চট্টগ্রাম শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

প্রসঙ্গ চুল ও চুলপড়া

চিকিৎসা শ্রমিকের দিনলিপি

ডা. হাসান শহীদুল আলম

৮ জানুয়ারি, ২০২০ | ২:১৯ পূর্বাহ্ণ

পৌষের মাঝামাঝি। ১৪২৬ বঙ্গাব্দ। সকাল দশটা। পটিয়াস্থ চেম্বার।
‘তিনদিন পর পর সপ্তাহে দুই বার কনডিশনারযুক্ত মেডিকেটেড শেম্পু ব্যবহার করবেন। মাথার চুলের গোড়া এতে পরিষ্কার ও শুষ্ক থাকবে। চুলের গোড়ায় ফাংগাস বাসা বাঁধবে না। খুশকী হবে না। তোয়ালে, ব্রাশ, চিরুনি, বালিশ সবকিছু পরিষ্কার, শুকনা ও জীবাণুমুক্ত রাখতে হবে। অন্যের ব্যবহৃত তোয়ালে, ব্রাশ, চিরুনী ব্যবহার করবেন না। সপ্তাহে একবার বালিশ রোদে রাখবেন ৩০ মিনিট করে। ব্যক্তিগত পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা মেনে চললে আশা করি আপনাকে আর এমনি সমস্যায় ভুগতে হবে না।’Ñ আমার এটুকু বক্তব্যের পর চল্লিশোর্ধ হালকা গড়নের মহিলার চেহারায় স্বস্তির ভাব ফুটে উঠতে দেখলাম। ব্যবস্থাপত্রসহ মহিলা বিদায় নেবার পরক্ষণে চেম্বারের ভেতরটা জানালার কাঁচ ভেদ করে আসা মিষ্টি রোদের আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে উঠলো। জানালা পথে বাইরে তাকিয়ে রোদ ঝলমলে প্রকৃতির নন্দিত রূপের সাথে পাশর্^বর্তী আমগাছের পাতার ফিকে হয়ে আসা সবুজ রংকে বড্ড বেমানান মনে হলো।

মহিলার কথায় পুনরায় ফিরে আসি। মাসখানেক আগে এসেছিলেন মাথার পেইনটায় দীর্ঘস্থায়ী পুঁজপূর্ণ ঘা সহ প্রদাহ এবং অত্যধিক চুলপড়া সমস্যা নিয়ে। আপাত রোগ নির্ণয় ছিলো : মাথায় ফাংগাস সংক্রমণজনিত ঘা এবং চুলপড়া। ব্যবস্থাপত্রানুযায়ী ওষুধ সেবন করায় এবং পরামর্শ মেনে চলায় আজকের তৃতীয় সাক্ষাতে রোগীনী সুস্থ হয়েছে দেখলাম। আজকের লেখায় চুল এবং চুল পড়া সম্পর্কিত তথ্যাদি থাকছে।
চুল সম্পর্কিত তথ্যাদি :

চুল কি? চুল প্রাণহীন বস্তু যাহা দেহত্বকের ডার্মিস স্তরে অবস্থিত চুল ফলিকেলে প্রস্তুতকৃত কেরাটিন নামক এক ধরনের আঁশ জাতীয় স্ক¬্যারোপ্রোটিন নামক গঠনগত প্রোটিন দ্বারা গঠিত।
দেহত্বকে চুল কিভাবে অবস্থান করে ?
দেহত্বক হচ্ছে মানবদেহের সবচেয়ে বাহিরের আচ্ছাদন যাহা এপিডার্মিস ও ডার্মিস নামক প্রধান দুটি কোষীয় স্তর দ্বারা গঠিত এবং যাহা দেহের অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক পরিবেশের মধ্যস্থলে অবস্থান করে দেহকে বহিঃ পরিবেশের নানাবিধ ক্ষতি থেকে রক্ষা করে। দেহত্বক তিনটি স্তরে বিভক্ত : ১) এপিডার্মিস বা বহিঃত্বক বা বাইরের স্তর ২) ডার্মিস বা অন্তঃত্বক বা ভেতরের স্তর ৩) সাবকিউটেনিয়াস কলা বা নীচের স্তরে। ডার্মিস দুটি উপস্তরে বিভক্ত : এপিডার্মিসের গায়ের অংশটি প্যাপিলারী এবং নীচের অংশটি রেটিকুলার নামে পরিচিত। ডার্মিসে চুলের গোড়া, ঘর্মগ্রন্থি, তৈলগ্রন্থি, এপোক্রাইন গ্রন্থি এবং রক্তনালী বিস্তৃত থাকে। চুলের ফলিকলগুলো পেপিলারী ডার্মিসের সংস্পর্শে পেরিফলিকুলার ডার্মিস দ্বারা বেষ্টিত থাকে। ঘর্মগ্রন্থি থেকে নিঃসৃত ঘাম ত্বক এবং চুলের পৃষ্ঠকে পিচ্ছিল করে, নরম করে, চুলকে ভঙ্গুরতা এবং ত্বককে শুষ্কতা থেকে রক্ষা করে।
বহিরাবরণ তন্ত্রের অঙ্গসমূহ কি কি?
চুল, নখ, দেহত্বক এবং উহার উপাঙ্গসমূহ।

চুলের অংশ কি কি? চুলের প্রধান দুটি অংশের মধ্যে বৃদ্ধি প্রাপ্ত অংশটি চুল ফলিকেল এবং বৃদ্ধিহীন অংশটি চুল শাফট। চুল ফলিকেল এর উপরের অংশে রয়েছে বাল্ব, সুপরাবাল্বার এরিয়া, ইস্থ্মাস, ইনফানডিবুলাম। এর নীচের অংশে রয়েছে ডারমাল, পেপিলা, মেট্রিক্স, চুল শাফট, ইনার রুটশীট, আউটার রুটশীট। চুল শাফট-এর তিনটি অংশ : মেডালা, করটেক্স, কিউটিকেল।
চুলের রাসায়নিক গঠন : চুলে ৯৭ শতাংশ প্রোটিন ও ৩ শতাংশ পানি থাকে। রাসায়নিক গঠন – কারবন ৪৫ শতাংশ, অক্সিজেন ২৮ শতাংশ, নাইট্রোজেন ১৫ শতাংশ, হাইড্রোজেন ৭ শতাংশ, সালফার ৫ শতাংশ।
চুলের ফলিকল : তথ্যাদি
‘ফলিকল’ শব্দের অর্থ একটি ক্ষুদ্র নিঃসরণকারী থলে বা গ্রন্থি। চুল ফলিকল দেহত্বক এর ঐ অংশ যাহা দেহত্বকের ডারমাল স্তরে অবস্থিত পুরাতন কোষসমূহকে একত্রিত করে চুলের জন্ম ঘটায়। চুল ফলিকল এর নীচের গোলাকার অংশ বাল্ব এবং উপরে তন্তুর ন্যায় অংশটি শাফট্। চুলে তিন ধরনের কোষ রয়েছে : কেরাটিন উৎপন্নকারী কেরাটিনোসাইট, মেলানিন রঞ্জক পদার্থ উৎপন্নকারী মেলেনোসাইট এবং সংক্রমণ প্রতিরোধকারী লাংগেরহান কোষ। চুল ফলিকেল সংবেদনশীল স্পর্শ রিস্পেটর হিসেবে কাজ করে এবং প্রতিটি চুলকে একটি চুল ফলিকেল ত্বকে নোংগরকৃত করে রাখে।
চুলের বাল্ব : তথ্যাদি

ইহা চুল ফলিকেল-এর নি¤œাংশে অবস্থিত বাল্ব আকৃতির অংশ। বাল্বে জীবিত কোষ রয়েছে যারা বিভক্ত হবার মাধ্যমে চুলের ফলিকলের বৃদ্ধি ঘটায়। কোষসমূহ রক্তনালী থেকে পুষ্টি এবং হরমোন পায় যার ফলে জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে চুলের বৃদ্ধি ঘটায়।
চুলে শাফট্ : চুলের শাফট হচ্ছে চুলের বৃদ্ধিহীন মৃত অংশ যাহা কেরাটিন কোষ দ্বারা গঠিত এবং যাহা চুল ফলিকেল থেকে বেড়ে উঠে ত্বকের এপিডার্মিস স্তরের বাইরে বেরিয়ে আসে এবং মাথার খুলির বাইরে দৃশ্যশান হয়। চুলের শাফট এ তিনটি স্তর রয়েছে : বাইরের স্তর কিউটিকেল, ভেতরের স্তর মেডালা এবং মধ্যবর্তী স্তর করটেক্স। কিউটিকেল এ আঁশের মতো চেপ্টা কোষ রয়েছে স্তরে স্তরে সাজানো। এরা চুলের ভেতরকার অঙ্গসমূহকে রক্ষা করে এবং চুলের মধ্যে অবস্থিত জলীয় অংশ নিয়ন্ত্রণ করে।
চুলের প্রকারভেদ : ক) আকার আকৃতি অনুযায়ী : দুই প্রকার : ভেলাস চুল – নাতিদীর্ঘ, সূক্ষ্ম, দেখা যায় না এমন, শরীরের প্রায় সর্বত্র জন্মে। টারমিনাল চুল – দীর্ঘ, মোটা; মাথা বা বোগল ইত্যাদি জায়গায় জন্মে। খ) দৈর্ঘ্য অনুযায়ী : তিন প্রকার : দীর্ঘ চুল, দাঁড়ি, গোফ, বোগলের কেশ, যৌনকেশ, ব্রিজল – নাকের শ্লেষ্মা, ঝিল্লী, চোখের ভ্রু ইত্যাদি। ফ্লফি Ñ শরীরের প্রায় পুরো পৃষ্ঠে জন্মে তবে দেখা যায় না এমন।

মাথার চুলের সংখ্যা : একজন মানুষের মাথায় গড়ে এক লাখ থেকে দেড় লাখ চুল থাকে এবং প্রতিটি চুল গড়ে ২ থেকে ৬ বছর পর্যন্ত বেঁচে থাকে। প্রতিদিন একজন ব্যক্তির প্রায় ১০০-১৫০ টি চুল পড়ে যায় এবং একই সময়ে একই সংখ্যক চুল আবার গজায়। তাই চুলের মোট সংখ্যা তুলনামূলকভাবে স্থির থাকে। হারিয়ে যাওয়ার চুলের জায়গায় ফলিকেল কোষগুলির প্রজননের ফলে নতুন চুল উপস্থিত হয়।
চুলের জীবনকাল ও বিকাশ চক্র : চুলের নিজস্ব বিকাশ চক্র এবং আয়ু থাকে বেশ কয়েকমাস থেকে ২-৬ বৎসর পর্যন্ত। এই চক্রের তিনটি পর্যায় রয়েছে। প্রথম পর্যায় এনাজেন চুল বা বাড়ন্ত চুল সাধারণত গড়ে ১০০০দিন পর্যন্ত বড় হতে থাকে। মাথার ৯০ শতাংশ চুল এনাজেন পর্যায়ে থাকে। দ্বিতীয় পর্যায় ক্যাটাজেন চুল বা বিবর্তনশীল চুল ১-২ সপ্তাহের জন্য বিবর্তিত হতে থাকে। তৃতীয় পর্যায় টেলোজেন চুল বা বিশ্রামে থাকা চুল সাধারণত গড়ে ১০০ দিন বিশ্রামে থাকে। এ সময় কিছু চুল পড়ে যায় এবং ঐসব ফলিকেল থেকে নতুন চুল গজায়। এভাবে নতুন চুলটি এনাজেন পর্যায়ে জন্ম নিয়ে জীবনচক্র শুরু করে। যদি সে সময় যে কোন কারণে টেলোজেন পর্যায় দীর্ঘতর হয় তবে চুল বেশী পড়বে। এছাড়া চুলের ফলিকেল শুকিয়ে গেলে নতুন চুল নাও গজাতে পারে। ১০ শতাংশ চুল টেলোজেন পর্যায়ে থাকে।
চুলের বৃদ্ধি : দৈনিক গড়ে ০.৪৪ মিমি বা অর্ধেক মিলিমিটার। মাসে ১৫ মিমি বা অর্ধেক ইঞ্চি। বৎসরে সর্বোচ্চ ৬ ইঞ্চি বড়ে।
চুলের কাজ : ১) ত্বকের সুরক্ষা দেয়া ২) শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করা ৩) ঘাম বাষ্পায়িত হওয়া নিয়ন্ত্রণ করা ৪) ইন্দ্রিয় অঙ্গের কাজ করা।
চুল পড়া সম্পর্কিত তথ্যাদি :

চুল পড়া কি? মাথা থেকে প্রতিদিন ১৫০টির বেশী চুল পড়তে থাকলে তখন চুল পড়াটা রোগের লক্ষণ হিসেবে ধরা হবে (আমেরিকান একাডেমী অব ডারমাটোলজিস্ট অনুযায়ী)।
মাথার যেখান থেকে চুল পড়ে : প্রাপ্ত বয়স্ক ছেলেদের ক্ষেত্রে মাথার মাঝখানের ও কপালের দুই পাশের। মেয়েদের ক্ষেত্রে মাথার উপরিভাগ ও দুপাশের।
টাক পড়া ও চুল পড়ার মধ্যে পার্থক্য : চুল আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে পড়ে গেলে তাকে চুল পড়া বলে। টাক বলতে চুলের অভাবকে বুঝায়। মাথার চুল ক্রমাগত হালকা হয়ে যাওয়ার মাধ্যমে টাক প্রকাশ পায়। চুলপড়া ধীরে ধীরে হয়। টাক পড়া এর চেয়ে দ্রুত হয়। চুল পড়া বেমানানভাবে হতে পারে। কিন্তু টাকের নির্দিষ্ট নমুনা রয়েছে। টাক সাধারণত কোন রোগের দ্বারা সৃষ্টি হয় না। এটা বয়সবৃদ্ধি, বংশগতি বা হরমোন পরিবর্তনের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। কিন্তু চুল পড়ার অনেক কারণ রয়েছে; বিবিধ রোগ, পরিচর্যার অভাব ইত্যাদি। টাকের ধরনের ক্ষেত্রে নারী ও পুরুষের মধ্যে ভিন্নতা দেখা যায়, কিন্তু চুল পড়ার ক্ষেত্রে লিঙ্গভেদে ভিন্নতা দেখা যায় না। তবে কারণের উপর ভিত্তি করে ভিন্নতা দেখা যায়।
টাক মানুষের সংখ্যা : পৃথিবীর প্রায় ৩০ শতাংশ মানুষের ত্রিশ বৎসরের মধ্যে মাথায় টাক দেখা যায়।
এশিয়ানদের টাক কম পড়ে কেন ? বিজ্ঞানীরা মনে করেন ডিএইচটি হরমোন তৈরীকারী এনজাইমগুলো এশিয়ান পুরুষে কম তৈরী হয় বিধায় তাদের চুল পড়ার হার ককেশিয়ানদের তুলনায় কম হয়।

উপসংহার : চুলপড়া রোগের রোগতত্ত্ব পাঠকদের কাছে বোধগম্য করার উদ্দেশে আজকের লেখায় চুল সম্পর্কিত তথ্যাদির বিশদ বিবরণ দিয়েছি। পরবর্তী লেখায় চুল পড়ার কারণ, প্রতিরোধ ও প্রতিকার সম্পর্কিত তথ্যাদি থাকছে।

ডা. হাসান শহীদুল আলম ডায়াবেটিস এবং চর্ম ও যৌনরোগে ¯œাতকোত্তর প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত চিকিৎসক, চট্টগ্রাম।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট