চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

‘বিষমুক্ত’ হোক দুই হাজার বিশ

আবু মোশাররফ রাসেল

৫ জানুয়ারি, ২০২০ | ৩:০১ পূর্বাহ্ণ

মহাকালের গর্ভে হারিয়ে গেল আরেকটি বছর, ২০১৯। শুরু হলো নতুন বছর, ২০২০। এ বছরের সংখ্যাটি অংকে লিখলে খুব সুন্দর দেখায়, একে তো জোড়সংখ্যা, তার সাথে জোড়ের মিলন হয়ে অনন্য এক রূপ ধারণ করেছে। কিন্তু সংখ্যাটি কথায় লিখতে গিয়ে কেউ যদি সামান্য বানান ভুল করে সেটা এক মারাত্মক শব্দ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। ভুল তো ভুলই। ভুল করলে শব্দের অর্থ বদলে যাবেই, এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। তবে নতুন বছরে প্রত্যাশার প্রসঙ্গে সেটির কিছুটা প্রাসঙ্গিকতা আছে বৈকি। সে কারণেই ‘সংখ্যাতত্ত্ব’ দিয়ে শুরু করা। ২০২০ সংখ্যাটি অংকে লিখা নিয়ে অবশ্যই ইতোমধ্যে সতর্কতাও ছড়ানো হয়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে, প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে বিবিসি বাংলা। বলা হচ্ছে, ২০২০ সংখ্যাটি কেউ সংক্ষেপে শুধু ২০ লিখলে অসাধু কেউ তার পরে দুটি শূন্য বসিয়ে ২০০০ বানিয়ে নিতে পারে! সুতরাং সতর্ক থাকুন।

এ বছরের সংখ্যাটি কথায় লিখার সময় কী ভুল করলে কী হয় সে প্রসঙ্গ শেষের দিকে বলছি। আগে নতুন বছরে কি কি বদলে যায় বা কি কি পরিবর্তন ঘটে, সেসবের প্রভাব নাগরিক জীবনে কতটা পড়ে তা একটু দেখা যাক। নিন্দুকেরা নেতিবাচক অর্থে বলে থাকেন, নতুন বছরে কেবল ক্যালেন্ডারটিই বদলে যায়, আর সবকিছুই ঠিকঠাক থাকে। এক অর্থে কথাটিও সত্য। সূর্যটি প্রতিদিনের মতোই উদিত হয়-অস্ত যায়, নদীতে নিয়ম মতোই জোয়ার-ভাটা হয়, যে মানুষটি চাকরি করে তাকে নিয়ম মতোই অফিসে যেতে হয়, গৃহিনীকে প্রতিদিনের মতোই রান্না করতে হয় আর শিক্ষার্থীদের যেতে হয় তাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। পরিবর্তন বলতে, কেবল ক্যালেন্ডারটি বদলে যায়। কিন্তু এসব স্বাভাবিক কাজকর্মের মধ্যেই নাগরিকজীবনে নতুন বছরের প্রভাব কিভাবে পড়ে তার তালিকা তৈরি করতে গেলে সেটিও বেশ লম্বা হয়ে দাঁড়াবে।
ডিসেম্বর মাস শেষ হয়ে জানুয়ারি আসলেই মধ্যবিত্ত নাগরিকের জীবনে একটা নতুন চাপ পড়ে, সেটা হলো সন্তানদের নতুনভাবে স্কুল-কলেজে ভর্তি, খাতাপত্র সরঞ্জাম কিনে দেওয়া। আর শহুরে নাগরিকদের ওপর প্রভাব পড়ে দুটি। বছর ঘুরলেই বাড়িওয়ালার নোটিশ পেয়ে যানÑ‘এ মাস থেকে ভাড়া অত টাকা বাড়িয়ে দেবেন’। বাড়িঘরে একটু-আধটু কাজে সহায়তার জন্য যারা থাকে তারা দাবি দিয়ে দেয়, নতুন বছরে বেতন বাড়াতে হবে। সন্তানদের কেউ কেউ বায়না ধরে ‘নতুন বছরে এটা কিনে দিতেই হবে।’ মাঝে মাঝে বছর ঘোরার সাথে দ্রব্যমূল্যও চড়ে বসে। এসব প্রভাবের মধ্যে নাগরিকদের দিনযাপনে নতুন বছর নিয়ে আসে নতুন চাপ, সে চাপে কারও কারও কপালের ছাপ দীর্ঘ হতে থাকে।

এসবের মাঝেও মানুষকে জীবন ধারণ করতে হয়, জীবন চলতে থাকে জীবনের নিয়মেই। প্রয়োজন মতো খেয়েপরে সুন্দরভাবে বেঁচে থাকা কিংবা একটু মন খুলে নিঃশ্বাস নেওয়ার প্রত্যাশা এ দেশের বেশিরভাগ মানুষই করে থাকেন। নতুন বছরের প্রত্যাশা বলতে তাই এসবের মধ্যেই ঘুরপাক খায় আমজনতার হৃদয়।
সুস্থভাবে বেঁচে থাকার জন্য মানুষের কিছু মৌলিক প্রয়োজন রয়েছে। এর মধ্যে নিরাপদ খাদ্য, চিকিৎসা ব্যবস্থা এবং পরিবেশ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, এসব ছাড়া বেঁচে থাকা দায়। কিন্তু এখন এ তিনটিরই বড় সংকট চলছে। চারদিকে ভেজাল-বিষাক্ত খাবারের ছড়াছড়ি, চিকিৎসাসেবা চলে গেছে বাণিজ্যের করতলে, ফলে এখন তা মানুষের একদিকে নাগালের বাইরে অন্যদিকে আস্থাহীনতায় ডুবছে। আর পরিবেশের সার্বিক পরিস্থিতির কথা বাদ দিলেও বলতে হয় এই নগরীতে এখন নিঃশ্বাস নেওয়াও কঠিন।
প্রথমেই বলি আমাদের প্রিয় নগরী চট্টগ্রামের কথা। বর্তমান সরকার হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করে, বারবার টেন্ডার দিয়ে নাগরিকদের জন্য সড়কগুলো পিচঢালাই, সংস্কার এবং সৌন্দর্যবর্ধন করেছে। কিন্তু ওয়াসা পাইপলাইনের কাজের জন্য সড়কগুলোকে কেটেকুটে ছারখার করে দিয়েছে। বাকি অংশের মধ্যে ফুটপাত দখল করে রাখে পাশের ব্যবসায়ীরা, তারপরের সড়কের অংশ দখল করে রাখেন ভ্রাম্যমাণ বিক্রেতারা। হাঁটাচলার কোনো জায়গা নেই। যানবাহনের ফাঁকে ফাঁকে পথচারীদের চলাচল। কাটাকুটির কারণে চারদিকে কেবল ধুলাবালির রাজ্য, ওয়াসার খোঁড়াখুঁড়িতে এই শহরের নাগরিকদের দুর্ভোগের সীমা নেই। প্রতিদিনই নাগরিকরা ওয়াসা আর হকারদের ওপর বিরক্তি প্রকাশ করেন আর পারলে গালাগালি করে চৌদ্দগুষ্ঠিও উদ্ধার করেন। আমি অবশ্য এ প্রসঙ্গে ওয়াসার সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষ, এমডি’র কাছে একবার তার মতামত জানতে চেয়েছিলাম। পাইপলাইনের কাজ নিয়ে তিনি যা আমাকে জানিয়েছেন, তা অত্যন্ত আশাবাদের কথা। তিনি বলেছেন, ‘একশত বছরের পরিকল্পনা নিয়েই এবার কাজ করা হচ্ছে। এ কাজ শেষ হয়ে গেলে আগামী দুয়েক বছরের মধ্যে নগরীতে আর পানি সংকট থাকবে না, শত বছর পাইপলাইন নিয়ে আর চিন্তা করতে হবে না। পানির জন্য এ কষ্টটুকু নগরবাসীকে মেনে নিতে হবে।’

সচেতন নগরবাসী হয়তো তার এ যুক্তির কথা শোনে সাময়িক দুর্ভোগ মেনে নিতে পারে কিন্তু সাধারণ নাগরিকরা কি আর এসব বুঝবেন। সামনে আসছে সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন, এমন খোঁড়াখুঁড়ি অব্যাহত থাকলে নাগরিকদের ক্ষোভ ব্যালট বাক্স পর্যন্ত পৌঁছে যাওয়ার আশঙ্কা আছে। সুতরাং কর্পোরেশন ওয়াসাকে অনুরোধ করেছে আপাতত রাস্তা কাটাকুটি বন্ধ রাখতে। সুখবরটি দিয়েছে ওয়াসা কর্তৃপক্ষ, নতুন বছরের শুরু থেকে বড় ধরনের খোঁড়াখুড়ি আর হবে না। খোঁড়াখুঁড়ি বন্ধ হলে, সড়কগুলোতে ইতোমধ্যে সৃষ্টি হওয়া ক্ষতগুলো সিটি কর্পোরেশন মেরামত করে দেবে, আর তাতে ধুলাবালি থেকেও নাগরিকরা রক্ষা পাবে। সড়কে আর মাস্ক পরে বের হতে হবে না, একটু প্রাণ খুলে নিঃশ্বাসটা নেওয়া যাবে। একই সাথে নগর কর্তৃপক্ষের উচিত হবে, ফুটপাতগুলো যে কোনো মূল্যে উদ্ধার করে নাগরিকদের হাঁটাচলার জন্য ফিরিয়ে দেওয়া, সড়কের পাশের যেসব ব্যবসায়ী ফুটপাত দখল করে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর হলেই এটা সম্ভব। নতুন বছরের এই সুখবরটির সাথে মিলিয়ে আরও কিছু প্রত্যাশা এই শহরের নাগরিক হিসেবে করতে পারি। খোঁড়াখুঁড়ি বন্ধ হলে প্রাণ খুলে নিঃশ্বাসটুকু নেওয়া যাবে। সাথে নিরাপদ খাদ্য ও সুচিকিৎসা পাওয়ার নিশ্চয়তাটুকুও আমাদের পেতে হবে।
প্রসঙ্গক্রমে দুটি খাতের দুটি বিষয় উল্লেখ করতে চাই। সম্প্রতি চট্টগ্রামের চিকিৎসা ও খাদ্যখাতের দুটি প্রতিষ্ঠান বিজ্ঞাপন দিয়ে জানিয়েছে, তারা আন্তর্জাতিক মান সনদ বা আইএসও সনদ অর্র্জন করেছে। এই দুটি প্রতিষ্ঠানকে আমরা উদাহরণ হিসেবে ধরে নিয়ে বলতে চাই, বৃহত্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলের মানুষকে চিকিৎসাসেবা দেওয়ার জন্য বেসরকারি উদ্যোগে অনেক হাসপাতাল-ক্লিনিক-ডায়াগনস্টিক সেন্টার গড়ে উঠেছে। সেখানে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক রোগী দেখছেন, চিকিৎসা দিচ্ছেন, রোগনিরূপণ করছেন। কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে মানুষের ক্ষোভ-অভিযোগের কমতি নেই, মানুষ চিকিৎসাসেবায় সন্তুষ্ট না হয়ে বিদেশে পা বাড়াচ্ছেন। এভাবে চলতে থাকলে এক সময় মানুষ দেশের চিকিৎসার প্রতি এতই বিমুখ হয়ে যাবেন যে, ক্লিনিকগুলো তাদের ব্যবসা গুটিয়ে নিতে বাধ্য হবে। সুতরাং সময় থাকতে ভাবতে হবে। নতুন বছরের প্রত্যাশা হলো সবাইকে সেবার ক্ষেত্রে চেষ্টা করতে হবে। আইএসও পাওয়া মানেই সবকিছু মানসম্মত হয়ে গেছে, এমনটি নয়। কিন্তু চেষ্টা থাকলে মানুষ সেবা পাবে এবং এখানকার চিকিৎসা সম্পর্কে যে আস্থাহীনতার সৃষ্টি হয়েছে তা দূর হবে। খাদ্য উৎপাদনের ক্ষেত্রেও একই কথা। খাবার খেয়েই মানুষ বেঁচে থাকে। সেই খাবার যদি অনিরাপদ হয়, মানুষের জীবনই অনিরাপদ হয়ে যাবে। সুতরাং মানুষের জীবনের প্রয়োজনে খাবার নিরাপদ হয়ে উঠুক নতুন বছরে।

সুন্দরভাবে-সুস্থভাবে বেঁচে থাকার জন্য নিরাপদ ও মানসম্মত খাদ্য দরকার, অসুস্থ হলে সঠিক চিকিৎসা দরকার আর সুস্থ থাকার জন্য দরকার সুস্থ পরিবেশ। আমাদের পরিবেশের কারণে, ভেজাল ও মানহীন খাবারের কারণে আমরা অসুস্থ হচ্ছি। রোগনির্ণয় কেন্দ্রে গিয়ে আমরা সঠিক সেবা না পেয়ে নাজেহাল হচ্ছি। আমরা প্রত্যাশা করতে চাই, আমাদের স্বাস্থ্যসেবা দেওয়ার মতো যেসব প্রতিষ্ঠান রয়েছে তাদের মধ্যে এ বোধের উদয় হোক যে, স্বাস্থ্যখাতটি মানবসেবা-জনসেবা এবং ইবাদাতের অংশ। এটি কেবলই বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে কিছু করা নয়, মানুষ বেঁচে থাকলেই প্রতিষ্ঠাগুলো টিকে থাকবে। সুতরাং আন্তর্জাতিক মানের সেবা নিশ্চিত করাই হোক সব প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্য। আর যেসব প্রতিষ্ঠান স্বাস্থ্যসেবার নামে মানুষকে জিম্মি করে ব্যবসা করছে তাদের এটা বুঝা উচিত যে, তারাও একই ধরনের দশায়, একই পরিস্থিতির শিকার হতে হতেই পৃথিবী থেকে বিদায় নেবেনÑযদি না চিকিৎসা সেবা নিয়ে সঠিক আচরণ করার চেষ্টা না করি।

শুরু করেছিলাম সংখ্যাতত্ত্ব দিয়ে, বছরের সংখ্যাটি কথায় লেখা দিয়ে শেষ করি। নতুন বছরটিকে কথায় লিখলে ‘দুই হাজার বিশ’, সংখ্যাটিকে কেউ বানান ভুলে ‘শ’ এর জায়গা ‘ষ’ দিয়ে দিলে সেটি ভয়ানক এক শব্দ হয়ে যাচ্ছেÑ‘বিষ’। দুই হাজার বিশের সাথে যেহেতু ভুলের সংযোগ ঘটলে সেটি বিষাক্ত হয়ে যাচ্ছে; যা মানবজাতির জন্যই হুমকি। সুতরাং এই বছর আর কোনো ভুল করা যাবে না। আমাদের পরিবেশ সুস্থ হোক, আমাদের খাবার নিরাপদ হোক এবং আমাদের চিকিৎসাসেবা উন্নত হোক।

আবু মোশাররফ রাসেল গণমাধ্যমকর্মী।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট