চট্টগ্রাম মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতালের চার দশক

ম. মাহমুদুর রহমান শাওন

৪ জানুয়ারি, ২০২০ | ৬:২৫ পূর্বাহ্ণ

জনসংখ্যা বাড়ছে, বাড়ছে স্বাস্থ্যগত সমস্যা। কিন্তু রোগ ও রোগীর বিপরীতে স্বাস্থ্যসেবাকেন্দ্র অপ্রতুল এই চট্টগ্রামে। চট্টগ্রাম মেডিকেলে ধারণক্ষমতার চেয়ে রোগী তিন-চার গুণ বেশি হওয়ায় চাপটা সামাল দেয় চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতাল। সীমিত জনবল ও যন্ত্রপাতি দিয়ে মানুষের আস্থা অর্জন করার প্রাণান্তকর চেষ্টা করে যাচ্ছে দেশের অন্যতম বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবাকেন্দ্র চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতাল। ক্রমে এটি গরীব ও অসহায় রোগীদের স্বাস্থ্যসেবায় ভরসাস্থল এবং আস্থার ঠিকানায় পরিণত হয়েছে।
১৯৮৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতালটি যাত্রা শুরু করে। বেসরকারিভাবে গড়ে উঠা হাসপাতালটি দীর্ঘ ৪০ বছর ধরে চট্টগ্রামের লাখ লাখ অসহায় ও দরিদ্র মানুষের চিকিৎসাসেবা দিয়ে যাচ্ছে। তবে যে হারে এটি স্বাস্থ্যসেবা দিয়ে যাচ্ছে, সে তুলনায় প্রতিষ্ঠানটির সুনাম-খ্যাতি অনেক মানুষের দোড়গোড়ায় পৌঁছেনি। বর্তমান পরিচালনা কমিটির সভাপতি প্রফেসর ডা. এ এস এম ফজলুল করিমসহ চট্টগ্রামের কয়েকজন মানবতাবাদীর উদ্যোগের প্রতিফলন আজকের এই বিশাল পরিসরের স্বাস্থ্যসেবাকেন্দ্র। শুরুর দিকে কেবল বহির্বিভাগে সীমিত পরিসরে চিকিৎসাসেবা দেয়া হলেও চার দশক পর এসে চিকিৎসক-কর্মচারি সকলের সমন্বিত প্রয়াসে প্রায় সতের শতাধিক ব্যক্তির কর্মমুখরতায় চিকিৎসাসেবায় অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতাল।

স্বল্প খরচে সহজে চিকিৎসাসেবা পাওয়া একজন মানুষের মৌলিক অধিকার। কিন্তু বৃহত্তর চট্টগ্রামে এক সময় সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে চিকিৎসাসেবা ছিল অপ্রতুল। বিশেষায়িত মানসম্পন্ন চিকিৎসাসেবা প্রতিষ্ঠান এখানে বলতে গেলে তেমন ছিল না। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল কিংবা আন্দরকিল্লাস্থ জেনারেল হাসপাতাল, এ দুইটি হাসপাতালের পক্ষে বৃহত্তর চট্টগ্রামের কোটি মানুষের চিকিৎসাসেবা দেয়া দুরুহ ব্যাপার। তখন শিশু এবং মায়েদের জন্য চট্টগ্রামে কোনো বিশেষায়িত হাসপাতাল ছিল না। আর এই প্রয়োজনীয়তা ও শূন্যস্থানটি পূরণ করে চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতাল।

প্রসূতি মা ও নবজাতক শিশুদেরকে নানাবিধ রোগ নিরাময়ে বিশেষায়িত মা ও শিশু হাসপাতালটি কতো বড় ভূমিকা রাখছে, তার একটি ছোট্ট বাস্তব ঘটনা এখানে উল্লেখ করা যায়। চট্টগ্রামে মাতৃমৃত্যু ঠেকাতে ও শিশুমৃত্যু রোধে এই হাসপাতালের ভূমিকা অনস্বীকার্য। চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতালের মতো একটি বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠান এখানে আছে বলেই তো প্রতিদিন শত শত শিশুসহ বিভিন্ন ধরণের অসহায় গরিব রোগীরা সহজে ও সুলভ খরচে চিকিৎসাসেবা নিতে পারছে। চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতাল জনসাধারণের অর্থ আনুকূল্যে পরিচালিত মানবসেবামূলক একটি প্রতিষ্ঠান। আর্তমানবতার সেবার লক্ষ্যে এর গোড়াপত্তন। অন্য দশটি বেসরকারি হাসপাতালের মতো এখানে বাণিজ্যিক বা লাভজনক কোনো ব্যাপার নেই। এখানে শুধু চিকিৎসার বিনিময়ে রোগীর কাছ থেকে খরচটুকুই নেয়া হয়। প্রকারান্তরে রোগীদের অসহায়ত্বের কথা ভেবে সর্বোচ্চ ছাড়ও দেওয়া হয়। হতদরিদ্রদের চিকিৎসায় হাসপাতালের একটি যাকাত ফান্ড আছে। নিতান্তই গরিব অসহায় রোগীদেরকে যাকাত ফান্ড থেকে বিনা খরচে চিকিৎসাসেবাসহ প্রয়োজনীয় ওষুধপত্র কিনে দেওয়ার মতো মহৎ উদ্যোগও রয়েছে এ হাসপাতালের। হাসপাতাল কোনো ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান হতে পারে না, গরিবেরও চিকিৎসাসেবা পাওয়ার অধিকার আছে- চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতাল এই প্রত্যয় নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। ৪০ বছরে এই প্রতিষ্ঠানটি গরিব ও অসহায় মানুষের আস্থা এবং ভালোবাসার ঠিকানা হয়ে উঠেছে। স্বল্পখরচে উন্নত চিকিৎসাসেবা ও গরিব রোগীদের জন্য চিকিৎসাব্যয়ে ছাড় দেয় এমন কয়টি হাসপাতাল দেশে রয়েছে?

চট্টগ্রাম মা শিশু ও জেনারেল হাসপাতাল ৬৫০ শয্যার একটি পূর্ণাঙ্গ হাসপাতাল। হাসপাতালের বহির্বিভাগ ছাড়াও রয়েছে শিশু আইসিইউ, এনআইসিইউ, এডাল্ট আইসিইউ, সিসিইউ, কিডনি ডায়ালাইসিস, ইউরোলজি, অর্থোপেডিকস ও ট্রমা ইউনিট, অটিজম ও শিশু বিকাশ কেন্দ্র, ফিজিক্যাল মেডিসিন এন্ড রিহ্যাবিলিটেশন সেন্টার, গ্যাস্ট্রোএন্টারলজি ইউনিট, শিশু কিডনি রোগী ইউনিট, থেলাসেমিয়া ইউনিট, অনকোলজি ইউনিট, এডাল্ট নিউরোলজি, শিশু কার্ডিওলজি, ল্যাবরেটরি সার্ভিস, ব্লাড ব্যাংক। এক কথায় একটি পূর্ণাঙ্গ চিকিৎসাসেবাকেন্দ্র। শিশুরোগী ছাড়াও বর্তমানে সকল বয়সী রোগীদের চিকিৎসাসেবা দেয়া হচ্ছে। সাড়ে ৯ হাজারের অধিক আজীবন সদস্য হাসপাতালের যাবতীয় কার্যক্রম নিয়মিতভাবে বুলেটিন ও বার্ষিক সাধারণ সভার মাধ্যমে অবহিত হয়ে থাকে।

চট্টগ্রামবাসীর স্বাস্থ্যসেবা আরো একধাপ এগিয়ে নেয়ার লক্ষ্যে ৮৫০ শয্যাবিশিষ্ট নতুন ভবনের নির্মাণ কাজ এগিয়ে চলছে দ্রুত গতিতে। ১৪ তলাবিশিষ্ট ভবনটি নির্মাণে ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ৫০০ কোটি টাকা। ২০১৩ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা হাসপাতালের জন্য নতুন একটি ভবন নির্মাণের কাজ উদ্বোধন করেন। শীঘ্রই নবনির্মিত ভবনে এ হাসপাতালের আউটডোরসেবা চালু করার প্রত্যয় নিয়ে নির্মাণ কাজ এগিয়ে যাচ্ছে। এক পরিসংখ্যান মতে, ১৯৭৯ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত বহির্বিভাগে ৫১ লাখ ৯২ হাজার ১৪৬ জন এবং অন্তবিভাগে ৯ লাখ ৭২ হাজার ৫২০ জন রোগী সেবা গ্রহণ করে। চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতাল একটি বিশাল প্রকল্প। ৪০ বছরে এগিয়েছে অনেক দূর। হাসপাতালটি শুধু মা ও শিশু চিকিৎসার মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে রূপান্তরিত হয়েছে জেনারেল হাসপাতালে। এছাড়াও প্রতিষ্ঠা করেছে চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতাল মেডিকেল কলেজ, চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতাল নার্সিং ইনস্টিটিউট, চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতাল ইনস্টিটিউট অব চাইল হেলথ, চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতাল নার্সিং কলেজ (বিএসসি নার্সিং)।

চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতালের একটি বড় প্রকল্প হিসেবে একটি পূর্ণাঙ্গ বিশেষায়িত ক্যান্সার হাসপাতাল নির্মাণ করার উদ্যোগ নিয়েছে বর্তমান নির্বাহী কমিটি। সমাজের বৃত্তবান ও সমাজহিতৈষীদের সহায়তায় ১০০ কোটি টাকা ব্যয়ে প্রস্তাবিত ক্যান্সার হাসপাতাল নির্মাণে বর্তমান কার্যনির্বাহী কমিটি মানবতার সেবায় নিরলস কাজ করা যাচ্ছে। সবার ত্যাগ ও প্রচেষ্টায় গৃহীত স্বাস্থ্যপ্রকল্পগুলোর সুচারু বাস্তবায়ন সম্ভব হবে।

ম. মাহমদুর রহমান শাওন সদস্য সচিব, চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতাল আজীবন সদস্য ফোরাম।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট