চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

মহান বিজয় দিবস : চেতনা বিকাশের দিন

রোকেয়া হাসনাত

১৬ ডিসেম্বর, ২০১৯ | ৩:৪৫ পূর্বাহ্ণ

প্রতিবছর ১৫ ডিসেম্বর বিকেল গড়াতেই প্রস্তুতির ধুম পড়ে যায় নগরে, মহল্লায়, গ্রামে-গঞ্জের অলিতে-গলিতে। দলবেঁধে ছেলেমেয়েরা ব্যস্ত হয়ে পড়ে ফুলের তোড়া বানাতে। সঙ্গে থাকে বড়দের উৎসাহ এবং সহযোগিতা। উৎসবের রঙিন এক আভা যেনো চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। সবার মধ্যে এক ধরনের সাজ সাজ রব। নগরের প্রাণকেন্দ্রে নির্মিত বিজয়ের স্মৃতিসৌধের বিশাল এক রেপ্লিকা। রাত বারোটার পর থেকে সকাল পর্যন্ত সেখানে চলবে স্মৃতিসৌধে ফুল অর্পণ করা। কে কার আগে ফুলের তোড়াটি স্মৃতিসৌধে নিবেদন করবে কিংবা কার ফুলের তোড়াটি কতটা সুন্দর হয়েছে এ নিয়েও যেনো নীরব প্রতিযোগিতা চলবে। প্রতিটি গলির মাথায় তরুণ-তরুণীরা সাউন্ড সিষ্টেমে বাজিয়ে যাবে দেশাত্মবোধক গান। সে যেনো বাঙালির অন্যরকম আবহ। ১৬ ডিসেম্বর নিয়ে প্রতিবছরই শুরু হয় এমন উৎসাহ-উদ্দীপনা। বিজয়ের দিনটিকে কেন্দ্র করে দেশজুড়ে বয়ে যায় আনন্দের জোয়ার। এ দিনকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও স্বেচ্ছাসেবক সংগঠনগুলো নানা ধরনের আয়োজন করে।

বিজয়ের আনন্দে আন্দোলিত হয়ে সৃজন করে চমকপ্রদ সব উৎসবের। আর তরুণ প্রজন্মই এর মূল প্রাণশক্তি। সেই ১৯৭১ সালে পাক হানাদার বাহিনীর কাছ থেকে বিজয় ছিনিয়ে আনতে বাঙালি তরুণ যুবক যেমন মূখ্য ভূমিকা রেখেছিলো, ঠিক তেমনটি আজো তার সম্মান অক্ষুণœ রাখতে কাজ করে যাচ্ছে এই প্রজন্মরা। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সেই বিজয় আজো আমাদের প্রেরণা যোগায়। আশা জাগায় নতুন করে পথ চলার। দীর্ঘ নয়মাস একাত্তরের সেই সময়ে বাংলাদেশ জুড়ে যে ভয়ঙ্কর বর্বরতা ঘটেছিলো তা অনুমান বা পরিমাপ করা দুঃসাধ্য ব্যাপার। শুধু একটি বাঙালি পরিবারের হিসেবে লাভ-ক্ষতি কষতে গেলে বোঝা যায়, কি হারিয়েছি আমরা। সত্যিকার অর্থে, কি ধরনের ত্যাগ করতে হয়েছে ১৯৭১ সালে। তারপরেও সান্ত¡না, এতো বিসর্জনের মধ্যে দিয়েও অর্জন করতে পেরেছি মুক্ত স্বাধীন, সার্বভৌম এক দেশ। যে বাংলাদেশ আজ বিশে^র দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার অক্লান্ত পরিশ্রমে, ক্ষুধা ও দারিদ্রমুক্ত বাংলাদেশ হিসেবে। আর এসবই এসেছে মুক্তিযুদ্ধের মহান বিজয়ের কারণে। আজো আমরা স্বপ্ন দেখে চলেছি। বাংলায় বহুল প্রচলিত এক প্রবাদ বাক্য হচ্ছে ‘যার যায় সেই বোঝে’। যে ব্যক্তি তার প্রিয় কিছু হারিয়ে ফেলে সে ছাড়া সে বেদনা অন্য কেউ সেভাবে বোঝা না। আমাদের দেশে শহীদ পরিবারের অবস্থা সেই রকম। যে তার সন্তান, পরিবার-পরিজন হারিয়েছে সেই বোঝে হৃদয়ের রক্তক্ষরণ, আমরা দূর থেকে তাদের যতই সান্ত¡না দেয়ার চেষ্টা করি না কেন সে ব্যথা লাঘব করা সম্ভব নয়। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে কত মায়ের কোল যে খালি হয়েছে, কত সন্তান তার বাবা-মাকে হারিয়েছে তা হিসেবের বাইরে। এই পরিবারগুলোর কান্না আজো থামেনি। কারণ, তারা স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করেছে, নৃশংসতা কি জিনিষ। একই দেশে বেড়ে ওঠা এক ভাই, আরেক ভাইয়ের প্রাণ কতটা নির্মমভাবে নিতে পারে। কিভাবে স্বদেশের মা-বোনদের পাক হায়েনার হাতে তুলে দিতে পারে? এই নির্মমতার স্মৃতি মন থেকে মুছে ফেলার নয়। চাপাকষ্ট মনের ভেতরে লালন করা ছাড়া আর কিছুই যেনো করার থাকে না শহীদ পরিবারের। শুধু এই ভেবে আশায় বুক বেঁধেছে তারা, এই ত্যাগের বিনিময়ে একটা স্বাধীন দেশতো পেয়েছে। এই যেনো অনেক বড় পাওয়া।

১৯৭১ সালে দীর্ঘ নয় মাস সংগ্রাম করে পাক হানাদারের কাছ থেকে বাঙালিদের ছিনিয়ে নিতে হয়েছে লাল-সবুজের পতাকা। সেই পতাকার জন্য প্রাণ দিতে হয়েছে লাখো শহীদের। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিশ^ নতুনভাবে দেখেছে এক নতুন পতাকা। লাল-সবুজের পতাকা। ২০১৩ সালে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় পতাকা রূপে এই লাল-সবুজ পতাকা বিশ^ রেকর্ড গড়েছে। বাংলাদেশে ঢাকার ৬৪টি স্কুল, আট হাজার সেনা সদস্য এবং কয়েক হাজার স্বেচ্ছাসেবী সদস্যদের মিলিত প্রয়াসে প্রস্তুত হয়েছে পৃথিবীর সবচেয়ে মানব পতাকা। এই পতাকা গিনেজ বুকে নিজেদের স্থান করে নিয়েছে সর্বকালের বড় পতাকার রেকর্ড হিসেবে।

বিজয়ের মাস এলেই এক ধরনের ভালো লাগা কাছ করে বাঙালির মনে। অনেক স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন সামাজিক কার্যক্রম সম্পন্ন করে। কেউ কেউ গরিব-দুঃখীদের মাঝে শীতবস্ত্র বিতরণ করে, রক্তদান কর্মসূচি সম্পন্ন করে, মিলাদ মাহফিল এবং দুঃস্থদের মাঝে খাবার বিতরণসহ নানাবিধ কার্যক্রম পরিচালনা করে। বিজয় দিবসকে কেন্দ্র করে প্রতিটি বাঙালি পরিবার নিজেদের বিভিন্নভাবে উপস্থাপনা করে। ঘরের সাজ-সজ্জায় নিয়ে আসে বিজয়ের আভা। পোষাক-পরিচ্ছেদে ফুলে ওঠে বিজয়ের ছাপ। পবিরারের সবাই একসঙ্গে খাওয়া-দাওয়া, ঘুরে বেড়ানো, মেলা-পার্বন, উৎসব সবকিছুই যেনো বিজয়ের আনন্দকে বহুগুণে বাড়িয়ে দেয়। বিজয়ের অনেক বছর পরেও দেশকে আরো সুন্দরভাবে এগিয়ে নিতে, হাতে হাত রেখে কাছ করতে হবে আমাদের সবাইকে। যে কোন মূল্যে রুখে দিতে হবে অপশক্তি-এটি হোক প্রতিজ্ঞা।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট