চট্টগ্রাম শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪

পবিত্র রমজানে ভেজাল ও ব্যবসায়িক প্রতারণা

চাই কঠোর শাস্তির পদক্ষেপ

১৬ মে, ২০১৯ | ২:১০ পূর্বাহ্ণ

জনউদ্বেগ, উচ্চআদালতের জিজ্ঞাসা এবং ভ্রাম্যমাণ আদালতের তৎপরতা সত্ত্বেও খাদ্যদ্রব্যে ভেজালের প্রবণতা রোধ করা যাচ্ছে না। বরং দুর্বৃত্তদের তৎপরতা দিনদিন বেড়েই চলেছে। আইনের কঠোর প্রয়োগ ও জনসচেতনতার অভাবে দুর্বৃত্তরা চরম বেপরোয়া হয়ে উঠছে। তারা নানা কায়দায় মুনাফা লুঠতে গিয়ে জনস্বাস্থ্যকে ভয়ানক হুমকির মধ্যে ঠেলে দিচ্ছে। শনিবার দৈনিক পূর্বকোণে প্রকাশিত এ সংক্রান্ত এক প্রতিবেদন বলছে, পবিত্র মাহে রমজানকে ঘিরে এখন ভেজালে ভেজালে সয়লাব বাজার। কিন্তু সরকারি মান নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস এন্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন (বিএসটিআই)সহ ভেজাল প্রতিরোধে দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থাগুলোর তৎপরতা আশাব্যঞ্জক নয়। তারা নানা অজুহাতে ভেজালকারীদের বিরুদ্ধে জোরালো পদক্ষেপ নিচ্ছে না। এতে সাধারণ ভোক্তারা একদিকে যেমন প্রতি মুহূর্তে প্রতারিত হচ্ছেন, অন্যদিকে তারা রয়েছেন মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকিতে। সংগতকারণে ভেজালকারী ও ভেজালপণ্যের ব্যবসায়ীদের দৌরাত্ম বৃদ্ধির খবরটি খুবই উদ্বেগকর।
উল্লেখ্য, দেশের বাণিজ্যিক রাজধানী খ্যাত বন্দরনগরী চট্টগ্রামে দীর্ঘদিন থেকেই ভেজালপণ্যের কারবারিরা তৎপর। নানা সময়ে এদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালিত হলেও কার্যত কাক্সিক্ষত ফল আসেনি। অভিযান বন্ধ হলেই ভেজালপণ্যের ব্যবসায়ীরা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। এখন পবিত্র রমজান মাসকে কেন্দ্র করে তাদের দৌরাত্ম্য অস্বাভাবিক বেড়ে গেছে। তারা খাদ্যে ভেজাল দিচ্ছে। মিনারেল ওয়াটারের নামে বিক্রি করছে দূষিত পানি। হাসপাতাল ও প্যাথলজিক্যাল ল্যাবে ব্যবহার করছে মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ। বিউটি পার্লার থেকেও মেয়াদোত্তীর্ণ প্রসাধনী সামগ্রী উদ্ধারের খবর মিলছে। বিভিন্ন প্রতিবেদন বলছে, ভেজালকারীদের ছোবল থেকে ইফতারি পণ্যও বাদ যাচ্ছে না। ইফতারি পণ্যে ক্ষতিকর রং এবং অস্বাস্থ্যকর উপকরণের ব্যবহার ঘটছে অহরহ। ইফতারের অপরিহার্য পাঁচটি সামগ্রী ছোলা, পিঁয়াজু, বেগুনি, মুড়ি ও জিলাপির প্রতিটিতেই মেশানো হচ্ছে ভেজাল। মুড়ি আকারে বড় ও সাদা করতে ব্যবহৃত হচ্ছে ট্যানারির বিষাক্ত রাসায়নিক সোডিয়াম হাইড্রোসালফাইড। বেগুনি, পিঁয়াজু, চপ কিংবা জিলাপিতে ব্যবহৃত হচ্ছে টেক্সটাইল কালার। এসব খাবার খেয়ে সাধারণ মানুষ নানা রোগব্যাধিতে আক্রান্ত হচ্ছে। পাবলিক হেলথ ইনস্টিটিউটের খাদ্য পরীক্ষাগারের তথ্যানুযায়ী, দেশের ৫৪ ভাগ খাদ্যপণ্য ভেজাল ও দেহের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর বলে চিহ্নিত হয়েছে। বিভিন্ন গবেষণা রিপোর্ট বলছে, শুধু ভেজাল খাদ্য গ্রহণের ফলে দেশে প্রতি বছর প্রায় ৩ লাখ লোক ক্যান্সারে আক্রান্ত হচ্ছে। ভেজালখাদ্য গ্রহণে প্রতিবছর দেড় লাখ লোক ডায়াবেটিসে এবং দুই লাখ লোক আক্রান্ত হয় কিডনি রোগে। ভেজালখাদ্য গ্রহণে গর্ভবতী মায়ের শারীরিক জটিলতার পাশাপাশি ১৫ লাখ শিশু জন্ম নেয় শারীরিক বিকলাঙ্গতা নিয়ে। আরো নানা রোগে আক্রান্ত হয় মানুষ। ভেজালখাদ্য গ্রহণে শারীরিক ক্ষতির এই চিত্রটি খুবই উৎকণ্ঠাপূর্ণ বলতে হবে।
মুনাফালুঠেরার দল শুধু খাদ্যে ভেজাল দিচ্ছে তা নয়, ওজনেও কম দিচ্ছে। একইসঙ্গে বিভিন্ন চটকদার বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে দুর্বোধ্য নানা শর্তের বেড়াজালে আটকিয়ে সেবা প্রদানকারী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানও ভোক্তাদের ঠকাচ্ছে। এ থেকে পরিস্কার যে, সাধারণ ভোক্তারা আর্থিক এবং স্বাস্থ্যগত সবদিক দিয়েই প্রতারিত ও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। শুধু চট্টগ্রাম মহানগর নয়, বিভিন্ন মফস্বল এলাকায়ও ভেজালের রাজত্ব চলছে। তবে বিএসটিআই, জেলাপ্রশাসন, নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষসহ সব সংস্থা তৎপর হলে এবং তাদের কাজে সমন্বয় থাকলে ভেজালকারী লুঠেরারা বেপরোয়া হওয়ার সুযোগ পেতো না। একইসঙ্গে আইনের কঠোর প্রয়োগ ও ভোক্তাসাধারণকে সচেতন করার বলিষ্ঠ কর্মসূচি থাকলে ভেজালকারীদের দৌরাত্ম্য অনেকটাই কমে যেতো। উল্লেখ্য, আইনে খাদ্যে ভেজাল দেয়া এবং ভেজাল খাদ্য বিক্রির সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদ-ের বিধান রাখা হয়েছে। কিন্তু আইনের সর্বোচ্চ বিধানে শাস্তির নজির নেই। এতে ভেজালকারীরা বেপরোয়া হয়ে উঠছে। পরিণামে ভোক্তাসাধারণ চরমভাবেই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। দেশস্বার্থে এই চিত্রের অবসান হওয়া জরুরি। আমরা মনে করি, ক্রেতা-ভোক্তার স্বার্থ রক্ষায় রাষ্ট্রকে সোচ্চার হওয়ার বিকল্প নেই। দ্রব্যে ভেজালকারী, নানা প্রলোভন দেখিয়ে জনগণের টাকা আত্মসাৎকারী, মুনাফাশিকারী সিন্ডিকেটসহ ভোক্তাসাধারণের অনিষ্টকারীদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রকে প্রয়োজনীয় আইন প্রণয়ন করে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। এসব অশুভ চক্রের ব্যাপারে রাষ্ট্র নির্লিপ্ত থাকলে নাগরিকসমাজই শুধু ক্ষতিগ্রস্ত হবে না, সরকার ও রাষ্ট্রকেও তার চরম খেসারত দিতে হবে। অশুভচক্রের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেয়ার পাশাপাশি ভোক্তাসাধারণকে তাদের সংবিধানস্বীকৃত আইনসম্মত অধিকারের ব্যাপারে সচেতন করার সুচিন্তিত কর্মসূচিও থাকতে হবে।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট