চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ১৮ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

সবুজ দর্শন, রাজনীতি ও রাষ্ট্র

৭ জানুয়ারি, ২০২০ | ২:০৬ পূর্বাহ্ণ

পরিবেশ অধ্যায়নে দুটি বহুল প্রচলিত ধারণা হলো মানুষকেন্দ্রিকতা ও পরিবেশ কেন্দ্রিকতা। দুটি ধারণাই বর্তমানে প্রচলিত আছে। তবে, আস্তে আস্তে মানুষকেন্দ্রিকতা থেকে পরিবেশকেন্দ্রিকতার দিকে সমাজতাত্ত্বিক ও পরিবেশবাদীরা ধাবিত হচ্ছেন। মানুষের পাশাপাশি এখন পরিবেশকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। পরিবেশ অধ্যায়নের প্রক্রিয়া ও এরসঙ্গে মানুষের সম্পর্ক বিনির্মাণে সবুজ দর্শনের ধারণা ও বিশ্লেষণ প্রয়োজন। এ কারণে সবুজ দার্শনিকরা পরিবেশ ও মানুষের মধ্যে সম্পর্ক স্থাপনের জন্য সূক্ষ্ম উপলব্ধিগুলো বিভিন্নভাবে বিশ্লেষণ করেছেন। এটি পরিবেশ সম্পর্কে মানবজাতির মানসিকতা ও চিন্তাধারার পরিবর্তন করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
সবুজ দর্শন বলতে সাদামাটাভাবে বলা যায়, এটি হলো এমন এক ধরনের দার্শনিক চিন্তা, যা পরিবেশ-বিষয়ক নৈতিকতা বিবেচনা করে। একইসঙ্গে মূল্য নির্ধারণ করে প্রকৃতির কাছে পরিবেশের নৈতিকতারও। সর্বোপরি সবুজ নৈতিকতার তাৎপর্য পরীক্ষা করে দেখে।
সবুজ দর্শনের মাধ্যমে সবুজ রাজনৈতিক তত্ত্বের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। এটি এমন একটি দার্শনিক চিন্তার প্রতিফলন ঘটাবে, যার মাধ্যমে এই দলবদ্ধ জনগোষ্ঠীর নৈতিক পরিবর্তন ঘটাবে। ফলে তাদের সঙ্গে পরিবেশ এক নতুন সম্পর্ক তৈরি করবে। এই দর্শনকে কার্যকর করার জন্য এমন এক ধরনের রাজনৈতিক নীতি-নির্ধারণী গোষ্ঠী তৈরি করতে হবে, যাদের বলা হবে, সবুজ রাজনৈতিক গোষ্ঠী। এর সঙ্গে সম্পৃক্তরা পরিবেশ সংক্রান্ত নিয়ম-নীতি প্রণয়নের পাশাপাশি এমন একটি রাষ্ট্রব্যবস্থা গঠন করবেন, যেখানে সবুজ দর্শন-রাজনীতির চর্চা ও পরিবেশ বিপর্যয় রোধে যুগান্তকারী ভূমিকা পালন করবে। সেখানে সাধারণ নাগরিকরাও সবুজ চিন্তাধারার চর্চা করবে। আর সবুজ রাজনৈতিক গোষ্ঠীকেও ক্ষমতায় বসাবে।
সবুজ দর্শন বা পরিবেশ দর্শনকে গভীরভাবে বিশ্লেষণ করতে হলে পরিবেশকেন্দ্রিকতা ও মানবকেন্দ্রিক ধারণার বিশ্লেষণ প্রয়োজন। পরিবেশের সঙ্গে মানবজাতির সম্পর্ক গঠনে একটি বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। ধরে নেওয়া হয় যে, মানুষ পরিবেশকে গুরুত্ব দেবে, না পরিবেশের ওপর মানুষের চাওয়া-পাওয়াকে গুরুত্ব দেবে, তা বিশ্লেষণ করার জন্যই পরিবেশকেন্দ্রিক ও মানবকেন্দ্রিক ধারণার জন্ম লাভ করে। মানবকেন্দ্রিকতার মূল অর্থ হলো, মানুষ ও তার আকাক্সক্ষাকে সবকিছুর ওপরে ভাবার একটি উপায়ের নাম। অর্থাৎ এ ধারণায় পরিবেশের তুলনায় মানুষের চাহিদা বা আকাক্সক্ষাকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হবে। অন্যদিকে, পরিবেশকেন্দ্রিক ধারণা বলতে মানুষকে পরিবেশের একটি অংশ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। মানুষ ও পরিবেশ এক অবিচ্ছেদ্য অনুসর্গ। এ ধারণায় শুধু মানুষের আকাক্সক্ষা বা ইচ্ছারই গুরুত্ব পায় না, সঙ্গে সঙ্গে মানুষ ছাড়া বাকি যে-সব প্রাণ আছে, তাদেরও গুরুত্ব উপলব্ধি করা হয়। তাই এমন একটি ব্যবস্থা প্রয়োজন, যেখানে এ ধরনের চিন্তাধারা, নিয়ম-নীতি ও আইন কানুন তৈরি করা হবে। যেখানে পরিবার থেকে শুরু করে সমাজ, রাজনীতি ও রাষ্ট্র সে ধরনের প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী চলবে, মানুষ ও পরিবেশকে সমান গুরুত্ব দেওয়া হবে।
সবুজ দর্শন ও সবুজ চিন্তাকে সঠিকভাবে বোঝার জন্য মানুষ ও পরিবেশের মূল্য কী হওয়া উচিত, তা বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন। কোনো বস্তু বা বিষয় কতটুকু মূল্যবান, তা নির্ভর করে ওই জিনিসটিকে সমাজ কতটুকু মূল্য দিতে প্রস্তুত, তার ওপর। এই মূল্য নির্ধারণে তিনটি ডাইমেনশন উল্লেখ করা যেতে পারে। প্রথমটি হলো, যন্ত্রের মূল্য। একটি যন্ত্রের মানের ওপর নির্ভর করে যন্ত্রটির মূল্যায়ন। কারণ যন্ত্র মানুষকে কাজ করতে সহায়তা করে। উদাহরণ হিসেবে একটি ওয়ার্ড প্রসেসর ব্যক্তির কাছে মূল্যবান হয়ে উঠতে পারে। কারণ এর সাহায্যে ব্যক্তি লিখতে পারে। আবার যদি লেখার প্রয়োজন না হয়, তাহলে এটি তার কাছে আপাতত মূল্যহীন। ওয়ার্ড প্রসেসর শুধু তাদেরই কাছে মূল্যবান, যারা এটি ব্যবহার করতে চান। দ্বিতীয় ডাইমেনশন হলো, কোনো কিছুর সহজাত মূল্য। এমন কিছু জিনিস আছে যার মূল্য সহজাত। কোনো কর্মের উপায় হিসেবে এটিকে মূল্যবান মনে করা হয় না। যেমন একটি সুন্দর প্রাকৃতিক দৃশ্য প্রকৃতিপ্রেমী বা সৌন্দর্যপিপাসুদের কাছে অনেক মূল্যবান, যদিও এটি সরাসরি ওয়ার্ড প্রসেসরের মতো সহযোগিতা করে না। এটি এমন একটি বিষয়, যা মানুষ স্বাভাবিকভাবেই মূল্যবান মনে করে। তৃতীয় ডাইমেনশনটি হলো, অন্তর্নিহিত মূল্য। অন্তর্নিহিত মূল্যের মৌলিক অর্থ হলো, সহজাতভাবে এটি মূল্যবান। এই মূল্য নির্ধারণ করার জন্য কোনো আবেদনের প্রয়োজন হয় না। যাদের কাছে এটি মূল্যবান তাদের কাছে সব সময় মূল্যবান। স্বাধীনভাবে যে কেউ এটিকে মূল্যবান মনে করবে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, মূল্য নির্ধারণের এ তিনটি পদ্ধতির মধ্যে পরিবেশের মূল্য কোন ক্যাটাগরিতে পড়ে? পরিবেশের মূল্য নির্ধারণের ক্ষেত্রে তিন ধরনের চিন্তাধারাই কার্যকর হতে পারে। কেউ মনে করতে পারেন যে, পরিবেশের শুধু যান্ত্রিক মূল্য রয়েছে। আবার অনেকে মনে করতে পারেন পরিবেশের সহজাত মূল্য আবার কারও কাছে পরিবেশের অন্তর্নিহিত মূল্য রয়েছে। যারা পরিবেশের শুধু যান্ত্রিক মূল্য নির্ধারণ করেন, তারা সঠিকভাবে পরিবেশ বা সবুজ দর্শনকে ভালোভাবে বুঝতে ও পরিবেশের মূল্য নির্ধারণ করতে পারেননি। তাদের কাছে পরিবেশ মূল্যবান যন্ত্রের মতো, যন্ত্র যে রকম যতক্ষণ উপকারে আসে, ঠিক ততক্ষণই মূল্যবান। আর যাদের উপকারে আসে, শুধু তাদের কাছে মূল্যবান। কিন্তু প্রকৃত অর্থে পরিবেশের মূল্য কোনো যান্ত্রিক মূল্য নয়। পরিবেশের মূল্য নির্ধারণ করতে হবে সহজাত ও অন্তর্নিহিতভাবে। সবার কাছে, স্বাধীনভাবে, সবাই পরিবেশকে মূল্য দিতে জানতে হবে। এটি হচ্ছে সবুজ দর্শনের মূল বক্তব্য।
যদি পরিবেশকে যন্ত্র মনে করা হয় এবং এর সহজাত ও অন্তর্নিহিত মূল্যকে অবহেলা করা হয়, তাহলে মানবসমাজ পরিবেশকে সেভাবে গুরুত্ব দেবে না। পরিবেশ বিপর্যয় করার কাজেই লিপ্ত থাকবে।
সবুজ দর্শন বা তত্ত্ব তৈরি করবে সবুজ সমাজ, সবুজ নাগরিক ও সবুজ সরকার, সর্বোপরি সবুজ তৈরি করবে। এই দর্শনের উপর ভিত্তি করে সবুজ চিন্তাধারা তৈরি করা যাবে, যে চিন্তাধারায় মেনে নেওয়া হয় যে, বর্তমান পরিবেশ সংকটের মৌলিক কারণ হচ্ছে মানুষের পরিবেশের প্রতি বিরূপ আচরণ। আর এই বিরূপ আচরণকে মানুষ সচরাচর বৈধতা দেয় তাদের স্বার্থের কথা চিন্তা করে। এখানে এটিকে বৈধতা দেওয়ার অন্যতম কারণ হচ্ছে মানুষকেন্দ্রিকতা। সবুজ দর্শন ও তত্ত্ব বা চিন্তাধারার মৌলিক যুক্তি মানুষকেন্দ্রিকতার বিরুদ্ধে। মানুষকেন্দ্রিকতায় বিশ্বাস করা হয় যে, কেবল মানুষের জন্য, মানুষকে কেন্দ্র করে, মানুষের প্রয়োজনে মহাবিশ্ব। একচেটিয়াভাবে মহাবিশ্বের কেন্দ্রস্থলে মানুষের আকাক্সক্ষাকে স্থাপন করা হয়েছে, যা পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর। সবুজ দর্শন ও চিন্তাধারায় তা সমর্থন করে না।
মানুষকেন্দ্রিকতায় মনে করা হয়, শুধু মানব সমাজেরই অন্তর্নিহিত মূল্য রয়েছে, সেজন্য তাদের আনন্দ-বেদনা, চাহিদা ও আকাক্সক্ষা ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়। এখানে পরিবেশের অন্তর্নিহিত মূল্যকে অস্বীকার করা হয়। মানুষ ছাড়া অবশিষ্ট প্রকৃতির যান্ত্রিক মূল্য নির্ধারণ রয়েছে বলে মানুষকেন্দ্রিক চিন্তাধারায় বিশ্বাস করা হয়। পরিবেশের অতটুকু মূল্যই স্বীকার করা হয়, যতটুকু পরিমাণ তারা মানবজাতির উন্নতি সাধন করতে সক্ষম। প্রকৃতি বা পরিবেশের যে একটি অন্তর্নিহিত মূল্য আছে বা সহজাত মূল্য আছে, তা এখানে অস্বীকার করা হয়। তাই সবুজ দর্শনের বক্তব্য হচ্ছে, মানুষের পাশাপাশি অন্যান্য প্রাণী ও প্রকৃতির সহজাত ও অন্তর্নিহিত মূল্যকে স্বীকার করতে হবে। মানুষের সঙ্গে পরিবেশের সম্পর্ক বিনির্মাণে সবুজ দর্শন ও সবুজ নৈতিকতা কাজ করবে। রাজনীতি হবে সবুজ, রাষ্ট্র হবে সবুজ, নাগরিকরাও হবে সবুজ। পরিবেশ ও মানুষ সমান গুরুত্ব নিয়ে একইসঙ্গে বসবাস করবো। তাহলে সবুজ দর্শন, সবুজ নৈতিকতা সফল হবে। তাতে ভালো থাকবে রাজনীতি, রাষ্ট্র থেকে শুরু করে বিশ্বও।

ড. মো. কামাল উদ্দিন অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয়।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট