চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ১৮ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

মেডিকেল সায়েন্সের দৃষ্টিকোণ থেকে শব্দদূষণে স্বাস্থ্যঝুঁকি

ডা. মোহাম্মদ ওমর ফারুক

৯ জানুয়ারি, ২০২০ | ৪:৩৭ পূর্বাহ্ণ

শব্দদূষণ এখন নগরজীবনে মহামারী আকার ধারণ করেছে। ঘর থেকে বের হলেই যানবাহনের হাইড্রোলিক হর্ণের প্রচ- আওয়াজ, ভবন নির্মাণে ব্যবহৃত বিভিন্ন যন্ত্রপাতির আওয়াজ, রাজনৈতিক বক্তৃতা, ওয়াজ-মাহফিল, বিভিন্ন সভা-সমাবেশ ইত্যাদিতে ব্যবহৃত সাউন্ড সিস্টেমের অস্বাভাবিক আওয়াজ, বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে ব্যান্ড পার্টিসমূহের গগনবিদারী আওয়াজ ইত্যাদি এখন যেন নগরবাসীকে অসহনীয় করে তুলেছে। যদি আমরা একটু গভীরে যাই তাহলে এ শব্দদূষণের অসহনীয় মাত্রার বিরুপ প্রতিক্রিয়া কি হতে পারে তা বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণের মাধ্যমে জানা যাবে।
আমরা জানি, আল্লাহ প্রতিটি সৃষ্টিকূল মানুষের শোনার জন্যে দুটি কান দিয়েছেন। প্রতিটি কানে তিনটি অংশ- বহিঃকর্ণ, মধ্যকর্ণ ও অন্তঃকর্ণ। আবার বহিঃকর্ণে দুটি অংশ একটি- ধঁৎরপষব ড়ৎ ঢ়রহহধ। অন্যটি হল বীঃবৎহধষ ধঁফরঃড়ৎু পধহধষ। মধ্যকর্ণ কয়েকটি অংশ নিয়ে গঠিত। একটি হল- ঞুসঢ়ধহরপ পধারঃু যেখানে রয়েছে নরম অস্থিসমূহ, মাংসপেশী, লিগামেন্ট। এই অংশটি বহিঃকর্ণকে কানের পর্দা থেকে পৃথক করেছে। এখানে ঊঁংঃধপযরধহ ঞঁনব নামক একটি টিউব রয়েছে, যেটি মধ্যকর্ণের অভ্যন্তরের চাপ এবং বাহিরের পরিবেশের চাপের সমতা রক্ষা করে। অন্তঃকর্ণের অধিকাংশই ¯œায়ুমজ্জা দ্বারা গঠিত। এখানকার অংশসমূহ হল- ঈড়পযষবধ, াবংঃরনঁষব, ংবসরপরৎপঁষধৎ পধহধষং। অঁৎরপষব নরম হাড় দিয়ে গঠিত, যেটাকে বলা হয় পধৎঃরষধমব ।
শুধুমাত্র চবৎরপযড়হফৎরঁস এর সাথে লাগানো অংশটি চামড়ার আবরণ দ্বারা গঠিত। যেখানে ইনফেক্শান বেশি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। বহিঃকর্ণের আরেকটি অংশ হল অঁফরঃড়ৎু পধহধষ. এটি একটি গুহার মতন। যেখান থেকে শব্দের ঢেউ কানের পর্দা তথা ঃুসঢ়ধহরপ সবসনৎধহব এ পৌঁছায়। এটি আবার দুটি অংশ নিয়ে গঠিত, একটি নরম হাড় দিয়ে আর অন্যটি শক্ত হাড় দিয়ে। পুরো পধহধষ এর তিনভাগের একভাগ নরম হাড় ও তিনভাগের দুইভাগ শক্ত হাড় দ্বারা গঠিত। নরম হাড়ের অংশে চুলগুচ্ছ থাকে, ংবনধপবড়ঁং এবং পবৎঁসরহড়ঁং মষধহফং থাকে। যার ফলে এ অংশে ময়লা বা ধিী জমা হয় বেশি। কানের প্রদাহ যেটি অত্যন্ত ব্যথার কারণ হয়, তাও এ অংশে হয়ে থাকে। কানের পর্দা বহিঃকর্ণকে মধ্যকর্ণ থেকে পৃথক করে। এটির রং মুক্তার মতন শাদা, অত্যন্ত পাতলা এবং উজ্জ্বল। এটির আয়তন ৫৫ বর্গ মিলিমিটার। কানের পর্দা আবার দুটি অংশ নিয়ে গঠিত একটি চধৎং ঃবহংধ আরেকটি চধৎং ভষধপপরফধ। মধ্যকর্ণে তিনটি ক্ষুদ্র অস্থি রয়েছে- (ক) গধষষবঁং (খ) ওহপঁং (গ) ঝঃধঢ়বং। ঊঁংঃধপযরধহ ঞঁনব একটি ভেন্টিলেশন টিউব যেটি ঢ়যধৎুহী এবং মধ্যকর্ণের মধ্যে অবস্থিত-যেটির দৈর্ঘ্য ৩.৮ সেন্টিমিটার। এ টিউবটি মধ্যকর্ণের ভেন্টিলেশন রক্ষা করে এবং কানের পর্দার দুদিকের বায়বীয় চাপের সমতা রক্ষা করে। যাঁরা পর্বতচূড়ায় আরোহণ করেন এবং মহাকাশ ভ্রমণে যান এ টিউবটি তাঁদের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এবং মধ্যকর্ণে পানি জমা বা সর্দি জমা হলে তা নিষ্কাশনে সহায়তা করে। মানুষের কান দুটি ভাগে বিভক্ত, প্রথমত: বাহির থেকে শব্দ যাতায়াতের জন্য ব্যবহৃত অংশ সমূহ- যেটাকে বলা হয় পড়হফঁপঃরাব ধঢ়ঢ়ধৎধঃঁং দ্বিতীয়ত: ¯œায়ুমজ্জা যেটাকে বলা হয় ঢ়বৎপবঢ়ঃরাব ধঢ়ঢ়ধৎধঃঁং।
কীভাবে শব্দ কর্ণকূহরে প্রবেশ করে?
কানের সর্ববাহিরে যে অংশটি তার নাম ধঁৎরপষব, এটি উৎপাদনকৃত শব্দপ্রবাহ সংগ্রহ করে কানের পর্দা পর্যন্ত পৌঁছায় বীঃবৎহধষ পধহধষ এর মাধ্যমে। উক্ত শব্দপ্রবাহ মধ্যকর্ণে অবস্থিত ক্ষুদ্র অস্থি যার নাম ংঃধঢ়বং এ পৌঁছায় অন্য দুটি ক্ষুদ্র অস্থি সধষষবঁং এবং রহপঁং এর মাধ্যমে যা শব্দপ্রবাহ অস্থিসমূহের বিভিন্ন অংশকে প্রকম্পিত করে। উক্ত শব্দপ্রবাহ ঢ়বৎরষুসঢ়যধঃরপ ভষঁরফ কে কম্পমান করে তোলে। শব্দশক্তিকে মস্তিকে পৌঁছানো একটি বিশাল ভূমিকা রাখে মধ্যকর্ণ। মধ্যকর্ণ শব্দকে বায়ুমন্ডল থেকে অন্তঃকর্ণে নিয়ে আসে।
শব্দ এই দীর্ঘ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আমাদের কেন্দ্রীয় ¯œায়ুমজ্জায় অবস্থিত অডিটরি সেন্টারে পৌঁছে। তখনি আমরা শুনতে পাই। এ পুরো প্রক্রিয়াটি কয়েক মিলি সেকেন্ডের মধ্যে হয়ে থাকে। এখানেই রয়েছে মহান আরশের একচ্ছত্র অধিপতি আল্লাহতায়ালার অপার করুণা, অপার মহিমা। অন্তঃকর্ণে অবস্থিত পড়পযষবধ নামক অংশটি শোনার মূল নিয়ামক হিসেবে বিবেচিত। কোন কারণে যেমন- ম্যালেরিয়া, টাইফয়েড, মাম্স, প্রলম্বিত ভাইরাল জ্বর অথবা অজানা কোন কারণে পড়পযষবধ বিনষ্ট হয়ে গেলে মানুষ আর শুনতে পায় না। অতএব পড়পযষবধ নামক অন্তঃকর্ণে অবস্থিত গুরুত্বপূর্ণ অংশটি আল্লাহতায়ালার সবিশেষ রহমত। আজ যাদের পড়পযষবধ বিভিন্ন কারণে অকেজো হয়ে গেছে তারা যখন শুনতে পায় না তখন নিজেকে বড্ড অসহায় মনে হয়। আমরা যারা কান দিয়ে ভালভাবে শুনি তাঁদের লাখো কোটি শোকর- গুজার করা উচিত মহান আল্লাহর কাছে।
০-১০ ডেসিবল হচ্ছে সবচেয়ে ভাল শোনা, ১১-২৫ ডেসিবল স্বাভাবিক শ্রবণ ক্ষমতা, ২৬-৪০ ডেসিবল অল্প শ্রবণশক্তি সম্পন্ন, ৪১-৫৫ ডেসিবল যারা সড়ফবৎধঃব ফবধভহবংং এ আক্রান্ত। ৫৬-৭০ ডেসিবল, যারা ংবাবৎব ফবধভহবংং এ আক্রান্ত, আর ৭১-৯০ যারা াবৎু ংবাবৎব ফবধভহবংং এ আক্রান্ত, ৯১ থেকে এবং তার উপরে ঢ়ৎড়ভড়ঁহফ ফবধভহবংং এ আক্রান্ত । শহর-বন্দরে বিভিন্ন ধরনের আওয়াজে অতিষ্ঠ নগরবাসী পর্যায়ক্রমে উপরে উল্লেখিত ধারাবাহিক বধিরতায় ভোগে। দীর্ঘদিন ধরে গ্যারেজে কাজ করা শ্রমিক, জেনারেটর সংক্রান্ত কার্যক্রমে নিযুক্ত শ্রমিক, কোন মেশিনারী কাজে ব্যস্ত শ্রমিকদের সাধারণত উক্ত বধিরতার ক্রমানুসারে শ্রবণশক্তি লোপ পেতে শুরু করে। বর্তমানে হাইড্রোলিক হর্ণের দৌরাতœ্য সবচেয়ে বেশি কিংবা বিভিন্ন ব্যান্ড সংগীতের বিকট আওয়াজে অতিষ্ঠ নাগরিকদের শ্রবণ ক্ষমতা ধীরে ধীরে হ্রাস পেতে শুরু করে। অতিরিক্ত মোবাইল ফোন ব্যবহারের কারণেও সাধারণ মানুষ কানের বধিরতায় ভুগতে পারে। কারণ মোবাইল থেকে নিঃসৃত ঊষবপঃৎড়সধমহবঃরপ ধিাব অন্তঃকর্ণের ¯œায়ুমজ্জাকে আঘাত করতে পারে, ফলে ধীরে ধীরে উক্ত ব্যক্তির শ্রবণশক্তি কমতে থাকে- এক পর্যায়ে শোঁ শোঁ আওয়াজ, খিটখিটে মেজাজ উৎপন্ন হয়। অতএব কানে মোবাইলে কথা না বলে লাউড স্পিকার দিয়ে কথা বলাই শ্রেয়। সম্প্রতি মেট্রোপলিটন পুলিশের কাছে জনজমায়েত কিংবা জনসমাবেশ প্রতিরোধ করার জন্যে কিছু ংড়হরপ ফবারপব প্রদান করা হয়েছে সরকারের পক্ষ থেকে। এটি ব্যবহারের ফলে অন্তঃকর্ণে অবস্থিত ¯œায়ুমজ্জাকে ধীরে ধীরে আঘাত করে শ্রবণশক্তি ক্ষয় পেতে শুরু করে। উক্ত ংড়হরপ ফবারপব সাধারণত বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করার জন্য ব্যবহার করা হয়ে থাকে। উক্ত ডিভাইসের নাম হচ্ছে ঐঝ-১৬ অপড়ঁংঃরপ ঐধরষরহম উবারপব। শুধু বিক্ষোভকারী নয়, অনেক নির্দোষ পথচারীও এতে আক্রান্ত হতে পারে, যদি এটি জনবহুল রাজপথে অতিরিক্ত ভলিউমে ব্যবহার করা হয়। ৫০ লক্ষ টাকা দামের ১২টি ডিভাইস পুলিশ কর্তৃপক্ষকে প্রদান করা হয়েছে গত বছর। এ ডিভাইসের শব্দ এক কিলোমিটার পর্যন্ত অতিক্রম করে এবং পথচারীদের কানে অনায়াসেই প্রবেশ করে। যদিও বর্তমানে পুলিশ বিক্ষোভ দমনের জন্য জলকামান, বাটন, টিয়ার গ্যাস সেল, রাবার বুলেট, শর্টগান এবং সাউন্ড গ্রেনেড ব্যবহার করে থাকে। পুলিশের জনৈক উর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেছেন, অপ্রত্যাশিত দুর্ঘটনা এড়ানোর জন্য এবং বিক্ষোভ দমনে আশানুরুপ ফল পাওয়ার জন্য উক্ত ডিভাইসগুলো কিনেছিলাম। এ ডিভাইসগুলো ব্যবহারের ফলে দাঙ্গাপুলিশকে ঘটনাস্থলে যেতে হয় না। এটার ভাল দিকও আছে অপরদিকে মানুষের অন্তঃকর্ণে ¯œায়ুমজ্জাকে চিরদিনের জন্য ধ্বংস করে দিতে পারে। যেটার মেডিকেল চিকিৎসা আদৌ নেই বললেই চলে। আমেরিকার নির্মিত উক্ত ডিভাইসের প্রতিটির ওজন ১৬ কেজির উপরে এবং ১৪৮ ডেসিবল পর্যন্ত শব্দ অতিক্রম করে। উক্ত ডিভাইস মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহারের ফলে কানের ¯œায়ুরজ্জুকে চিরতরে নষ্ট করে দিতে পারে এবং পরবর্তীতে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি স্থায়ী বধির হিসেবে সমাজে পরিচিতি পায়। আমরা সাধারণত ৬০ ডেসিবলের মধ্যে কথাবার্তা বলি। যদি শব্দ ১৩০ ডেসিবল অতিক্রম করে তখন স্বাভাবিকভাবে ব্যথা অনুভূত হয়। ৮৫ ডেসিবলের উপরে শব্দ অতিক্রম করলে শ্রবণশক্তি লোপ পায়। যেটি আমেরিকার ঘধঃরড়হধষ ওহংঃরঃঁঃব ভড়ৎ ঙপপঁঢ়ধঃরড়হধষ ঝধভবঃু ধহফ ঐবধষঃয এর গবেষণায় জানা গেছে।
দু’বছর আগে ঢাকার শাহবাগে আহুত বাম দলের আধা দিবস হরতালের সময় উক্ত ডিভাইস পুলিশকে ব্যবহার করতে দেখা গেছে। এক ঘণ্টার উক্ত ডিভাইস ব্যবহারকালীন সময়ে পথচারীদের কেউ কেউ কানে আঙ্গুল দিয়ে স্থান ত্যাগ করতে দেখা গেছে। আবার কেউ কেউ মাথা ঘুরানোর অভিযোগ করেছে। অতএব শব্দদূষণ প্রতিরোধে বিহীত ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরি, নচেৎ বাংলাদেশে বধির মানুষের সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলবে। সম্প্রতি ঢাকায় অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা ঘটে গেল। বিয়ে বাড়িতে গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানে উচ্চৈঃস্বরে গান বাজানোর কারণে একই ফ্ল্যাটের বাসিন্দা জনৈক হৃদরোগী অভিযোগ করলে গান-বাজনা সাময়িকভাবে বন্ধ হয় বটে কিন্তু পরের দিন উক্ত হৃদরোগীকে ডেকে এনে ফ্ল্যাট মালিক সমিতির সেক্রেটারিসহ পরিবারের অপারাপর সদস্যরা কিল, ঘুষি মারতে মারতে এক পর্যায়ে মেরেই ফেলল। এ ধরনের অমানবিক ঘটনার যেন পুনরাবৃত্তি না হয় সে ব্যবস্থা গ্রহণ করা সরকারের এবং আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। মাত্রাতিরিক্ত হর্ণযুক্ত যানবাহনগুলোর চলাচল বন্ধেও কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরি। যত্রতত্র মাইক বাজানো, হাই ভলিউম দিয়ে গান বাজিয়ে ক্রেতাদের আকর্ষণ করা, রাজপথের মাঝখানে জায়গা দখল করে সমাবেশ করা এবং সারাক্ষণ মাইকে বিভিন্ন বক্তৃতা-ভাষণ বাজানো ইত্যাদি প্রতিরোধে সরকারের পাশাপাশি সচেতন মহলকে এগিয়ে আসা কর্তব্য বলে মনে করি।
সূরা লোকমানের একটি আয়াত দিয়ে শেষ করছি- ‘(হে বৎস,যমীনে চলার সময়) তুমি মধ্যমপন্থা অবলম্বন করো, তোমার কণ্ঠস্বর নীচু করো, অবশ্যই আওয়াজসমূহের মধ্যে সবচাইতে অপ্রীতিকর আওয়াজ হচ্ছে গাধার আওয়াজ।’

ডা. মোহাম্মদ ওমর ফারুক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট