চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

প্রতিরোধে পদক্ষেপ নিন অযৌক্তিক বাড়িভাড়া বৃদ্ধি

৪ জানুয়ারি, ২০২০ | ৬:২৪ পূর্বাহ্ণ

প্রতিটি নতুন বছরে এদেশে বাসাভাড়া বৃদ্ধির এক অলিখিত নিয়মে পরিণত হয়েছে। কিন্তু সংশ্লিষ্ট সংস্থার নজরদারীর অভাবে বাসাভাড়া বৃদ্ধির ক্ষেত্রে কোনো নিয়ম-নীতিরই তোয়াক্কা করেন না বাড়ির মালিকরা। ইচ্ছানুযায়ীই ভাড়া বাড়িয়ে দেন। এতে চরম বিপাকে পড়েন স্বল্প আয়ের ভাড়াটিয়ারা। আগের তুলনায় মানুষের আয় বেড়েছে। এ বিষয়ে কারো দ্বিমত করার সুযোগ নেই। কিন্তু দ্রব্যমূল্য, বাড়িভাড়া ও গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধিসহ নানা কারণে আয় বৃদ্ধির ইতিবাচক প্রভাব পড়ছে না মানুষের দৈনন্দিন জীবনে। বিশেষত, শহুরে জীবনে আয় বৃদ্ধির কোনো ইতিবাচক প্রভাবই পড়ে না। মুনাফাশিকারিদের দৌরাত্ম্যের কাছে সাধারণ মানুষের অসহায়ত্ব বাড়ছে। বাড়িভাড়া বৃদ্ধির ক্ষেত্রেও কোনো নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা করছে না বাড়িওয়ালারা। নতুন বছরের সূচনার সাথে সাথেই তারা বাড়িভাড়া বাড়িয়ে দিচ্ছে অযৌক্তিক ভাবে। কিন্তু যারা এসব দেখার দায়িত্বপ্রাপ্ত তারা পালন করছে নির্লিপ্ত ভূমিকা। ফলে চরম বেকায়দায় পড়ছে সাধারণ চাকরিজীবী, নি¤œ ও মধ্য আয়ের মানুষজন। একটি জনকল্যাণকামী দেশে এমন চিত্র মোটেই কাম্য হতে পারে না। বাড়িভাড়ার এই নৈরাজ্য বন্ধ করা অত্যন্ত জরুরি।

গ্রামীণ জনপদগুলোতে পর্যাপ্ত কর্মসুযোগ না থাকার কারণে কাজের সন্ধানে সাধারণ মানুষ শহরমুখী হচ্ছে দীর্ঘদিন থেকেই। গ্রামপর্যায়ে কর্মসৃজন কর্মসূচি নেওয়ার ঘোষণা থাকলেও তা যথাযথভাবে কার্যকর হয়নি। বছরকয়েক ধরে রাজনৈতিক অস্থিরতাসহ নানা কারণেও গ্রামীণ জনপদগুলোতে কাজের অভাব দেখা দিয়েছে। ফলে, গ্রামের বেকার জনগোষ্ঠীর একটি অংশ কাজের সন্ধানে শহরের দিকে ধাবিত হচ্ছে। আর শহরমুখী মানুষের এই স্রোত নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে শহরের বাড়িভাড়াসহ নানাক্ষেত্রে। শহরমুখী মানুষদের অধিকাংশই শহরে ভাড়া বাড়িতে বসবাস করে। আবার শহরের আবাসিক এলাকাগুলোতে থাকে বিভিন্ন সংস্থা, শিল্প-কলকারখানা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান/সংস্থা, ব্যাংক-বীমার অফিস। আবাসিক এলাকায় কোনো সংস্থার অফিস থাকা আইনত নিষিদ্ধ হলেও তা মানা হচ্ছে না। কারণ বসবাসের জন্যে বাড়ি দিলে যে ভাড়া পাওয়া যায় তার চেয়ে বেশি ভাড়া পাওয়া যায় ব্যাংক, বীমা, স্কুল, সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান/সংস্থার অফিসের জন্যে ভাড়া দিলে। অর্থলোভী বাড়িওয়ালাদের এই মনোবৃত্তির কারণে বাড়িভাড়ার কোনো নিয়ম-নীতি মানা হচ্ছে না। সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থা ও সিটি করপোরেশনের যথাযথ নজরদারি ও গাফিলতির কারণে আবাসিক এলাকায় বাড়িওয়ালারা নিয়ম ভঙ্গ করে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে বাড়িভাড়া দিচ্ছে। এতে একদিকে যেমন লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে বাড়িভাড়া। অন্যদিকে নষ্ট হচ্ছে আবাসিক এলাকার বৈশিষ্ট্য ও পরিবেশ। বিঘিœত হচ্ছে জনরিাপত্তাও। বাড়িওয়ালাদের দৌরাত্ম্য বন্ধে সিটি করপোরেশন ও সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ নীরব থাকার কারণে চরম ক্ষতি ও নানামুখী হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে সাধারণ ভাড়াটিয়াদের। নানা হয়রানি সহ্য করে হলেও নিজ বাড়ি ছেড়ে আসা এসব মানুষ এই বন্দরনগরীতে বসবাস করছে। তাদেরকে নিয়ম-নীতি বহির্ভূত অধিক টাকা ভাড়া দিয়ে নিরুপায় হয়ে শহরে বাসবাস করতে হচ্ছে। বাড়িভাড়াসংক্রান্ত আইনের কঠোর প্রয়োগ হলে নিশ্চয়ই এমনটি হতো না।

কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) একটি সমীক্ষা বলছে, গত ২৫ বছরে রাজধানীতে বাড়িভাড়া বেড়েছে প্রায় ৪০০ শতাংশ। চট্টগ্রামেও প্রায় একইরকম। একই সময়ে নিত্যপণ্যের দাম বেড়েছে ২০০ শতাংশ। অর্থাৎ নিত্যপণ্যের দামের তুলনায় বাড়িভাড়া বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ। অন্য এক জরিপে দেখা যায়, ২৭ ভাগ ভাড়াটিয়া আয়ের প্রায় ৩০ শতাংশ, ৫৭ ভাগ ভাড়াটিয়া প্রায় অর্ধেক এবং ১২ ভাগ ভাড়াটিয়ার আয়ের প্রায় ৭৫ শতাংশ টাকা ব্যয় হয় বাড়িভাড়া খাতে। অথচ বাড়িভাড়া আইন-১৯৯১ এর ৭ ধারা অনুযায়ী, কোনো বাড়ির ভাড়া মানসম্মত ভাড়ার অধিক বৃদ্ধি করা হলে ওই অধিক ভাড়া, কোনো চুক্তিতে ভিন্নরূপ কিছু থাকা সত্ত্বেও আদায়যোগ্য হবে না। আইনের ১৩ (১) ধারা মোতাবেক বাড়িভাড়ার রসিদ ভাড়াটিয়াকে দিতে হবে। কিন্তু বেশিরভাগ বাড়িওয়ালা ভাড়া নিয়ে রসিদ দেন না। বাড়িভাড়া আইনের ব্যাপারে সাধারণ মানুষও অজ্ঞ। আবার যারা আইন সম্পর্কে কিছু জানেন তাদের অধিকাংশই কোর্ট-কাছারি করতে ইচ্ছুক নন। এতে সুবিধা পায় অর্থলোভী বাড়িওয়ালারা। বাড়িওয়ালারা তাদের ইচ্ছানুযায়ী ভাড়া নির্ধারণ ও বৃদ্ধি করে তা চাপিয়ে দিচ্ছে অসহায় ভাড়াটিয়াদের ওপর। এ ধরনের আচরণ মোটেও সমীচীন নয়। এর প্রতিকারে আইনি পদক্ষেপ থাকা দরকার। আমরা মনে করি, বাড়িভাড়া আইনের যথাযথ প্রয়োগে সরকারের আন্তরিক পদক্ষেপ সময়ের দাবি। এই দাবি পূরণের মাধ্যমে অসহায় ভাড়াটিয়াদের সুরক্ষা দেওয়া সরকারের কর্তব্য। তবে, সরকারের পাশাপাশি গণমাধ্যম, বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা, নাগরিক সমাজকেও এ ব্যাপারে ভূমিকা রাখা দরকার। সাধারণ মানুষকে বাড়িভাড়া আইন ও ভাড়াটিয়াদের আইনগত অধিকার ও সুরক্ষা পাওয়ার বিষয়ে সচেতন করে তোলারও সুচিন্তিত কর্মসূচি থাকতে হবে। ভাড়াটিয়াদের ন্যায্য দাবি আদায়ে ঐক্য প্রতিষ্ঠা করতে হবে। সিটি করপোরেশনের উচিত অতিদ্রুত অঞ্চলভেদে ভবনের অবকাঠামো, সুযোগ-সুবিধা ও বগফুট অনুযায়ী বাড়িভাড়ার হার নির্ধারণ করে দেওয়া এবং নির্ধারিত ভাড়া প্রতিটি বাড়িওয়ালা ও ভাড়াটিয়াদের মানতে বাধ্য করা। আমরা এ বিষয়ে দ্রুত জনকাক্সিক্ষত পদক্ষেপ চাই।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট