চট্টগ্রাম শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

উদারনৈতিক সমাজ গড়তে সুফিবাদ চর্চার গুরুত্ব

ড. মোহাম্মদ নুর হোসাইন

৩ জানুয়ারি, ২০২০ | ৩:২৮ পূর্বাহ্ণ

ইসলাম একটি ভারসাম্যপূর্ণ কালজয়ী পূর্ণাঙ্গ জীবনবিধান। ইসলামের মূলসূত্র কুরআন-সুন্নাহ গবেষণা করলে দেখা যায়, বিশ্বমানবতার জাগতিক ও আধ্যাত্মিক সব সমস্যার সমাধানের জন্যই হযরত মুহাম্মদ (দ.)-এর শুভাগমন হয়েছে। তাঁর আনীত বিধান কুরআন-সুন্নাহর মধ্যে নিহিত রয়েছে সর্বকাল, সর্বশ্রেণী ও সর্বস্তরের মানুষের ইহ-পরকালীন শান্তির চিরন্তন দিক-নির্দেশনা। অন্যান্য ধর্ম ও মতবাদের সাথে ইসলামের মূল পার্থক্য এখানেই। অন্যান্য ধর্মে আধ্যাত্মিক বিষয়াদির সমাধান থাকলেও জাগতিক বিষয়ের আলোচনা অনুপস্থিত। কোন কোন মতবাদে জাগতিক কিছু বিষয়ের সমাধানের কথা থাকলেও আধ্যাত্মিক বিষয়াবলির দিক-নির্দেশনা নেই। পক্ষান্তরে আধ্যাত্মিকতা ও জাগতিকতার সমন্বিত রূপ হলো ইসলাম। তাই ইসলামের মূল দিক দু’টি জাহির ও বাতিন বা শরিয়ত ও তরিকত। এ দু’টিকে মাজহাব ও মাশরাবও বলা হয়। কখনো কখনো হাকিকত ও মা‘রিফাত নামে আখ্যায়িত করা হয়। তরিকতচর্চার অপর নাম তাসাউফ বা সুফিবাদ। অতএব পূর্ণাঙ্গ মুসলমান হতে হলে শরিয়ত ও তরিকত উভয়টি চর্চা করা জরুরি। অর্থাৎ বাহ্যিক বিধানাবলীকে অস্বীকার করার যেমন কোন জো নেই, তেমনি আধ্যাত্মিকতাকে উপেক্ষা করারও সুযোগ নেই। কারণ, কুরআন-সুন্নাহ্র আলোকে সুফিবাদ একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

তাসাউফ শব্দটি সফা, সফ্উন বা সূফুন শব্দ থেকে উদ্গত। এর অর্থ পবিত্রতা, পরিচ্ছন্নতা, একনিষ্ঠতা, অকৃত্রিমতা, পশম ইত্যাদি। ইমাম মা‘রুফ কারখি (রহ.) বলেন, “তাসাউফ হলো হাকিকতকে (মৌলিকত্ব) গ্রহণ করা এবং মানুষের নিকট পাওয়া যায়-এমন যে কোন কিছু থেকে বিমুখ হওয়া।” হযরত যাকারিয়া আনসারি (রহ.) বলেন, চিরস্থায়ী কল্যাণ লাভের লক্ষে আত্মশুদ্ধি, চরিত্র গঠন, ভেতর-বাইরের সবকিছু সংশোধন ও সংস্কারের নাম তাসাউফ। বড়পীর আব্দুল কাদের জিলানি (রহ.)-এর মতে, আল্লাহতায়ালার সাথে সত্যপরায়ণতা আর মানুষের সাথে সদাচরণের নাম তাসাউফ (গুনিয়াতুত্তালিবিন)। উল্লেখিত সংজ্ঞাগুলোর আলোকে তরিকতচর্চায় পাঁচটি বিষয় অতীব গুরুত্বপূর্ণ। এক. অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ও অন্তরকে ত্রুটি মুক্ত রাখা দুই. প্রত্যেক কর্মে নিয়তের পরিশুদ্ধতা বজায় রাখা তিন. সর্বকাজ একনিষ্ঠতার সাথে সম্পাদন করা চার. আল্লাহ তায়ালার সাথে কৃত ওয়াদা যথাযথভাবে পালন করা এবং পাঁচ. মানুষের সাথে সর্বদা সদাচরণ করা।

সুফিবাদ বা সুফি শব্দটি পবিত্র কুরআনে সরাসরি উচ্চারিত হয়নি। তবে পবিত্র কুরআনের বিভিন্ন আয়াতে এর সমার্থক ও প্রতিশব্দ ইখলাছ, ইহ্সান, হানাফিয়্যাহ্, ছাদাকাত ইত্যাদির ব্যবহার হয়েছে। সুরা ‘আল-বায়্যিনাহ’-এর চতুর্থ আয়াতে বলা হয়েছে, “আর তাদেরকে শুধু এ নির্দেশই দেয়া হয়েছে যে, তারা ইখলাছের সাথে একনিষ্ঠ হয়ে আল্লাহ্র ইবাদত করবে।” উক্ত আয়াতে আল্লাহর ইবাদতকে ইখলাছ ও হানাফিয়্যাহ-এর সাথে শর্তযুক্ত করা হয়েছে। এখানে উল্লেখিত ইখলাছ ও হানাফিয়্যাহ্ শব্দ দু’টি তাসাউফ শব্দের সমার্থক শব্দ। পবিত্র কুরআনে তাসাউফচর্চাকারীকে ছাদেকিন, ছালেহিন, খাদেয়িন, মুখলিছিন, মুহ্সিনিন ইত্যাদি নামে আখ্যায়িত করা হয়েছে। সুরা কাহাফ-এর তেইশটি আয়াত জুড়ে আলোচনা হয়েছে হযরত মূসা (আ.)-এর সাথে হযরত খিজির (আ.)-এর কথোপকথন, সফর ও তিনটি বিশেষ ঘটনার। অধিকাংশ তাফসিরকারের মতে, হযরত খিজির (আ.) ছিলেন একজন অলি। অথচ আল্লাহ তায়ালা হযরত মূসা (্আ.)-এর মত নবিকে বিশেষ জ্ঞান-অর্জনের জন্য হযরত খিজির (আ.)-এর সান্নিধ্যে যাওয়ার নির্দেশ দিলেন। সে বিশেষ জ্ঞান ছিল তাসাউফের জ্ঞান। উল্লেখ্য, স্ব স্ব যুগের নবিগণ (আ.) ছিলেন শরিয়তের সবচেয়ে বড় জ্ঞানী। হযরত মূসা (আ.) আল্লাহ তায়ালার নির্দেশে উক্ত জ্ঞানার্জনের জন্য সুদীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে হযরত খিজির (আ.)-এর সাথে সাক্ষাৎ করেছেন এবং সেই জ্ঞানার্জনের আকাক্সক্ষা প্রকাশ করেছেন। হযরত খিজির (আ.) প্রথমে নারাজি প্রকাশ করে বললেন, “এ বিষয়ে আপনি আমার সাথে একমত থাকতে পারবেন না।”

অর্থাৎ আপনার নিকট যে জাহিরি জ্ঞান আছে, তার মাপকাঠিতে আমার কর্মকা-কে অযৌক্তিক ও পাপকর্ম বলে মনে হবে। বাস্তবে হয়েছেও তাই। হযরত খিজির (আ.)-এর তিনটি কাজে হযরত মূসা (আ.) আপত্তি করলেন এবং অন্যায় বলে অভিহিত করলেন। বাহ্যিক দৃষ্টিতে তথা শরিয়তের ফতোয়া অনুযায়ী সে তিনটি কাজ ছিল অযৌক্তিক ও অপরাধমূলক। কিন্তু পরবর্তীতে যখন তিনি সে তিনটি কাজের মূল রহস্য উদ্ঘাটন করলেন, তখন হযরত মূসা (আ:) সেগুলোকে যথাযথ বলে স্বীকৃতি দিলেন। এভাবে আসহাবে কাহাফ, হযরত ‘আছিফ বিন বলখিয়া, হযরত লোকমান হাকিম, হযরত মরিয়মসহ বহু অলিআল্লাহর ঘটনা প্রবাহ থেকে তাসাউফচর্চার প্রয়োজনীয়তা ও সুফিগণের মর্যাদা পবিত্র কুরআনের আয়াত ও বাচনভঙ্গি দ্বারা সুপ্রমাণিত হয়। এমনকি পবিত্র কুরআনের প্রত্যেক আয়াতে আধ্যাত্মিকতা রয়েছে। পবিত্র হাদিসে বলা হয়েছে, “প্রত্যেক আয়াতের বাহ্যিক ও আধ্যাত্মিক অর্থ রয়েছে (মিশকাত)। একদা হযরত ওমর (র.) হযরত ইবন আব্বাস (র.)-কে সুরা নছর-এর রহস্য সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলেন। তখন তিনি বললেন, “এর মর্মার্থ হলো আল্লাহর রাসুল (দ.)-এর ইন্তিকাল।” তখন উপস্থিত সাহাবিগণ তাঁর ব্যাখ্যাটি মেনে নিলেন। অথচ সুরা নছরে সরাসরি এ জাতীয় কোন কথা নেই। এভাবে পবিত্র কুরআনের পরতে পরতে তাসাউফের জ্ঞান ও সুফিবাচর্চার কথা আছে। যে কোন শব্দ ও পরিভাষা পবিত্র কুরআন থাকাটা আবশ্যক নয়। অন্যথায় অনেক পরিভাষা, তার দর্শন ও চর্চা অবৈধ হয়ে যাবে। যেমন, মেরাজ শব্দটি আল-কুরআনে আসেনি। তবে এর প্রতিশব্দ ‘ইসরা’ এসেছে। ইজতিহাদের মাধ্যমে ইসলামি অনুশাসন পালন করা সহজ থেকে সহজতর হয়েছে। কুরআন-সুন্নাহর সঠিক মর্ম বুঝা সম্ভব হয়েছে। এটাকে ঘিরে ইসলামি বহু পরিভাষা সৃষ্টি হয়েছে। জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিশাল জগত সৃষ্টি হয়েছে। উচ্চতর গবেষণার দ্বার উন্মুক্ত হয়েছে। অথচ সে শব্দটি আল-কুরআনে উক্ত অর্থের জন্য ব্যবহার হয়নি। তবে ‘ইজতিহাদ’-এর প্রতিশব্দ আল-ইস্তিম্বাত, আল-ই’তিবার, আত্তাফাক্কুহ ইত্যাদি এবং এর গুরুত্বের কথা আল-কুরআনে বার বার এসেছে। সিয়াসাত (রাজনীতি) ইকতিছাদ (অর্থনীতি) ইত্যাদি শব্দেরও ব্যবহার হয়নি। তাহলে কি আল-কুরআনে রাজনীতি ও অর্থনীতির আলোচনা হয়নি? এভাবে খোদা, নামায, রুযা শব্দগুলো পবিত্র কুরআন-হাদিসে নেই। এগুলো ফার্সি শব্দ, যা বিদেশি শব্দ হিসেবে বাংলা ভাষায় ব্যবহার হয়ে আসছে। এগুলো যথাক্রমে আল্লাহ, ছালাত ও ছাওম-এর প্রতিশব্দ। তাই পরিভাষায় ব্যবহৃত শব্দটি মূল বিষয় নয়। বরং এগুলোর প্রতিঅর্থ বুঝা গেল কি-না এবং তার বিশ্বাস, দর্শন, আদর্শ ও চর্চার কথা কুরআন-সুন্নাহতে আছে কি-না, সেটিই আসল বিষয়। সুতরাং কুরআন-স্ন্নুাহ্র কোথাও তাসাউফ ও সুফি শব্দের উল্লেখ নেই- এমন যুক্তি দিয়ে তাসাউফচর্চাকে বিদ্য়াত বা অন্য কিছু বলে আখ্যায়িত করা যুক্তিসঙ্গত নয়।

বুখারি শরিফসহ প্রায় হাদিসের কিতাবে ‘হাদিসে জিব্রাইল’ উল্লেখ হয়েছে। হযরত জিব্রাইল (আ.) মুসলমানদেরকে দ্বীনের পরিচয় করিয়ে দেয়ার জন্য এসেছিলেন। উক্ত হাদিসে তিনি দ্বীনের পরিচয় জানতে চেয়েছিলেন বিধায় হাদিসটিকে এ নামে অভিহিত করা হয়। তিনি আল্লাহর রাসুল (দ.)-কে ঈমান কী, ইসলাম কী, ইহসান কী, কিয়ামত কখন হবে ইত্যাদি প্রশ্ন করেছিলেন। আল্লাহর রাসুল (দ.) সাতটি বিষয় বিশ্বাস করাকে ঈমান আর পাঁচটি কর্মসূচী পালন করাকে ইসলাম বলে উত্তর দিলেন। তিনি ‘ইহসান’ এর পরিচয়ে বলেন, “ইহসান হলো তুমি আল্লাহর ইবাদত এমনভাবে করবে, যেন আল্লাহকে দেখছ অথবা তিনি তোমাকে দেখছেন।” এ ইহসানকে তরিকতের পরিভাষায় মোরাকাবা ও মোশাহাদা বলা হয় (মিরকাত)। তিনি ঈমান ও ইসলাম সম্পর্কে প্রশ্ন করার পর আবার ইহসান সম্পর্কে প্রশ্ন করা এবং আল্লাহর রাসুল (দ.) এভাবে উত্তর প্রদান করা দ্বারা পরিষ্কার বুঝা যায় যে, ঈমান-ইসলাম ছাড়াও আরেকটি বিষয় আছে। সেটি হলো তরিকত বা তাসাউফ। এর অর্থ এটা নয় যে, ঈমান-ইসলামের বিপরীতে নিজস্ব ধ্যান-ধারণার আলোকে নতুন কোন মতবাদ সৃষ্টি করার নাম তাসাউফ।
বরং এর অর্থ হলো কুরআন-সুন্নাহর অর্থকে শুধু শাব্দিক অর্থে গ্রহণ না করে সর্বোচ্চ সতর্কতা ও গুরুত্বের সাথে নিয়ে সে অনুযায়ী নিষ্ঠার সাথে তা বাস্তবায়ন করার নাম তাসাউফ। তাই যুগে যুগে সুফি-সাধকগণ ছিলেন প্রথমত কুরআন-সুন্নাহর অনুসারী। তারপর তারা সুফি। এর ব্যাখ্যা হলো শরিয়তচর্চা ব্যতিত তাসাউফচর্চা হবে না, বরং তাসাউফ হলো শরিয়ত নামক দেহের আত্মা। সুতরাং দেহ আর আত্মা নিয়ে একজন মানুষ যেমন পূর্ণ হয়, তেমনি শরিয়ত ও তরিকতের সমন্বয়েই ইসলামের পরিপূর্ণতা প্রকাশ পায়। হযরত আবু হুরায়রার (রা.) বলেন, “আমি আল্লাহর নবি (দ.) থেকে দু’পাত্র জ্ঞান অর্জন করেছি। এক পাত্র আমি তোমাদের সামনে প্রকাশ করেছি। আরেক পাত্র আমি প্রকাশ করলে তোমরা আমার গলা কেটে ফেলবে”(মুসলিম)। এখানে অপ্রকাশিত জ্ঞান বলতে তাসাউফের জ্ঞানকে বুঝানো হয়েছে মর্মে হাদিসবিশারদগণ মন্তব্য করেছেন। এভাবে কুরআন-হাদিসের অসংখ্য বাণী দ্বারা সুফিবাদ ও সুফিবাদচর্চার গুরুত্ব সুদৃঢ়ভাবে প্রমাণিত হয়। তাই যুগে যুগে ইমামগণ তাসাউফের জ্ঞানকে ইসলামি জ্ঞান বলে মত দিয়েছেন এবং সেই তাসাউফচর্চা তারা নিজেরাও করেছেন। ইমাম গাজ্জালীর মতে, ছয় প্রকার জ্ঞানের মধ্যে তাসাউফের জ্ঞান অন্যতম। ইমাম মালেক (রহ:) বলেন, যে ব্যক্তি ফিক্হ শিখল, তাসাউফের জ্ঞান অর্জন করল না, সে ফাসেক হয়ে গেল। আর যে তাসাউফ শিখল, ফিক্হ শিখল না, সে খোদাদ্রোহী হয়ে গেল। যে উভয়টির সমন্বয় করল, সে প্রকৃত জ্ঞানী (মিরকাত, আল-কউলুল জামিল)।

চার মাজহাবের ইমামগণসহ প্রত্যেক হক্কানি আলেম যুগে যুগে শরিয়তের জ্ঞানের পাশাপাশি তাসাউফচর্চা করেছেন। তাঁরা বিনম্রতা, অহিংসা, নিরহংকার, অকৃত্রিমতা, প্রেমবাদ ইত্যাদির মাধ্যমে পৃথিবীর প্রত্যন্ত অঞ্চলে দ্বীনের প্রসার ঘটিয়েছেন। তাসাউফপন্থী মহামনীষীগণের নির্মল চরিত্রমাধুর্যে বিমুগ্ধ হয়ে দলে দলে মানুষ ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে আশ্রয় নিয়েছে। নৈতিকতার বর্তমান চরম অবক্ষয়ের যুগে বিশ্বমানবতাকে পুনরায় নৈতিকতায় ফিরিয়ে আনতে হলে প্রকৃত সুফিবাদচর্চা অত্যাবশ্যক। অমানবতা ও অনৈতিকতা রোধে তাসাউফের শিক্ষাই অধিক কার্যকর। এ পন্থায় প্রচারিত ইসলামি আদর্শই হবে অধিক স্থায়ী ও টেকসই।

ড. মুহাম্মদ নুর হোসাইন সহযোগী অধ্যাপক, আরবি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট