ মহান স্থপতিকে ভারতের রাষ্ট্রপতি ভি ভি গিরি, প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীসহ লক্ষ লক্ষ জনতা বিপুল সংবর্ধনা দেয়। ইন্দিরা গান্ধী বলেন, ‘শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর জনগণের নিকট স্বাধীনতার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন এবং তিনি তা তাঁদের এনে দিয়েছেন।’ বিশাল জনতার উদ্দেশে আবেগজড়িত কণ্ঠে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘বাংলাদেশ ও তার জনগণ আপনাদের প্রধানমন্ত্রী, সরকার, সশস্ত্র বাহিনীর বীর সদস্যবৃন্দ এবং আপনাদের সাধারণ মানুষকে কোনো দিনই ভুলতে পারবে না; যাঁরা তাদের দুঃখ-দুর্দশায় এবং সংগ্রামে সর্বাত্মক সহানুভূতি প্রদর্শন ও সমর্থন দান করেছেন।’

অবশেষে আসে ঐতিহাসিক সে মাহেন্দ্রক্ষণ। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি অপরাহ্নে বঙ্গবন্ধু ঢাকা বিমান বন্দরে অবতরণের মাধ্যমে স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করলেন। জাতির জনককে একটি খোলা ট্রাকে করে বিমানবন্দর থেকে উৎসুক জনতার প্রচ- ভিড়ের মধ্য দিয়ে রেসকোর্সে আনা হয়। গাড়িতে চড়ে বিমানবন্দর থেকে রেসকোর্স ময়দানে পৌঁছতে ভিড়ের কারণে আড়াই ঘণ্টারও বেশি সময় লেগেছিল। রেসকোর্স ময়দানে গিয়ে বঙ্গবন্ধু প্রায় পাঁচ লক্ষেরও অধিক জনতার সমাবেশে অশ্রুসিক্ত নয়নে জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দেন। বঙ্গবন্ধুর মুক্তির পূর্ব পর্যন্ত বাঙালিরা জানতো না তাঁদের মুক্তিদাতা এবং অবিসংবাদিত নেতা জীবিত আছেন নাকি পাকিস্তানিদের দ্বারা নিহত হয়েছেন। বঙ্গবন্ধুর এ অনুপস্থিতি বাঙালি জাতিকে নিরুৎসাহিত না করে বরং পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ-সংগ্রাম ও প্রতিরোধ গ্রহণের স্পৃহায় আরো উজ্জীবিত করেছে। সুদূর পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি হিসেবে অনিশ্চিত জীবন অতিবাহিত করলেও মহান মুক্তিযুদ্ধে বঙ্গবন্ধুই ছিলেন উৎসাহ, উদ্দীপনা ও অনুপ্রেরণার প্রতীক।

মো. মোরশেদুল আলম সহকারী অধ্যাপক, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট