চট্টগ্রাম বুধবার, ২৪ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

বিশাল ধর্মীয় কমপ্লেক্স নিয়ে শায়িত ছারছীনার পীর ছাহেব (রহ.)

আহমদুল ইসলাম চৌধুরী

৬ জানুয়ারি, ২০২০ | ২:৫৭ পূর্বাহ্ণ

বৃহত্তর বরিশালের বিখ্যাত এলাকার নাম ছারছীনা। ঐ অজপাড়াগাঁয়ে শরীয়ত ও তরিকতের প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করে যাত্রা শুরু করেন হযরত মাওলানা শাহ সুফি নেছারুদ্দীন আহমদ (রহ.)। বরিশাল শহর থেকে প্রায় ৩০ কি.মি দূরত্বে ১ বর্গ কি.মি এলাকা জুড়ে বর্তমানকালের ছারছীনা মাদ্রাসা কমপ্লেক্সটির বিশালত্ব স্বচক্ষে না দেখলে বিশ্বাস করতে কষ্ট হতে পারে। এই মহান ওলি ১২৭৯ বাংলায় তথা ১৮৭৩ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম হাজী সদর উদ্দিন। মাতার নাম জহুরা বেগম। তিনি ১২ বছর যাবৎ পিতা-মাতার নিকট থেকে দ্বীনি শিক্ষা গ্রহণ করেন। অতঃপর মাদারীপুর মাদ্রাসায় ভর্তি হন। এরপর কিছু দিন ঢাকায় থাকেন। অতঃপর কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসায়,এরপর হুগলি মোহসেনিয়া মাদ্রাসায় ভর্তি হয়ে লেখাপড়া করেন। ১৮৯৬ খ্রিস্টাব্দে মাদ্রাসা শিক্ষায় সর্বোচ্চ শিক্ষা লাভ করেন। ছাত্র অবস্থায় হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রহ.)’র হাতে তরিকতে দাখিল হন। দীর্ঘ ৪০ বছর তিনি মুর্শিদের কাছে থেকেছেন এবং খেলাফত লাভ করেন।

নিজের পীর হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রহ.) প্রথমবার ছারছীনায় তাশরীফ আনলে, নিজের মুরিদ তথা খলিফাকে উপদেশ দিলেন এখানে মাদ্রাসা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠা করার জন্য। ফলে ১৯১৫ খ্রিস্টাব্দে প্রায় ৩০/৪০ ফুট লম্বা একটি গোলপাতার ছাউনি বিশিষ্ট ঘর নির্মাণ করেন। প্রথম তারিখে ৩০/৪০ জন ছাত্র হাজির হয়। এখানে ধর্মীয় শিক্ষা চালু হয়ে যায়। পরবর্তীতে তথা ১৯১৮ খ্রিস্টাব্দে কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসা সিলেবাস অনুযায়ী জামাত নিয়মে তালিম শুরু হয়। মাদ্রাসার নামকরণ করা হয় ছারছীনা দারুস সুন্নাহ আলিয়া মাদ্রাসা। ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দ তথা ১৩৪০ হিজরি সনে গোল পাতার ছাউনী বিশিষ্ট মাদ্রাসাকে ৫০/৬০ ফুট আরও বর্ধিত করে পাকা দালান নির্মাণ করা হয়। ১৯২০ খ্রিস্টাব্দে নির্মাণ করা হয় মসজিদ। ১৯২৭ খ্রিস্টাব্দে সওম পর্যন্ত সরকারী মঞ্জুরী লাভ করে। ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দে জামাতে উলা খোলা হয়। সেন্টার পরীক্ষার মঞ্জুরীও হয়। ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দে জামাতে উলার স্থায়ী মঞ্জুরী পাওয়া যায়। ঐ সময় ছাত্রসংখ্যা বেশি হওয়ায় বিভিন্ন স্থান ভরাট করে বৃহদাকারের টিনসেড ঘর নির্মাণ করা হয়। ১৯৩১ খ্রিস্টাব্দে ১২০/১৩০ ফুট বিশিষ্ট মাদ্রাসা ভবন নির্মাণ করা হয়। এতে ঐ সময় সরকারী পরিদর্শক প্রতিকূল এরিয়ায় মাদ্রাসা শিক্ষার জন্য এত আয়োজন দেখে অবাক হয়ে যায়। ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দে তিনতলা বিশিষ্ট এল আকৃতির বিশাল মাদ্রাসা দালান নির্মাণ করা হয়। নামকরণ করা হয় আবু বকর সিদ্দিক হল। ১৯৩৮ খ্রিস্টাব্দে টাইটেল খোলা হয়। যেহেতু বাংলায় এ অঞ্চলে কোথাও টাইটেল মাদ্রাসা ছিল না। তাই টাইটেল মঞ্জুরী দেওয়ার পূর্বে ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দে অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী শেরে বাংলা এ, কে ফজলুল হক এবং ব্রিটিশের গভর্নর জন হাভার্ড মাদ্রাসা পরিদর্শনে আসেন জাহাজ যোগে। উল্লেখ্য হযরত পীর ব্রিটিশ গভর্নরের স্ত্রীকে স্বামীর সাথে মাদ্রাসায় আসার অনুমতি দেননি। একাধিকক্রমে ৭ বছর চেষ্টার ফলে ১৯৪৪ খ্রিস্টাব্দে টাইটেল/কামিল পূর্ণাঙ্গ মঞ্জুরী পাওয়া যায়।

১৯১৫ খ্রিস্টাব্দে থেকে বাংলা ১৪, ১৫ ও ১৬ অগ্রহায়ণ তিনদিনব্যাপী বার্ষিক মাহফিলের তারিখ নির্ধারিত হয়। দ্বিতীয় বার ২৭, ২৮ ও ২৯ ফাল্গুন নির্ধারিত হয়। অর্থাৎ এখানে বার্ষিক দু’বার মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়।

১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দে দুর্ভিক্ষের সময় তিনি লাঙ্গরখানা খুলে রান্না করে খাবার পরিবেশন করতেন। ২য় বিশ্বযুদ্ধের সময় মক্কা শরীফে দুর্ভিক্ষ দেখা দিলে ঐ সময় ৭৩ হাজার টাকা পাঠিয়ে দেন বাদশাহ আবদুল আজিজের নিকট। তিনি মদিনা শরীফে মুসাফিরখানা প্রতিষ্ঠা করেন। বাদশাহ আবদুল আজিজ আর্থিক প্রতিকূল অবস্থায় সাহায্য পেয়ে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে পত্র প্রেরণ করেন। শুধু তাই নয়, তিনি মাসে ১ হাজার টাকা তথায় করে পাটান। শেরে বাংলা এ,কে ফজলুল হক প্রথম দিকে মাদ্রাসা কমিটির সভাপতি ছিলেন। পীর ছাহেব কেবলা ৩০ বছর বয়সে নিজ স্ত্রী, পুত্র, মাতা, ভগ্নিসহ ১৩০৮ বাংলা তথা ১৯০১ খ্রিস্টাব্দে হজ্বব্রত পালনের উদ্দেশ্য গমন করেন। ঐ সময় তথায় তিনি ৩ বছর অবস্থান করেন। জীবনে ৭২ বছর বয়সে ১৩৬৫ বাংলা তথা ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দে ১৪০১ জনের সহযাত্রী নিয়ে হজ্বব্রত পালন করতে গিয়েছিলেন।
হযরত পীর ছাহেব কেবলা ১ ফেব্রুয়ারী ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দে ১৩৫৮ বাংলা সনে ইন্তেকাল করেন। মাদ্রাসা জামে মসজিদ সংলগ্ন তাঁকে সমাহিত করা হয়। তাঁর যোগ্য উত্তরসুরী হযরত মাওলানা শাহ আবু জাফর মুহাম্মদ ছালেহ (রহ.) পিতার রেখে যাওয়া শরীয়ত ও তরিকতের হাল ধরেন। তাঁরই যোগ্য নেতৃত্বে ছারছীনা মাদ্রাসাসহ শরীয়ত ও তরিকতের খেদমত আঞ্জাম দিতে থাকেন। প্রায় ১ কি.মি এরিয়া নিয়ে দেশের আপামর জনগণের দানে কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে এই বিশাল দৃষ্টিনন্দন ইসলামী কমপ্লেক্স সগৌরবে দাঁড়িয়ে রয়েছে। ২৫০০ জন ছাত্র হোস্টেলে থেকে এই মাদ্রাসায় লেখাপড়া করে। স্বচ্ছল পরিবারের শিক্ষার্থীদের পৃথক ব্যবস্থা আছে। সরকারী ও বেসরকারী তথা আলিয়া ও দ্বীনিয়া নামকরণে এই মাদ্রাসা দুই ভাগে বিভক্ত। হাসপাতাল, কম্পিউটার বিভাগ, কারিগরি শিক্ষাসহ শিক্ষাবিষয়ক নানা শাখা-প্রশাখা রয়েছে। মাদ্রাসার অভ্যন্তরে রয়েছে ব্যাংক ও পোস্ট অফিস। তাদের সুন্দর ব্যবস্থাপনার পাশাপাশি নানান মাহফিলের ব্যবস্থা রয়েছে।

হযরত মাওলানা আবু জাফর মুহাম্মদ ছালেহ (রহ.) ১৯১৫ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন ১৯৯০ খ্রিস্টাব্দে ৭৫ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন। অতঃপর তাঁরই সুযোগ্য উত্তরসুরী হযরত মাওলানা শাহ সুফি মুহাম্মদ মোহেব্বুল্লাহ (জন্ম ১৯৫০) পিতার যাবতীয় কর্মকান্ডের নেতৃত্বে এগিয়ে আসেন। তিনি আজ অবধি দেশে-বিদেশে পিতা ও দাদার রেখে যাওয়া শরীয়ত ও তরিকতের প্রতিষ্ঠানসমূহ নেতৃত্ব দিয়ে চলেছেন। তিনি বছরে একাধিক বার চট্টগ্রাম সফর করেন। সে লক্ষ্যে চট্টগ্রামে ছারছীনা তরিকতপন্থিরা বিশাল বিশাল মাহফিলের আয়োজন করেন। বিশেষ করে লালদীঘি মাঠে ও জমিয়তুল ফালাহ জাতীয় মসজিদ ময়দানে চট্টগ্রাম কমিটি বাৎসরিক মাহফিলের আয়োজন করে থাকে।
গত ২০১০ খ্রিস্টাব্দে ১৪ সেপ্টেম্বর যেয়ারতের পাশাপাশি অতিথি হয়ে এ বিশাল তরিকতের জংশনে যাওয়ার সুযোগ হয়। দুপুর ১২ টার দিকে কয়েকজন সহযাত্রী নিয়ে এখানে পৌঁছলে হযরত পীর ছাহেব কেবলা আমাদের স্বাগত জানান। রমজানের ঈদের ৩/৪ দিন পর বিধায় হযরত পীর ছাহেব শাহ সুফি মাওলানা মুহাম্মদ মহিব উল্লাহ শাওয়ালের রোজা ছিলেন। তারপরও আমাদের তথা মেহমানের সম্মানার্থে তিনি দুপুরের খাবারে আমাদের সাথে বসে সময় দেন। মেহমান খানায় সুন্নতমতে দস্তরখানা দিয়ে ৮/১০ আইটেমের মাছ মাংস নিয়ে আতিথেয়তা মেহমানের প্রতি সম্মান প্রদর্শনে আল্লাহর রাসূল (স.)’র সুন্নতের বহিঃপ্রকাশ দেখিয়ে আমাদেরকে অভিভূত করেন। তথায় পৌঁছার সাথে সাথে চা নাস্তার আতিথেয়তা ত ছিলই।

তাঁর অসুস্থতাহেতু তাঁরই যোগ্য সন্তান হযরত মাওলানা শাহ আবু নছর নেছার উদ্দীন হোসাইন দীর্ঘক্ষণ সময় নিয়ে মাদ্রাসা কমপ্লেক্স ঘুরে ফিরে দেখান। তথায় জানতে পারলাম নদীমাতৃক বরিশালে সেকালে প্রতিকূল যোগাযোগ ব্যবস্থায়ও আজ পর্যন্ত যে সমস্ত ব্যক্তিরা মাদ্রাসা পরিদর্শন করেন তারা হল- ব্রিটিশ গভর্নর, পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট, মন্ত্রী, গর্ভনর এবং স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ, স্পীকার আবদুল ওহাব খান, দেবল শরীফের পীর শাহ মাওলানা আবদুল মজিদ, লিবিয়ার রাষ্ট্রদূত আলী হোসাইন আল-গাদামদী, প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান, প্রেসিডেন্ট বিচারপতি আবদুস ছাত্তার, প্রেসিডেন্ট হোসাইন মুহাম্মদ এরশাদ, মাওলানা আবদুর রশিদ তর্ক বাগীশ, প্রধানমন্ত্রী শাহ আজিজুর রহমান, ধর্মমন্ত্রী এম.এ.মন্নান, যোগাযোগ মন্ত্রী আনোয়ার হোসেন মঞ্জু প্রমুখ।
বস্তুতঃ ছারছীনার কঠোর শরীয়তের ভিতর তরিকতের দরবার। প্রায় ১ বর্গ কি.মি এরিয়া নিয়ে ১০/১২ টি বিশাল বিশাল চারতলা বিশিষ্ট দালান। প্রতিটির দৈর্ঘ্য প্রায় ১৫০/২০০ ফিট হবে। তার উপর রয়েছে কয়েকতলা বিশিষ্ট প্রকান্ড জামে মসজিদ।

জামে মসজিদের উঠানে বিশ্বখ্যাত এ বিশাল ইসলামী জংশনের প্রতিষ্ঠাতা হযরত আলহাজ্ব শাহ মাওলানা নেছার উদ্দীন (রহ.) শায়িত। আরও শায়িত যোগ্য সন্তান তথা উত্তরসুরী হযরত শাহ মাওলানা আবু জাফর মুহাম্মদ ছালেহ (রহ.) এবং তাঁদের পরিবারবর্গ।
ছারছীনা দরবার কড়া শরীয়তের উপর তরিকতে সুন্নীয়তে বিশ্বাসী। তাঁদের শরীয়তের দৃষ্টিভঙ্গি এত কঠোর যে, এখানে কোন নারীনেত্রীর আগমন আজও ঘটেনি। বাংলার ব্রিটিশ গভর্নর জাহাজে করে এ দরবারের ঘাটে এসেছিলেন। কিন্তু তার স্ত্রীকে দরবারে আসতে অনুমতি দেননি।

স্ত্রীকে জাহাজে রেখে গভর্নর এসেছিলেন বলে জানা যায়। আজও বাংলাদেশের কোন নারীনেত্রীর এ দরবারে আগমন ঘটেনি। যা ভাববার বিষয়।
তাদের প্রতিষ্ঠিত রয়েছে হাজারের মত মসজিদ, খানকাহ, এতিমখানা, হেফজখানা, সরকারী বেসরকারী মাদ্রাসা। তৎমধ্যে আলিয়া তথা কামিল মাদ্রাসাগুলোর মধ্যে পাংগাসিয়া নেছারিয়া আলিয়া মাদ্রাসা, গুদিঘাটা ছালেহিয়া আলিয়া মাদ্রাসা, মোকানিয়া আলিয়া মাদ্রাসা, ঢাকা নেছারিয়া আলিয়া মাদ্রাসা, কুড়িগ্রাম নেছারিয়া আলিয়া মাদ্রাসা, চট্টগ্রাম নেছারিয়া আলিয়া মাদ্রাসা, মাদারীপুর আহমদিয়া আলিয়া মাদ্রাসা উল্লেখযোগ্য।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট