চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

নিউমোনিয়া ও তার প্রতিকার

অধ্যক্ষ ডা. রতন কুমার নাথ

১৬ মে, ২০১৯ | ২:০৯ পূর্বাহ্ণ

ফুসফুস প্রদাহকেই আমরা সাধারণত নিউমোনিয়া বলে থাকি। ফুসফুস তন্তুর তরুণ প্রদাহ হয় এরোগে। এটা দু’টি শ্রেণীতে বিভক্ত। একটি লোবার নিউমোনিয়া অন্যটি লোবিউলার নিউমোনিয়া। একে আবার বঙ্কোনিউমোনিয়াও বলে।
লোবার নিউমোনিয়ায় ফুসফুসের একটি খ- (খঙইঊ) প্রদাহযুক্ত হয়। কিন্তু লোবিউলার নিউমোনিয়ায় ফুসফুসের লোবিউল আক্রান্ত হয়। এতে ফুসফুসের বায়ুনালীগুলি ও প্রদাহিত হয়। প্রাথমিক নিউমোনিয়ায় প্রায়ই ফুসফুসের খ-ে প্রদাহ হয়। কিন্তু নিউমোনিয়ায় স্ট্রেপটোকক্কাস নামক জীবাণুই প্রদাহের কারণ। এছাড়া আরও নানাবিধ জীবাণু হতে এরোগ সৃষ্টি হয়ে থাকে।
এ রোগে সাধারণত চারটি অবস্থা পর পর দেখা দেয়। যেগুলি ১) রক্তাধিক্য : এটা প্রাথমিক অবস্থা। এতে আক্রান্ত ফুসফুসের লোব রক্তপূর্ণ, ভারী হয় এবং শক্ত হয়ে যায়। সাধারণত এটা কয়েক ঘণ্টা স্থায়ী হয়। আবার কোন কোন ক্ষেত্রে এ অবস্থা ২/৩ দিন ও স্থায়ী হয়ে থাকে। ২) কনসোলিডেশান : প্রথম অবস্থার পর এটা দ্বিতীয় অবস্থা। এ অবস্থায় আক্রান্ত ফুসফুসটি আয়তনে খুব বেড়ে যায়। ভারী নিরেট ও ভঙ্গুর হয়। এ অবস্থাটাকে রেড হেপাটাইজেশান বলে। এ অবস্থা ১০ থেকে ১২ দিন স্থায়ী হয়।
৩) গ্রে-হেপাটাইজেশান : রোগ ক্রমশ অগ্রসর হয়ে তৃতীয় অবস্থায় আসে। এ অবস্থায় আক্রান্ত ফুসফুসটির রঙ ক্রমশ ধুসর হয়ে ভারী ও নিরেট এবং ফুসফুস থেকে যে রস বের হয় তা ক্রমশ পুঁজে পরিণত হয়। এ অবস্থা বেশী দিন থাকলে ফুসফুসের কোন কোন অংশ ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। এ অবস্থা খুবই সাংঘাতিক। অধিকাংশ রোগী এ অবস্থায় মারা যায়।
৪) শোষণ বা জঊঝঙখটঞওঙঘ : রোগী তৃতীয় অবস্থা কোন রূপে কাটিয়ে উঠতে পারলে এ অবস্থায় বা চতুর্থ অবস্থায় আসে। একে প্রকৃতপক্ষে আরোগ্য অবস্থা বলা চলে। এ সময় রোগীর জ¦র কমে আসে, আক্রান্ত ফুসফুস হতে নিঃসৃত রস শোষিত হয় এবং বাকিটা কাশির সাথে বেরিয়ে যায়। এ অবস্থাটাকে শোষণ বলা হয়। হোমিওপ্যাথি ওষুধ দিয়ে এ শোষণ কাজ খুব সফলতার সাথে সম্পন্ন করা যায়।
প্রায় ক্ষেত্রেই হঠাৎ ঠা-া লেগে রোগীর সর্দি, কাশি, জ¦র শুরু হয়। ঠা-া ভাব এবং কাঁপুনি ভাবই খুব প্রবল দেখা যায়। এ সময় শিশুদের আক্ষেপও হতে পারে। সেসময় বমিও থাকে। জ¦রের সঙ্গে ভীষণ মাথাব্যথা এবং বুক ব্যথা হবে। প্রথম থেকেই কাশি থাকবে। জ¦র খুব বাড়তে থাকবে। এবং ১০৩০ থেকে ১০৫০ পর্যন্ত বাড়তে পারে।
জ¦র সহজে ছাড়ে না। ১ম ৭দিন জ¦র লেগেই থাকে। মুখম-ল লাল হবে। অস্থিরতা থাকবে শ^াস প্রশ^াসের পরিবর্তন খুব দ্রুত হবে। নাড়ির গতি একশ-দুশের বেশী হলে খুবই সাবধান হতে হবে। নাড়ির গতি এর চাইতে বাড়লে অর্থাৎ ১২০ এর দিকে গেলে হঠাৎ রোগী মারা যেতে পারে।
রোগের প্রথমেই শ্লেষ্মা অনেক সময় বের হয় না। জিব শুকনো ও বাদামি রঙের মত হয়। প্রস্রাব কমে গিয়ে গাঢ় রক্তবিশিষ্ট হয়, তাতে ক্লোরাইড নামে রাসায়নিক পদার্থ কমে যায়। নিউমোনিয়া রোগীর রক্তে শে^তকণিকা খুব বেশী বেড়ে যায়। জ¦রের সাথে প্রায়ই প্রলাপ থাকে। ৭/৮ দিন পর জ¦র হঠাৎ নেমে গিয়ে রোগী ভীষণ অবসন্ন হয়ে পড়ে।
এটা অত্যন্ত সংকট কাল। ৩/৪ঘণ্টার মধ্যে জ¦র হঠাৎ নেমে গিয়ে ৯৬০ বা ৯৭০ তে নেমে যেতে পারে। সংকটকালের ন্যায় নিউমোনিয়ায় একটি কথা চলতি আছে সেটা হচ্ছে লাইসিস বা রোগের ক্রমশ হ্রাস প্রাপ্তি। ব্রঙ্কোনিউমোনিয়ায় জ¦র অনেক সময় ৫ দিনে কোন কোন ক্ষেত্রে ৭ দিন বা ৯ দিন লাগতে পারে।
রোগ সারলেই নিউমোনিয়ার রোগী সম্পূর্ণ সুস্থ হলে গেল এ ধারণা করা ভুল। কারণ, নিউমোনিয়ার পরবর্তী বহু উপসর্গ উপস্থিত হতে পারে। যেমন ক) বিলম্বিত গাত্রতাপ বা উঊখঅণঊউ ঋঊঠঊজ হতে পারে। খ) প্লুরিসি দেখা দিতে পারে। গ)ভ্রাম্যমান নিউমোনিয়ার মত যা অনেক সময় ফুসফুসের একটি লোব ছেড়ে অন্য লোবে বিস্তার লাভ করে। ঘ) রক্তদূষণ বা সেপটিসিমিয়া দেখা দিতে পারে। ঙ) পেরিকারডাইটিস এর মত উপসর্গ দেখা দিতে পারে। অর্থাৎ বক্ষে পুঁজ হয়ে এ উপসর্গটি উপস্থিত হয়। এতে হৃদপিন্ডের শব্দ ক্ষীণ হয়ে ডান প্রকোষ্ঠের প্রসারণ। শ^াসকষ্ট সহ নীল বর্ণ হয়ে অবশেষে রোগী হার্টফেল করতে পারে। চ) নিউমো-টাইফয়েড এর মত অনেক সময় হতে পারে। দুর্বলতা, প্রলাপ, উদরাময় হয়ে জিহ্বা শুকিয়ে যায়।
এসব সন্ধিক্ষণের অবস্থায় বিপদের সম্ভাবনা বেশী থাকে। এবং আরোগ্য হতে দেরী হয়। ছ) কর্ণরোগের মত হয়ে মধ্যকর্ণ আক্রান্ত হতে পারে। কানে পুঁজ হতে পারে এবং কানের পুঁজ ভাল হলেই জ¦র কমতে থাকে। এছাড়াও জ) মস্তিষ্কের ঝিল্লিপ্রদাহ ঝ) অন্ত্রাবরক ঝিল্লিপ্রদাহ ও ঞ) অস্থি সন্ধিপ্রদাহও হতে পারে।
নিউমোনিয়া খুবই সাংঘাতিক রোগ। আগে এ রোগের মৃত্যুর হার খুব বেশী ছিল। খুব বিচক্ষণতার মধ্য দিয়ে চিকিৎসা না হলে মৃত্যু হার কমানো সম্ভব নয়। হাম বা বসন্তের পর নিউমোনিয়া হলে চিকিৎসা খুব কঠিন। নিউমোনিয়ায় ব্যবহৃত হোমিওপ্যাথিক ওষুধ ভালভাবে বেছে নিয়ে সৌসাদৃশ্যে প্রয়োগ করলে ভাল ফল দেয়। ব্যবহৃত ওষুধ এর মধ্যে ১) একোনাইট, ২) জেলসিমিয়াম ৩) কেরাম ফস, ৪) ইপিকাক, ৫) এন্টিমটার্ট, ৬) ফসফরাস ৭) কেলি মিউর, ৮) ব্রায়োনিয়া, ৯) ভেরেট্রাম উল্লেখযোগ্য। এছাড়াও ১০) সালফার ১১) টিউবারকুলিনাম ও ১২) লাইকোপোডিয়াম বিশেষ বিশেষ রোগীর ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। তারপরেও চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট