চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

বিশ^নবীর (স.) কালজয়ী দর্শন

ডা. মোহাম্মদ ওমর ফারুক

৩ জানুয়ারি, ২০২০ | ৩:২৮ পূর্বাহ্ণ

৫৭০ খ্রিস্টাব্দের ২৯ আগস্ট ১২ রবিউল আউয়াল বিশ্ব মানবতার মুক্তির দিশারী, মানবপ্রেমী ও সর্বশেষ নবী হযরত মোহাম্মদ (সা.) জন্মগ্রহণ করেছেন মক্কার কুরাইশ বংশের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে। তাঁর পূর্ণ নাম আবু আল কাশিম মোহাম্মদ ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে আবদুল মুত্তালিব ইবনে হাশিম। তিনি আকাশ-জমিনের একচ্ছত্র মালিক মহান আল্লাহতায়ালার প্রেরিত সর্বশেষ নবী। মহাবিশ্বের মহাবিস্ময় মহাগ্রন্থ আল্-কোরআন অবতীর্ণ হয়েছে এই মহান মানুষটির উপর। ‘এ (কোরআন হচ্ছে) মানবজাতির জন্যে পথের দিশা, সৎ পথের সুস্পষ্ট নিদর্শন ও (হক বাতিলের) পার্থক্যকারী-সূরা বাকারা আয়াত- ১৮৫। অন্যত্র মহান রাব্বুল ইজ্জত বলেন, ‘অবশ্যই কোরআন এক মর্যাদাবান গ্রন্থ, এটি লিপিবদ্ধ রয়েছে একটি (সযতেœ) রক্ষিত গ্রন্থে, যাদের পূত পবিত্র বানানো হয়েছে-তারা ব্যতিরেকে তা কেউই স্পর্শ করে না এবং (তা) নাযিল করা হয়েছে সৃষ্টিকুলের রব আল্লাহতায়ালার কাছ থেকে- সূরা আল ওয়াক্বেয়াহ আয়াত- ৭৭, ৭৮, ৭৯, ৮০।

বিশ্বনবী ছিলেন পৃথিবীর ইতিহাসে অন্যতম প্রভাবশালী, রাজনৈতিক, সামাজিক ও ধর্মীয় নেতা। বেগুনাহ্গার রাসূল (সা.) এর উক্ত বিশেষত্বের অন্যতম কারণ হচ্ছে: আধ্যাতিœক ও জাগতিক উভয় জগতে চূড়ান্ত সফলতা অর্জন। তিনি ধর্মীয় জীবনে যেমন সফল তেমনি রাজনৈতিক জীবনেও। সমগ্র আরব বিশ্বের অভাবনীয় জাগরণের পথিকৃৎ হিসাবে তিনি সবচেয়ে অগ্রগামি। বিবদমান আরব জনতাকে একীভূতকরণ তার জীবনের অন্যতম সফলতা। সাইয়্যেদিনা হযরত জিবরাইল (আ.) আল্লাহর পক্ষ থেকে যখন ওহী নিয়ে আসেন তখন রাসূল (সা.) ছিলেন হেরা পর্বতের গুহায় ধ্যানরত। তিনি দেখেন, বিশাল এক অবয়ব তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে-যাঁর মাথা আসমানের নিচে ও পা জমিনে। তিনি তা দেখে এতটুকু বিচলিত হননি। ৪০ বছর বয়সে নবুয়তপ্রাপ্তির ৩ বছর পর রাসূল (সা.) প্রকাশ্যে ওহী প্রচার করেন। ওহী প্রচারের সাথে সাথে বিশ্বনবীর উপর নেমে আসে অত্যাচারের স্টীম রোলার। এরপরও এই মহান মানুষটি দমে যান্নি এতটুকু। তিনি জানতেন, ইসলামকে প্রতিষ্ঠা করতে হলে কঠোর পরিশ্রমের পাশাপাশি কুরাইশ বংশের কাফেরদের প্রতিপক্ষ হিসাবে দাঁড়াতে হবে। যুগ যুগ ধরে চলে আসা আরবদের কুসংস্কার ও ইসলাম বিরোধী কার্যকলাপের মূল হোতা কুরাইশ কাফেরদের নেতৃত্বের ভীত ধ্বংস করা ব্যতিত ইসলাম প্রচার ও প্রতিষ্ঠা করা যাবে না। রাসূল (সা.) এর প্রথম স্ত্রী হযরত খাদিজাতুল কোবরা (রা.) ছিলেন প্রথম ইসলাম গ্রহণকারী। তিনি গোপনে দাওয়াত দিয়েছেন ৩ বছর। সাফা পর্বতের উপর দাঁড়িয়ে আল্লাহতায়ালার সর্বশ্রেষ্ঠ রাসূল (সা.) চিৎকার করে প্রকাশ্যে বলেন যে, ‘আল্লাহ ছাড়া কোন প্রভু নেই এবং মোহাম্মদ আল্লাহর রাসুল’।

এ দুর্গম পথ পাড়ি দেওয়া রাসূল (সা.) এর পক্ষে ছিল অত্যন্ত কঠিন। কুরাইশ কাফেররা বিভিন্ন প্রলোভন এর মাধ্যমে তাঁকে ইসলাম প্রচার থেকে দূরে রাখার জন্যে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়েছিল। মক্কার সর্বশ্রেষ্ঠ সুন্দরী মহিলা উপহার দেয়া, মক্কার নেতৃত্ব গ্রহণসহ অনেক লোভনীয় প্রস্তাব রাসূল (সা.) ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেছেন। রাসূল (সা.) এর চাচা হযরত হামজা (রা.) ও কুরাইশ নেতা ওমর ইবনুল খাত্তাব এর ইসলাম গ্রহণ ইসলাম প্রচারের ক্ষেত্রকে অনেক প্রসারিত করেছিল। শে’বে আবু তালিবে রাসূল (সা.) ও তাঁর অনুসারী বনু হাশিম গোত্র জেল কেটেছিলেন ৩ বছর। এরপরে রাসূল (সা.) এর জীবনে নেমে আসে ঘোর আঁধার। তাঁর প্রিয় সহধর্মিনী হযরত খাদিজাতুল কোবরা (রা.) ও চাচা আবু তালিবের ওফাত।

উক্ত দুই ঘটনার কারণে ইসলাম প্রচার ও প্রসারের ব্যাপারে বিশ্বনবী হতাশ হয়ে পড়েন। এরপর মহানবী মক্কার দূরবর্তী শহর তায়েফ গমনে সিদ্ধান্ত নেন ইসলাম প্রচারের জন্য। নবুয়তের ১০ম শাউয়াল মাস, ৬১৯ খ্রিস্টাব্দের মে মাসের শেষ অথবা জুন মাসের প্রথম দিকে নবী করীম তায়েফ গমন করেন। তিনি পায়ে হেঁটে তায়েফ আসা যাওয়া করেছেন। এসময় তাঁর সাথে ছিল মুক্তকৃত দাস জায়দ ইবনে হারেসা (রা.)। তায়েফ যাওয়ার পথে তিনি যে গোত্রের কাছ দিয়ে অতিক্রম করতেন সে গোত্রের লোকদেরকে ইসলামের দাওয়াত দিতেন কিন্তু কেউ তার দাওয়াত গ্রহণ করেনি। তিনি তায়েফে ১০ দিন অবস্থান করেন ও তায়েফের নেতৃস্থানীয় লোকদের কাছে যান কিন্তু সবার একই কথা, ‘তুমি এ শহর থেকে বেরিয়ে যাও।’ সেখানে ইসলাম প্রচার করতে গিয়ে তিনি চূড়ান্ত অপমান, ক্রোধ ও উপহাসের শিকার হন। এমনকি তায়েফের লোকজন কিশোর তরুণদেরকে আল্লাহর রাসূল (সা.) এর পিছনে লেলিয়ে দেন। তাঁরা রাসূলকে গালি দিত। তালি বাজাত। তারা ইট-সুড়কির আঘাতে আঘাতে প্রিয় নবীকে রক্তাক্ত করে দেয়। এতে তাঁর দু’পায়ের গোড়ালী রক্তাক্ত হয়ে জুতা ভিজে যায়। ওদিকে হযরত জায়েদ ইবনে হারেসা (রা.) ঢাল হিসাবে তাঁকে আগলে রাখতেন। একসময় তিনি রবিয়ার দু’ছেলে উতবা ও সায়বার বাগানে আশ্রয় নিতে বাধ্য হন, এ বাগান তায়েফ থেকে তিন মাইল দূরে অবস্থিত। ২০১৭ সালে তায়েফ ভ্রমণের সময় এ বাগানটি দেখার দুর্লভ সুযোগটা হয়েছিল। সেখানে আশ্রয় নেয়ার পর দুর্বৃত্ত বালকেরা ফিরে যায়। তিনি দেয়ালে হেলান দিয়ে আঙ্গুর গাছের ছায়ায় বসে পড়েন। কিছুটা শান্ত হওয়ার পর তিনি দোয়া করেন- যা দোয়ায়ে মোসতাদয়াফীন-দুর্বলদের দোয়া নামে বিখ্যাত। এ দোয়ার প্রতিটি বাক্য থেকে বোঝা যায়, তায়েফবাসীর খারাপ ব্যবহার, এবং তাদের কারো ঈমান না আনার কারণে রাসূল (সা.) কতটা মনে কষ্ট পেয়েছিলেন। খ্রিস্টান ক্রীতদাস আদাস রাসূল (সা.) কে আঙ্গুরের থোকা দেওয়ার পর তিনি বিসমিল্লাহ বলে হাত বাড়িয়ে তা খেতে শুরু করেন। কিন্তু তবুও তিনি হাল ছাড়েননি বরং সেখানেও তিনি ইসলাম প্রসারের সম্ভাবনার কথা চিন্তা করতে থাকেন। কিছুক্ষণ অবস্থানের পর বিশ্বনবী বাগান থেকে বেরিয়ে মক্কার পথে রওনা দেন। তিনি মানসিকভাবে ছিলেন ভীষণভাবে বিপর্যস্ত। তিনি কারণে মানাযেল নামক জায়গায় পৌঁছার পর আল্লাহর নির্দেশে হযরত জিবরাইল (আ.) এলেন, তাঁর সাথে পাহাড়ের দায়িত্বশীল ফেরেস্তারাও ছিলেন। তাঁরা আল্লাহর রাসূল (সা.) এর কাছে নিবেদন করেন, অনুমতি দিলে তায়েফের অধিবাসীদের দু’ পাহাড়ের মাঝখানে রেখে পিষে দিবেন। তিনি বললেন, না, আমি আশা করি আল্লাহতায়ালা তাদের বংশধরদের মধ্য থেকে এমন মানুষ সৃষ্টি করবেন, যারা শুধু এক আল্লাহর ইবাদত করবে, তার সাথে কাউকে শরীক করবে না। হযরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,. আমি রাসূলুল্লাহ (সা.) কে একদিন জিজ্ঞেস করেছিলাম, ওহুদের দিনের চেয়ে কঠিন কোন দিন আপনার জীবনে এসেছিল কি? তিনি বললেন, তোমার কওম থেকে আমি যে বিপদের সম্মুখীন হয়েছি তার মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ ছিল তায়েফের বিপদ। এছাড়াও তাঁর প্রিয় সহধর্মিনী হযরত খাদিজা (রা.) র ওফাতের ঘটনা আমার রাসূল (সা.) কে সারা জিন্দেগী কাঁদিয়েছে।

রাসূল বলতেন, ‘কেয়ামতের কঠিন দিনে যখন বন্ধু বন্ধুকে চিনবে না, পিতা পুত্রকে চিনবে না, মা তার সন্তানকে চিনবে না, পীর তার মুরীদকে চিনবে না, সেদিন আমি যেন আমার খাদিজাকে চিনতে পারি।’ রাসূল (সা.) যখন ঘরে ফিরতেন তখন ডাক দেয়ার সাথে সাথেই হযরত খাদিজা (রা.) তাঁর উপস্থিতি জানান দিত। হযরত খাদিজা (রা.) বলতেন, রাসূল (সা.) এর ডাকে যেন আমি সাথে সাথে সাড়া দিতে পারি-সেজন্যে দরজাকে বিছানা বানিয়ে জেগে থাকি। আমার রাসূল (সা.) হযরত খাদিজা (রা.) কে এত ভালবাসতেন যে, খাদিজার কথা বলতেই তিনি কেঁদে দিতেন। হযরত মা আয়েশা সিদ্দিক (রা.) একবার বলেই ফেলেছিলেন, হে রাসূল (সা.) কোন্ জাহেলী এক যুগের বুড়ী মহিলাকে আপনি বিয়ে করেছেন-তার জন্য এখনো আপনার মন কাঁদে, প্রাণ কাঁদে। এ কথা শুনে রাসূল (সা.) প্রচন্ড রেগে গিয়েছিলেন। হযরত আয়েশা (রা.) কর্তৃক বর্ণিত। তিনি বলেন, খাদীজার প্রতি আমার যতটা ঈর্ষা হত ততটা ঈর্ষা নবী করীম (সা.) এর অন্য কোন স্ত্রীর প্রতি হত না। (অথচ) নবী করীম (সা.) আমাকে বিবাহ করার পূর্বেই তিনি (খাদীজা) মৃত্যুবরণ করেছিলেন। এর কারণ হল, আমি নবী করীম (সা.) কে প্রায়ই তাঁর কথা আলোচনা করতে শুনতাম এবং আল্লাহ নবী করীম (সা.) কে আদেশ করেছিলেন, তিনি যেন তাঁকে (খাদীজাকে) পরকালে একটি মণিমুক্তা খচিত প্রাসাদের সুখবর দান করেন। আর (নবী করীম (সা.) এর অভ্যাস ছিল) যখনই তিনি বকরী যবেহ করতেন তখনই তা হতে খাদীজার বান্ধবীদের জন্য যথেষ্ট পরিমাণ (গোশত) হাদিয়াস্বরূপ প্রেরণ করতেন, সহিহ্ বোখারী শরীফ -৩৫৩৭।

ডা. মোহাম্মদ ওমর ফারুক সভাপতি, রাউজান ক্লাব, জুনিয়র কনসালটেন্ট (ইএনটি), জেনারেল হাসপাতাল, রাঙ্গামাটি ফৎড়সধৎভধৎড়ড়শ@মসধরষ.পড়স

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট