চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

সর্বশেষ:

শব্দদূষণ প্রতিরোধে চাই জনসচেতনতা

আকাশ ইকবাল

৬ জানুয়ারি, ২০২০ | ২:৫৭ পূর্বাহ্ণ

বাংলাদেশে পরিবেশ দূষণের কোনো শেষ নেই। পরিবেশ দূষণ বর্তমানে এক অসহনীয় মাত্রায় পৌঁছেছে। নানাভাবে আমাদের পরিবেশ দূষিত হচ্ছে। কিছু কিছু দূষণের মাত্রা অতিরিক্তও ছাড়িয়ে গেছে। আমাদের দেশে পরিবেশ দূষণের মধ্যে অন্যতম একটি শব্দদূষণ। এই শব্দদূষণ নানাভাবে হচ্ছে। লাগাম টানার যেন কেউ-ই নেই। ২০১৫ সালে বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দূষণ ও পরিবেশগত ঝুঁকির কারণে যেসব দেশ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত তার একটি বাংলাদেশ।

বাংলাদেশে শব্দদূষণ এক নীরব ঘাতকে পরিণত হয়েছে। বর্তমানে শহরের শব্দদূষণ যে পর্যায়ে অবস্থান করছে তা খুবই আশংকাজনক। শব্দদূষণের এই সমস্যা এখন শুধু মাত্র রাজধানী ঢাকায় নয়, দেশের প্রায় সব বিভাগীয় শহরেও রয়েছে। এই সময় শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণে আনা খুব দরকার। শব্দদূষণ নিয়ে ডয়চে ভেলের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঢাকা শহরে শব্দদূষণ যে মাত্রায় পৌঁছেছে তা যদি এখন নিয়ন্ত্রণ করা না যায় তাহলে আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে ঢাকার মোট জনসংখ্যার তিন ভাগের এক ভাগ কানে কম শুনবে! এই আশঙ্কা শুধু মাত্র ঢাকা শহরের জন্য নয়। এই আশঙ্কা পুরো বাংলাদেশের প্রায় সব শহরের মানুষের জন্যেও। সুতরাং এখনই আমাদের সচেতন হওয়ার সময়। শব্দদূষণ বন্ধে বাংলাদেশের সংবিধানে একটি আইনও করা হয়েছিল। বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫-এর ক্ষমতাবলে শব্দদূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা-২০০৬ প্রণয়ন করা হয়। বিধিমালার আওতায় নীরব, আবাসিক, মিশ্র, বাণিজ্যিক ও শিল্প এলাকা চিহ্নিত করে শব্দের মানমাত্রা নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে।

আইন অমান্য করলে প্রথমবার অপরাধের জন্য একমাস কারাদ- বা অনধিক পাঁচ হাজার টাকা অর্থদ- বা উভয় দ- এবং পরবর্তী অপরাধের জন্য ছয় মাস কারাদ- বা অনধিক ১০ হাজার টাকা অর্থদ- বা উভয় দ-েই দ-িত হওয়ার বিধান রয়েছে।

কিন্তু এরপরও শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হচ্ছে না। কারণ, আইন থাকলেও আইনের প্রয়োগ নেই।
বাংলাদেশে শব্দদূষণের বেশ কয়েকটি কারণের মধ্যে অন্যতম হলো- গাড়ির হর্ন ও মাইকের ব্যবহার। তবে এর বাইরে রাজনৈতিক, সামাজিক এবং ধর্মীয় অনুষ্ঠানে উচ্চশব্দে মাইক বা সাউন্ড সিস্টেম ব্যবহার আর একটি বড় কারণ। যদি ইনডোর শব্দদূষণের দিকটি বিবেচনায় নেই তাহলে টাইলস লাগানো, মিউজিক সিস্টেমে জোরে গান বাজানো, ড্রিলিং এগুলোর শব্দ রয়েছে। গাড়ির হর্ন ছাড়াও আমরা বিভিন্নভাবে মাইকের ব্যবহার করে থাকি। দেখা যাচ্ছে, শব্দদূষণ মানুষেরই তৈরি। প্রয়োজন জনসচেতনতা। কিন্তু কোনোভাবেই মানুষকে সচেতন করা যাচ্ছে না। আর এর জন্য প্রয়োজন আইন। শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে সরকার আইনও করেছে। এই আইন প্রয়োগের জন্য যাদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে তাদের কোন খবর নেই। কর্তৃপক্ষ সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করছে না। ফলে সমস্যার সমাধানও হচ্ছে না। বরং সমস্যার মাত্রা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।
গত বছর পরিবেশ অধিদপ্তরের একটি জরিপে উঠে এসেছে, মাত্রাতিরিক্ত শব্দের কারণে ইতোমধ্যে দেশের প্রায় ১২ শতাংশ মানুষের শ্রবণশক্তি হ্রাস পেয়েছে। এর সাথে যোগ হয়েছে উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ, ফুসফুসজনিত জটিলতা, মস্তিষ্ক বিকৃতি, স্মরণশক্তি হ্রাস ও মানসিক চাপসহ বিভিন্ন স্বাস্থ্য সমস্যা।
চলতি বছরের প্রথম দিকে বেসরকারি সংস্থা ‘ওয়ার্ক ফর এ বেটার বাংলাদেশ ট্রাস্ট’ ঢাকা শহরের ১০টি স্থানের শব্দ পরিমাপ করেছে। পরিমাপে তারা দেখে, ঢাকায় নির্ধারিত মানদ-ের চেয়ে গড়ে প্রায় দেড় গুণ থেকে আড়াইগুণ বেশি শব্দ সৃষ্টি হয়। এছাড়া জরিপে দেখা গেছে, উত্তরার শাহজালাল অ্যাভিনিউতে শব্দ মাত্রা সর্বোচ্চ ৯৩ দশমিক ৫ ডেসিবেল, মিরপুর-১ এ সর্বোচ্চ ৯৬ ডেসিবেল, পল্লবীতে সর্বোচ্চ ৯১ দশমিক ৫ ডেসিবেল, ধানমন্ডি বালক বিদ্যালয়ের সামনে সর্বোচ্চ ১০৭ দশমিক ১, ধানমন্ডি ৫ নম্বর সড়কে সর্বোচ্চ ৯৫ দশমিক ৫, নিউমার্কেটের সামনে সর্বোচ্চ ১০৪ দশমিক ১, শাহবাগে সর্বোচ্চ ৯৭ দশমিক ৩ এবং সচিবালয়ের সামনে সর্বোচ্চ ৮৮ ডেসিবেল। এটা ঢাকা শহরের পরিমাপ হলেও চট্টগ্রামে শব্দ এর চেয়ে কম হয় না।

স্যার সলিমুল্ল্যাহ মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের নাক, কান ও গলা বিভাগের প্রধান ডা. মনি লাল আইচ লিটু শব্দ দূষণের প্রভাব সম্পর্কে বলেন, শব্দ দূষণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় শিশু ও বয়স্করা। এমনকি গর্ভে থাকা সন্তানও শব্দদূষণে ক্ষতির শিকার হয়, অর্থাৎ তাদের শ্রবণশক্তি খুব দ্রুত নষ্ট হয়ে যায়।
বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনা আরেকটি বড় সমস্যা। সারা বাংলাদেশে প্রতিদিন গড়ে তিন জন মানুষ সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যায়। মনে হয়তো প্রশ্ন জাগতে পারে আলোচনার মাঝখানে সড়ক দুর্ঘটনার বিষয় টেনে আনলাম কেন? সত্যিকথা বলতে কি সড়ক দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ শব্দ দূষণ-ই। আপনার মনে হবে হয়তো সড়ক দুর্ঘটনার কারণ চালক আর পথচারির অসচেতনতায় ঘটে। কিন্তু গবেষণায় দেখা গেছে, বিশেষ করে শহরে সড়ক দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ অতিরিক্ত শব্দ দূষণ।
সড়ক দুর্ঘটনায় শব্দ দূষণের কারণ সম্পর্কে গবেষক ও ডাক্তাররা বলছেন, শব্দ দূষণে মেজাজ খিটখিটে হয়, মনোযোগ নষ্ট হয় এবং স্মরণ শক্তিও কমে যায়। শব্দের সর্বোচ্চ গ্রহণযোগ্য মাত্রা ৫০ ডেসিবেল, সেখানে ঢাকা শহরের বেশিরভাগ এলাকায় এখন শব্দের সার্বক্ষণিক গড় মাত্রা ১০০ ডেসিবেল। এতে মানুষের মেজাজ খিটখিটে হওয়া অস্বাভাবিক কিছু না।

শব্দ দূষণ প্রতিরোধের লক্ষ্যে যে বিধিমালা প্রণয়ন করা হয়েছে সেটা রয়েছে শুধু মাত্র কাগজে কলমে। দূষণটি প্রতি বছর অনেক মানুষের মৃত্যুর কারণ। সত্যিকার অর্থে শব্দ দূষণ নিয়ে কর্তৃপক্ষ কোনো মাথা ঘামাচ্ছে না। এর মাত্রা ছড়িয়ে যাওয়ার পেছনে মাথা না ঘামানো বা অবহেলাই অন্যতম কারণ বলে মনে করছি।

বিশ্বব্যাপী মানুষ পরিবেশ দূষণ রোধে সোচ্চার। যুক্তরাষ্ট্রের ‘সেন্টার ফর হিয়ারিং অ্যান্ড কমিউনিকেশন’ ১৯৯৬ সাল থেকে শব্দ দূষণ রোধে ‘শব্দ সচেতনতা দিবস’ পালন করে আসছে। বাংলাদেশে বেসরকারিভাবে দিবসটি পালন শুরু হয় ২০০৩ সাল থেকে। উন্নত রাষ্ট্রগুলো শব্দ দূষণকে যেভাবে নিয়েছে বাংলাদেশ আজও সেভাবে নেয়নি। আমাদের দেশে পরিবেশ দূষণ বিষয়টি আলোচিত হলেও পরিবেশের এই দূষণটি অতটা আলোচিত নয়। শব্দ দূষণ সম্পর্কে আলোচনা বা চিন্তাভাবনার গ-ি একেবারেই সীমিত। আলোচিত হবেই বা কি করে? আলোচনা করলেই তো হবে। শব্দ দূষণের কারণে মারাত্মক রকমের স্বাস্থ্য সমস্যা হতে পারে সে সম্পর্কে জনসাধারণ বা চালকদের মাঝে সুস্পষ্ট ধারণা নেই। কয়েকটি বেসরকারি সংগঠন এ নিয়ে কিছু কাজ করলেও তা সমস্যার তুলনায় খুবই সামান্য। শব্দ দূষণ নিয়ন্ত্রণে আমাদের দেশে যে আইন রয়েছে সেটি যদি যথাযথ প্রয়োগ করা হতো তাহলে এই সমস্যার ৮০ ভাগ সমাধান হতো। শব্দ দূষণ আইন ছাড়াও যদি ট্রাফিক আইনও যথাযথভাবে প্রয়োগ হতো তাহলে সমস্যার কিছুটা সমাধান হতো। অন্তত মানুষের সহনীয় পর্যায়ে থাকতো। এতে সমস্যার পরিমাণ অনেক কমই হতো। তাছাড়া আমরা জানি, শুধু মাত্র আইন করে সমস্যা সমাধান হয় না। মানুষ হিসেবে আমাদের বিবেক আছে। আমার দ্বারা অন্যের সমস্যা কেন হবে? নাগরিক হিসেবে আমাদের দায়িত্ব রাষ্ট্রের আইন যথাযথভাবে মেনে চলা। আমাদের সচেতন হতে হবে, অন্তত সুষ্ঠু ও সুন্দর পরিবেশের জন্য।

আকাশ ইকবাল প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট