চট্টগ্রাম বুধবার, ২৪ এপ্রিল, ২০২৪

মহান বিজয় দিবস

১৬ ডিসেম্বর, ২০১৯ | ৩:৪৫ পূর্বাহ্ণ

আজ বাঙালি জাতির শ্রেষ্ঠ গৌরব এবং অহঙ্কারের অনন্য দিন মহান বিজয় দিবস। ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের এই দিনে দীর্ঘ নয় মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ শেষে ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) আত্মসমর্পণ করেছিল পাকহানাদার বাহিনী। আর এর মধ্য দিয়েই বিশে^র রাজনৈতিক মানচিত্রে অভ্যুদয় ঘটে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র বাংলাদেশের। ৪৮ বছর আগে এই দিনে স্বাধীন বাংলা বেতার থেকে প্রচারিত হয়েছিল নয় মাসের যুদ্ধ শেষের গান। সমবেত কণ্ঠে শব্দসৈনিকরা গেয়ে উঠেছিলেন, ‘বিজয় নিশান উড়ছে ওই, বাংলার ঘরে ঘরে, মুক্তির আলো ওই জ্বলছে।’ সেই আলোর ঝর্ণাধারায় বিশ^মানচিত্রে প্রজ্বলিত হয় বাংলাদেশ। সংগতকারণে এ দিনটি আমাদের জাতীয় জীবনে সবচেয়ে আনন্দের ও গৌরবের; একইসঙ্গে অহঙ্কারের, আত্মমর্যাদার ও আত্মোপলব্ধির। বিজয়ের এই দিনে স্বাধীনতার মহানায়ক জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি জানাই আমাদের অকুণ্ঠ শ্রদ্ধা। তার সঙ্গে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি তাদের, যাদের অমূল্য জীবনের বিনিময়ে আজ আমরা স্বাধীন স্বদেশভূমি পেয়েছি।

গৌরবময় বিজয়ের এই দিনটি অর্জনের পেছনে রয়েছে ৩০ লাখ শহীদের মহামূল্যবান প্রাণ, দুই লাখ মা-বোনের ইজ্জত এবং অগণিত মানুষের সীমাহীন আত্মত্যাগ। আমরা আজ গভীর শ্রদ্ধায় স্মরণ করি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং মুক্তিযুদ্ধের মহান শহীদদের; যেসব মা-বোন ভয়াবহ নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন, তাদের; আর যারা ভোগ করেছিলেন সীমাহীন দুর্ভোগ, সেসব দেশপ্রেমিক বাঙালিকে। বাঙালি জাতির আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক অধিকার আদায়ের সংগ্রামে, সর্বোপরি বাঙালি জাতির হাজার বছরের লালিত স্বপ্ন স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে সফল নেতৃত্ব দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বাঙালি জাতিকে তিনি স্বাধীনতার মহামন্ত্রে উজ্জীবিত করে তুলেছিলেন। সুদীর্ঘ ২৩ বছরের পাকিস্তানিদের অত্যাচার-নিপীড়ন আর সীমাহীন বঞ্চনার শৃঙ্খল ভেঙে বেরিয়ে আসার অমোঘ বাণী বজ্রনির্ঘোষ কণ্ঠে ঘোষণা করেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। রমনা রেসকোর্স ময়দানে ৭ মার্চের ঐতিহাসিক জনসভায় বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। জয় বাংলা।’ ২৫ মার্চ গভীর রাতে বাঙালি জনগণের ওপর অত্যাধুনিক মারণাস্ত্র নিয়ে পাকসেনারা ঝাঁপিয়ে পড়লে বঙ্গবন্ধু চূড়ান্তভাবে স্বাধীনতা ঘোষণা করে দেশবাসীকে যার যা আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে এবং প্রতিবেশী রাষ্ট্রসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে এই বর্বরতার নিন্দা এবং বাংলাদেশের পক্ষে সাহায্য ও সহযোগিতার উদাত্ত আহ্বান জানান। এরপরই তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। বাঙালি জাতি বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনায় যুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়ে। শেষ পর্যন্ত একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর অর্জন করে কাক্সিক্ষত বিজয়।

মহান মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের পর একরাশ স্বপ্ন বুকে ধারণ করে জাতির জনকের নেতৃত্বে যাত্রা শুরু হয়েছিল স্বাধীন বাংলাদেশের। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকে পুনর্গঠন করে উন্নয়ন-সমৃদ্ধির পথে নিয়ে যেতে বঙ্গবন্ধু নানামাত্রিক কর্মসূচি গ্রহণ করেছিলেন। স্বপ্ন পূরণের সে যাত্রায় তিনি সফলও হয়েছিলেন অনেকটাই। কিন্তু স্বাধীনতাবিরোধী ঘাতকচক্র তা বরদাস্ত করতে পারেনি। নির্মম কায়দায় তাঁকে সপরিবারে হত্যা করে দেশ-উন্নয়নের গতিপথ রুদ্ধ করে দিয়েছিল। এরপর দীর্ঘদিন দেশ পেছনের দিকে হেঁটেছে। তবে বঙ্গবন্ধুকন্যা দেশ পরিচালনার দায়িত্ব পাওয়ার পর দেশ পুনরায় উন্নয়ন-সমৃদ্ধির পথে হাঁটতে শুরু করে। বিভিন্ন সুচিন্তিত পদক্ষেপের ফলে নানা উন্নয়নসূচকে দেশ এগিয়ে যেতে থাকে। দারিদ্র্যবিমোচন, নারীর ক্ষমতায়ণ, শিশু ও নারীর মৃত্যুহার রোধ, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নসহ নানা ক্ষেত্রে দৃষ্টান্তমূলক সাফল্য অর্জন করে বাংলাদেশ। দেশে দারিদ্র্যের হার কমেছে কাক্সিক্ষত মাত্রায়। জীবনযাত্রার মান হয়েছে উন্নত। প্রায় সবদিক দিয়েই এগিয়ে গেছে বাংলাদেশ। এখন সারাবিশে^র কাছে বাংলাদেশ উন্নয়নের রোল মডেলে পরিণত হয়েছে। ২০৪১ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে দেশ উন্নত দেশের কাতারে সামিল হওয়ার মহাপরিকল্পনা নিয়ে এগুচ্ছে। জাতিসংঘ ঘোষিত উন্নয়ন অভিষ্ট এমডিজিতে বাংলাদেশ চমৎকার পারঙ্গমতা দেখিয়েছে। এখন টেকসই উন্নয়ন অভিষ্ট (এসডিজি) পূরণে কাজ করছে। এক সময় যারা বাংলাদেশকে ‘তলাবিহীন ঝুরির দেশ’ বলে ঠাট্টা করতো, তারা এখন উন্নয়নের মহাসড়ক ধরে বাংলাদেশের এগিয়ে যাওয়া দেখে বিষ্ময়ে হতবাক। তবে নানাক্ষেত্রে আমরা আকাশছোঁয়া সাফল্য লাভ করলেও ব্যর্থ হয়েছি রাষ্ট্রের সবক্ষেত্রে সুশাসন প্রতিষ্ঠায়। দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরকারের নানামাত্রিক পদক্ষেপ থাকলেও কাক্সিক্ষত সাফল্য আসেনি এখনো। রাজনৈতিক অঙ্গনে গভীর বিভক্তির পাশাপাশি জাতীয় প্রশ্নে অনৈক্য আমাদের টেকসই এগিয়ে যাওয়ার পথে বড় বাধা হয়ে রয়েছে। এ অবস্থায় মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার লক্ষ অর্জনে সম্মিলিত প্রচেষ্টার বিকল্প নেই। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় নতুন প্রজন্মকে গড়ে তোলার দায়িত্বও নিতে হবে। এবারের বিজয় দিবসে আমাদের শপথ হোক সকল ষড়যন্ত্রের অর্গল ভেঙে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়ার। আজ থেকে রাষ্ট্রীয় সব অনুষ্ঠানের শুরুতে ও শেষে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ব্যক্তিসহ সব বক্তাকে ‘জয় বাংলা’ বলতে হবে বলে অভিমত দিয়েছেন হাইকোর্ট। ‘জয় বাংলা’কে জাতীয় স্লোগান ঘোষণা সময়োচিত। এতে একাত্তরের মতো জাতি ঐক্যবদ্ধ হওয়ার সুযোগ তৈরি হবে। আমাদের বিশ^াস এ ব্যপারে সবারই ইতিবাচক মনোভাব থাকবে। বিশ্বের মানচিত্রে বাংলাদেশকে সগৌরবে প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যই হোক বিজয় দিবসের অঙ্গীকার।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট