চট্টগ্রাম বুধবার, ২৪ এপ্রিল, ২০২৪

পটিয়ায় চার গ্রামের পানি সংকট হাইকোর্টের ঐতিহাসিক রায় বাস্তবায়ন হোক

৭ জানুয়ারি, ২০২০ | ২:০৬ পূর্বাহ্ণ

পানির অপর নাম জীবন। পৃথিবীর অনেক দেশেই সুপেয় পানির অভাবে মানুষের কষ্টের কথা আমরা জানি। পৃথিবীতে মরুভূমি সৃষ্টি হয়েছে পানি সংকটের কারণে। কারবালা’র ট্র্যাজেডির ইতিহাসের সাথে জড়িয়ে আছে ফোরাত নদীর পানির ইতিহাস। আমাদের দেশের বিভিন্ন এলাকায়ও খাওয়ার পানির সংকটের কথা নতুন কিছু নয়। প্রাকৃতিক কারণে পানীয় জলের সংকটকে অনেকটা স্বাভাবিক বলেই ধরে নেয়া হয়। কিন্তু এক শ্রেণীর মুনাফালোভী ব্যবসায়ীর কারণে যখন কোন এলাকায় পানীয় জলের তীব্র সংকট দেখা দেয়-তা সহজে মেনে নেয়া যায় না। চট্টগ্রামের পটিয়া থানার ৮.৮ বর্গ কি.মি.-এর হাবিলাসদ্বীপ ইউনিয়নের ৪ গ্রামের (হুলাইন, হাবিলাসদ্বীপ, চরকানাই, পাঁচুরিয়া) প্রায় ৩০ হাজারের অধিক মানুষ আজ পানীয় জলের তীব্র সংকটের মুখে পড়ে হাহাকার করছে। আশেপাশের অনেক গ্রামেও-এর প্রভাব পড়ছে। এই যুগের শিল্পায়নের ঢেউ শহর ছাড়িয়ে গ্রামে আছড়ে পড়ার কারণে পটিয়ার হাবিলাসদ্বীপ ইউনিয়নেও কয়েকটি শিল্পগ্রুপ তাঁদের শিল্পপ্রতিষ্ঠান স্থাপন করেছে। এসব শিল্প প্রতিষ্ঠানের কারণে উক্ত এলাকায় একদিকে গ্রামের উপর দিয়ে বহমান ৩টি খালের পানি (আলম খাল, বোয়ালখালী খাল ও গরু লোটা খাল) মারাত্মক ভাবে দূষিত হচ্ছে, অন্যদিকে এসব শিল্পপ্রতিষ্ঠান অবৈধভাবে গভীর নলকূপ স্থাপন করে ভূ-গর্ভস্থ পানি উত্থোলনের কারণে এলাকার টিউবওয়েল সমূহে মারাত্মক পানি সংকট দেখা দিয়েছে। এলাকাবাসী কর্তৃক বিষয়টি তাঁদের দৃষ্টিগোচরে আনার পরও শিল্প প্রতিষ্ঠানসমূহের মালিকপক্ষ ভূ-গর্ভস্থ পানি উত্তোলন করা এবং শিল্পকারখানার বর্জ্য খালে ফেলা হতে ”বিরত থাকেনি”। ফলে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা) [ইধহমষধফবংয ঊহারৎড়হসবহঃ খধুিবৎ’ং অংংড়পরধঃরড়হ (ইঊখঅ)] ২০১৫ সনে মহামান্য হাইকোর্টে জনস্বার্থে মামলা দায়ের করেন (রীট পিটিশন নং ৪৪০/২০১৫)। মহামান্য হাইকোর্ট উল্লেখিত রীট পিটিশনের আলোকে ৮টি শিল্প-কারখানাকে গভীর নলকূপ দিয়ে পানি উত্তোলন বন্ধের নির্দেশ ও নিষেধাজ্ঞা প্রদান করেন এবং উক্ত শিল্প-কারখানার বর্জ্য ”খালে” ফেলা হতে বিরত থাকার জন্য রুল নিশিসহ অন্তর্বর্তীকালীন আদেশ প্রদান করেন। সম্প্রতি ২৮ নভেম্বর’২০১৯ তারিখে উচ্চ আদালত এ বিষয়ে চূড়ান্ত রায় প্রদান করেন। রায়ে মাননীয় হাইকোর্ট বাংলাদেশ সরকারের পানিসম্পদ মন্ত্রাণালয়, কৃষি, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়, পরিবেশ অধিদপ্তর, জেলা প্রশাসক, পটিয়া উপজেলা চেয়ারম্যানসহ ৯টি সরকারি বিভাগ/অফিস’কে উক্ত এলাকায় নিয়মিত খাবার পানি ও গৃহস্থলী পানি সরবরাহের নির্দেশ দিয়েছেন। এবং উক্ত চার গ্রামকে (হুলাইন, হাবিলাসদ্বীপ, চরকানাই, পাঁচরিয়া) পানি আইন ২০১৩-এর ১৭ নং ধারা মোতাবেক ”পানি সংকট এলাকা” (ডধঃবৎ ঝঃৎবংং অৎবধ) ঘোষণার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দিয়েছেন।

উল্লেখ্য যে, ২০১৩ সনের পানি আইনে গুরুত্বের দিক থেকে খাবার পানি ও গৃহস্থলী পানিকে যথাক্রমে ১ ও ২ নম্বর ক্রমিকে এবং শিল্পের জন্য প্রয়োজনীয় পানিকে ৯ নম্বর ক্রমিকে স্থান দেয়া হয়েছে। রায়ে মাননীয় হাইকোর্ট উক্ত এলাকায় পানীয় জলের জন্য কতফুট গভীরে যাওয়া যাবে অর্থাৎ পানির ”সেইফ লেবেল” কতটুকু হবে-তার নির্দেশনা দানের জন্য সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দিয়েছেন।

স্মরণযোগ্য যে, শিল্প কারখানা কর্তৃক গভীর নলকূপের সাহায্যে পানি উত্তোলনের কারণে উক্ত গ্রামসমূহে পানির স্তর যত নীচে যাচ্ছে, মানুষও তত গভীরে গিয়ে পানি উত্তোলন করছে। কিন্তু এটা তো প্রকৃত পক্ষে সমাধান নয়। পানি তোলা বন্ধ করলে বর্ষা মৌসুমের পর আবারও পানি স্বাভাবিক স্তরে চলে আসবে। আমাদের দেশের শহরাঞ্চলেও এই অপসংস্কৃতি বিরাজমান। প্রতি বছর শহরে জলাবদ্ধতা হয়, আর রাস্তা উঁচু হয়। রাস্তা উঁচু করে এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি করা হয় যে, ভবনের নীচতলা অবরুদ্ধ হয়ে যায়। অথচ খাল
খনন করে এবং প্রশস্ত ড্রেন তৈরী করে পানি যাওয়ার পথ খুলে দিলে জলাবদ্ধতা কমে যাবে-এই বিষয়টি কারও মাথায় আসে না। যানজটের ব্যাপারেও একই কথা প্রযোজ্য। যানজট হলে ফ্লাইওভারকে সমাধান মনে করা হচ্ছে। অথচ ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা উন্নত করে রাস্তা-ফুটপাত হতে অবৈধ দখলমুক্ত করে-সহজে যানজট নিরসনের বিষয়টি কারও মাথায় আসে না।

হাইকোর্টের রায়ে পরিবেশ অধিদপ্তর, ঢাকা ও চট্টগ্রাম অফিসকে সংকট নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত শিল্প কারখানার ছাড়পত্র ইস্যু না করার নির্দেশ দিয়েছেন। এবং পানি আইনের ১৩ ধারা অনুযায়ী পানি সংকট এলাকা ঘোষণার বিষয়টি নিষ্পত্তি না হওয়ায় পানি উত্তোলন বন্ধ রাখার নির্দেশ দিয়েছেন। রায়ে অন্যান্য যে সব নির্দেশনা ও পর্যবেক্ষণ দেয়া হয়েছে তা হলো- পরিবেশ অধিদপ্তর শিল্প প্রতিষ্ঠানসমূহে পানি শোধনের জন্য ইটিপি ব্যবহার করছে কিনা তা ”নিয়মিত মনিটরিং করবে”, যে সব প্রতিষ্ঠান ইটিপি ব্যবহার করবে না তাদের ”লাল ক্যাটাগরিতে” স্থানান্তর করে বন্ধ করে দিতে হবে, পানি সংকটের কারণে ক্ষতি নির্ধারণ করে ক্ষতিপূরণ আদায় করতে হবে, তিন মাসের মধ্যে পরিবেশ অধিদপ্তরকে অফিসিয়াল মেমো ইস্যু করে যাবতীয় নির্দেশনা, পর্যবেক্ষণ ও পরামর্শ বাস্তবায়ন করতে হবে।
আমরা মনে করি, মহামান্য হাইকোর্টের এই রায়-দেশের পরিবেশ ও পানি আইনের জন্য একটি ঐতিহাসিক ও যুগান্তকরী রায়। এক শ্রেণীর লোভী মানুষ টাকার জন্য নদী-নালা-খাল-বিল-রাস্তা ঘাট-ফুটপাত-পুকুর সব দখল করে বসে থাকে। অথচ যাদের দেখার কথা-তাঁরা চোখ বুঝে থাকে।
বর্তমানে পটিয়ার চারটি গ্রামের মানুষ খাওয়ার পানির জন্য যে কষ্ট পাচ্ছে, তা যদি পরিবেশ অধিদপ্তর ও স্থানীয় প্রশাসন শুরুতে নজরদারি করতো, তাহলে এই ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হতো না। পাঁচ বছর পূর্বেও যেখানে ৪/৫শ ফুট গভীরে পানি পাওয়া যেতো, আজ সেখানে ১২/১৩শ ফুট গভীরে গিয়েও পানি পাওয়া যাচ্ছে না। এ অবস্থা চলতে থাকলে হয়তো আগামী ২/৩ বছরে সম্পূর্ণ এলাকা মরুভূমিতে পরিণত হবে।

৩০ হাজার মানুষের আর্তনাদ শিল্পপতিদের মনে সামান্যতমও করুণা সৃষ্টি করেনি। তাঁদের শিল্প কারখানা হতে নিঃসৃত বর্জ্য ফেলে ৩টি খালের পানি সম্পূর্ণ নষ্ট করে ফেলা হয়েছে। সেই পানি কর্ণফুলি নদীতে গিয়ে মাছসহ বিভিন্ন প্রজাতির জলজ প্রাণী শূন্য হচ্ছে নদী। অথচ তাঁদের সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নাই। শিল্পপতিরা কয়েকশ কোটি দামের শিল্প কারখানা প্রতিষ্ঠা করেন, কিন্তু কয়েক লক্ষ টাকা মূল্যের পানি শোধনের ”ইটিপি” স্থাপন করতে পারেন না। এধরণের মানসিকতা অবশ্যই নিন্দনীয়। সবই হতে হবে পরিবেশ সম্মত উপায়ে।
ব্যবসায়ীদের যেমন বৈধভাবে ব্যবসা করার অধিকার আছে, তেমনি জনগণেরও নিরুপদ্রব্য বসবাসের অধিকার রয়েছে। বরং জনঅধিকারের গুরুত্ব একশগুন বেশী।
আমরাও চাই গ্রামে শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠুক, মানুষের কর্মসংস্থান হোক, কিন্তু তা হতে হবে শিল্প আইন, পরিবেশ আইন ও পানি আইন যথাযথভাবে মেনে। শিল্প-কারখানা হতে নির্গত বর্জ্য, ধোঁয়া ও বিকট শব্দে যেন পরিবেশ ধ্বংস না হয় এবং সেইফ লেবেলের অতিরিক্ত গভীরে গিয়ে ভূগর্ভস্থ পানি যেন উত্তোলন করা না হয়-এ বিষয়গুলো পরিবেশ অধিদপ্তর ও স্থানীয় প্রশাসনকে অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে। শিল্প-কারখানা দ্বারা পরিবেশের ক্ষতি হবে না এবং পানির উৎস কী হবে-তা নিশ্চিত হওয়ার পরই কেবল যেনো পরিবেশ অধিদপ্তর ছাড়পত্র ইস্যু করেন।

পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র প্রদানে অনেক অনিয়ম বা অবৈধ লেনদেনের কথা আমরা শুনে থাকি। আমরা আশা করবো আগামীতে সবাই এ ব্যাপারে সতর্ক হবেন। মহামান্য হাইকোর্টের প্রতিটি নির্দেশ-পরামর্শ-পর্যবেক্ষণ সরকারের সংশ্লিষ্ঠ বিভাগসমূহ অক্ষরে অক্ষরে পালন করবেন এবং অনতিবিলম্বে রায়ের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে আলোচ্য ৪টি গ্রামে পানীয় ও গৃহস্থলী জল সরবরাহের উদ্যোগ নেবেন-এমনটিই আমরা প্রত্যাশা করি।

মুহাম্মদ মুসা খান কলামিস্ট সমাজকর্মী।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট