চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

পেঁয়াজের দাম ও বাজার অর্থনীতি

নাওজিশ মাহমুদ

১৫ ডিসেম্বর, ২০১৯ | ৩:৪২ পূর্বাহ্ণ

পেঁয়াজের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখা যাচ্ছিল না। সরকার আপ্রাণ চেষ্টা করেও পেঁয়াজের দাম কমাতে সফল হচ্ছিল না। অবশেষে দাম কিছুটা কমলেও এখনও স্বাভাবিক হয়নি। দেশে উৎপাদিত পেঁয়াজও বাজারে আসা শুরু করেছে। সরকার এবং সরকারের সাথে সংশ্লিষ্ট সকল প্রতিষ্ঠান আদাজল খেয়ে নেমেছিল, কেন নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না, তা খুঁজে বের করার জন্য। কেউ বলছেন সিন্ডিকেট। কেউ বলছে অতিরিক্ত মুনাফা। কেউ বলছে ভারতের কারসাজী। মহামান্য রাষ্ট্রপতি সবচেয়ে সুন্দর কথা বলেছেন, ব্যবসায়ীরা ঐক্যবদ্ধ হতে পারে, শ্রমিকরা ঐক্যবদ্ধ হতে পারে, ড্রাইভাররা ঐক্যবদ্ধ হতে পারে, বাসমালিকরা ঐক্যবদ্ধ হতে পারে, জনগণ কেন ঐক্যবদ্ধ হতে পারে না? অর্থাৎ ঐক্যবদ্ধ হয়ে পেঁয়াজ খাওয়া ছেড়ে দিবে।

খুবই সুন্দর কথা। মাথায় এতো ব্যথা বেদনা, তা রেখে লাভ কী? এই মাথাটি কেটে ফেললেই ল্যাঠা চুকে যায়। কিন্তু এটা কেউ বলে না, এটা বাজার অর্থনীতির বৈশিষ্ট্য। তার উপর একচেটিয়া পুঁজির উত্থান ঘটেছে। একচেটিয়া পুঁজি মাঝে মাঝে এভাবে জনগণকে সমস্যায় ফেলে দ্রব্যমূল্যের দাম বাড়িয়ে জনগণের পকেট থেকে অনেক টাকা হাতিয়ে নিবে। এর পূর্বে শেয়ারবাজারেও দেখেছি, একই কায়দায় জনগণের অর্থ লোপাট করতে।

কয়েকদিন এটা নিয়ে হৈ চৈ হবে। কিছুদিন পর সবাই চুপচাপ। সবাই যেন এক অদৃশ্য দানবের সাথে সেই লড়াই করছে। এই দানবের নাম হলো বাজার অর্থনীতি। সরবরাহ ও চাহিদার ভিত্তিতে মুল্য নির্ধারিত হয়। চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কমলে দাম বৃদ্ধি পাবেই। এটাই বাজার অর্থনীতির বৈশিষ্ট্য। এটাকে র‌্যাব দিয়ে, পুলিশ দিয়ে এবং প্রশাসন দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। কারণ বাজার অর্থনীতির ধর্মই হলো সরবরাহ, চাহিদা এবং মজুদের মাধ্যমে যতটুকু সম্ভব মুনাফা করা। সরকারের দায়িত্ব হচ্ছে সরবরাহ ও চাহিদার মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য বাজার নজরদারী, পর্যবেক্ষণ এবং সেই মোতাবেক কার্যক্রম গ্রহণ করা। সরকার এই ব্যাপারে উদাসীনতার পরিচয় দিয়েছে। প্রতিবছর আমাদের পেঁয়াজের যে ঘাটতি থাকে তা ভারতের পেঁয়াজ দিয়ে পূরণ করা হয়। কিন্তু ভারতেও এবার উৎপাদন হ্রাস পাওয়ায় তারা রপ্তানী বন্ধ করে দিয়েছে। তাহলে আমাদের সরকার মাথায় কেন রাখলো না, যদি কোন দিন হঠাৎ পেঁয়াজের রপ্তানী ভারতে বন্ধ করে দেয়, বিকল্প কি করতে হবে? ১/১১ এর পরও ভারত হঠাৎ চাউল রপ্তানী বন্ধ করায় একই বিপদে পড়েছিলাম। এবার পেয়াঁজ নিয়ে পড়লাম। বার বার আমরা কি একই ভুল করতে থাকবো? চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কম থাকলে কিভাবে এই পরিস্থতি মোকাবিলা করতে হবে, এই ধরনের কোন ব্যবস্থাপনা আমাদের সরকারগুলি এখনও গড়ে তুলতে পারেনি। বিশেষ করে জনগণের নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য নিয়ে এই ধরনের সংকট বার বার আসবে। কিন্তু আমরা যদি এই সংকট মোকবিলা করতে না পারি, তা হলে সরকারের প্রতি, আমাদের রাষ্ট্রব্যবস্থাপনার প্রতি জনগণের আস্থার ঘাটতি বাড়তেই থাকবে। অর্থনীতিবিদদের অনুমান জনগণের পকেট লোপাট করে ১৫০০ কোটি টাকার মুনাফা করেছে পেঁয়াজব্যবসায়ীরা। তাহলে এই ১৫০০ কোটি টাকার আয়কর সরকারের খাতে জমা হবে? কৃষিখাতে ভ্যাট নাই। খাদ্যদ্রব্যে ভ্যাট নাই। তাই ভ্যাটের কথা উল্লেখ করলাম না।
আমাদের অর্থনীতি হচ্ছে বাজার অর্থনীতি। বাজার অর্থনীতি যাতে কোন রকম পাগলামী না করে তার লাগাম টেনে ধরার জন্যে সরকারী প্রতিষ্ঠান আছে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি)। তারা কয়েকটি বড় শহরে কম দামে খোলাবাজরে বিক্রয় করে বাজার নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে। অর্থাৎ মুল্যবৃদ্ধির দানবকে সুঁই দিয়ে বাগে আনার চেষ্টা করছে। আমরা ভুলে যাই বাজার অর্থনীতির মূলকথা হচ্ছে যোগান ও সরবরাহরে উপর ভিত্তি করে মূল্য নির্ধারিত হয়। যখন কোন পণ্যের সরবরাহ ঘাটতি দেখা দেয় পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি পাবেই। তখন ব্যবসায়ীরা এই সুযোগটা কাজে লাগিয়ে মজুদ গড়ে তোলে অতিরিক্ত মুনাফার জন্য বাজারে আরো দাম বাড়িয়ে দেয়। তখন আমাদের সরকার পুলিশ দিয়ে র‌্যাব দিয়ে এই দাম বৃদ্ধিকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করেছে। যারা মজুত কররছে তার ভয়ে বাজারে পণ্য যোগান না দিয়ে হয় নষ্ট করে দেয় অথবা মাটিতে পুঁতে ফেলে বা সাগরে ফেলে দেয়। তখন দাম আরো আরো বেড়ে যায়। কারণ পেঁয়াজ পচনশীল দ্রব্য। সংরক্ষণের ভালো ব্যবস্থা নাই। তাহলে প্রশ্ন আসছে এই বাজারমূল্য কিভাবে নিয়ন্ত্রণ করবে। আমাদের উৎপাদিত পেঁয়াজে বছরে ২ থেকে ৩ লক্ষ টন ঘাটতি থাকে। পেয়াজ উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়ার জন্য সরকার কোনদিন চেষ্টাও করে নাই। কারণ বাংলাদেশের পেঁয়াজের তুলনায় ভারত থেকে বা অন্য দেশ থেকে আরো সস্তায় পেঁয়াজ আনা য়ায়। অতিরিক্ত উৎপাদন করে কৃষকরা লোকসান দিতে চাইবে না।

বাজার অর্থনীতিকে জনগণের স্বার্থে কাজে লাগাতে হলে বাজার ব্যবস্থাপনা এমনভাবে সাজাতে হবে যাতে কৃষকের পণ্য সহজে বাজারজাত এবং সংরক্ষণ করতে পারে। সেই সাথে নিশ্চিত করতে হবে কৃষকের উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য যাতে পায়। তাকে কোন অবস্থাতেই লোকসানে ফেলা যাবে না। একজন ব্যবসায়ী লোকসান করলে সে এই লোকসান কাটিয়ে উঠার সুযোগ পায়। যেহেতু তার পুুঁজির ঘাটতি নাই। পুঁজি না থাকলেও ব্যাংক বা অন্য সূত্র থেকে পুঁজি পায়। কিন্তু একজন কৃষক এই লোকসান কাটিয়ে উঠতে পারে না। কারণ আপতকালীন ব্যবস্থা মোকাবিলার জন্য তার কাছে যথেষ্ট সম্পদ থাকে না। তখন জমি বিক্রয় করে জীবন বাঁচাতে হয়। এই জন্য কৃষককে বাঁচাতে হলে পেঁয়াজের মত পচনশীল পণ্যের বাজার স্থিতিশীল রাখতে হলে এই কৃষককে বাঁচিয়ে রাখার জন্য তাঁদের বীজ, পুঁজি এবং বাজারমূল্য নিশ্চয়তার মাধ্যমে ভবিষ্যতে এই ধরণের পণ্য ঘাটতি থেকে রক্ষার ব্যবস্তা করতে হবে। যাতে অতিরিক্ত উৎপাদনে কৃষক লোকসানে না পড়ে। কৃষিজাত পণ্য ভোক্তাদেরর কাছে পৌঁছিয়ে দেয়ার জন্য সহজ ও কম খরচে পরিবহনের সুযোগ সৃষ্টি করলেও অনেক সময় পণ্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। কৃষকদের পুঁজি সমবায় ও ভোক্তাদের সমবায়ভিত্তিক দোকান পরস্পরের সহযোগিতা এই ক্ষেত্রে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। এ সমবায় দোকান কৃষকের সমবায়ের কাছ থেকে সরাসরি পণ্য ক্রয় করতে পারে। সমবায় দোকানের চাহিদামাফিক কৃষকেরা উৎপাদনে যাবে। এতে কৃষকেরা ন্যায্যমূল্য পাবে। ভোক্তাও মধ্যসত্বভোগীর হাত তেকে রক্ষা পাবে। প্রয়োজনে এই সমবায়গুলিকে সরাসরি আমদানীর সুযোগ করে দিলে ঘাটতি পূরণের মাধ্যমে মুনাফালোভী ব্যবসায়ীদের হাত থেকে ভোক্তা রক্ষা পেতে পারে।

সরকারও কৃষকদের পচনশীল পণ্যের সংরক্ষণের জন্য ব্যবস্থা করলে কৃষক এবং ভোক্তা উভয়ে উপকৃত হতো। অতিরিক্ত উৎপাদনে কৃষক লোকসানের হাত থেকে রক্ষা পেত এবং ভোক্তাও সরবরাহের ঘাটতির সময়ে অতিরিক্ত মূল্য প্রদান থেকে বেঁচে যেত। কৃষকের উৎপাদিত পণ্যের মূল্যপ্রাপ্তির জন্য আমাদের সরকারসমূহ কখনও চেষ্টা করে নি। কারণ আমাদের সরকার এখন ব্যবসায়ীদের সরকার। বাণিজ্যমন্ত্রী নিজেও একজন ব্যবসায়ী। আমাদের রাজনীতিবিদরা ব্যবসা করে। আর ব্যবসায়ীরা রাজনীতি করে। কে প্রকৃত ব্যবসায়ী আর কে প্রকৃত রাজনীতিবিদ তা খুঁজে বের করা কষ্টকর। জনগণকে এই ব্যবসায়ী রাজনীতিবদ বা রাজনৈতিক ব্যবসায়ীদের দুবৃত্তায়ন সহ্য করতে হবে। কারণ এই বাজার অর্থনীতির প্রভাবে আমাদের রাজনীতিও অর্থনীতির একটি পণ্যে রূপান্তরিত হয়েছে। যেহেতু এর যোগান বেশী কম দামে রাজনীতিবিদ কেনাবেচা করা যাচ্ছে। আবার ব্যবসায়ীর সরবরাহ বেশী তাই রাজনীতির জন্য ব্যবসায়ীর অভাব নেই। জনগণ এই ব্যবসায়ী রাজনীতিবিদদের হাত থেকে রক্ষা পেতে হলে, হয় বাজার অর্থনীতির বিকল্প খুঁজতে হবে, নতুবা বাজার অর্থনীতির মধ্যে এর সমাধান খুঁজতে হবে। বর্তমান বিশে^ বাজার অর্থনীতির বিকল্প দাঁড়াতে পারেনি। বাজার অর্থনীতি যখন একচেটিয়া পুঁজির দখলে চলে যায়, তখনই সরকারকে এর লাগাম টেনে ধরতে হয়। নতুবা সরকারের অস্তিত্ব বিপন্ন হয়ে যেতে পারে। সরকার ও একচেটিয়া পুঁজির মধ্যে যদি আঁতাত হয়ে যায় তখন জনগণ অসহায় হয়ে পড়ে। জিম্মি হয়ে পড়ে। তাই একচেটিয়া পুঁজিকে চ্যালেঞ্জ জানাতে হলে জনগণকে এগিয়ে আসতে হবে। পুঁজি দিয়ে এই পুঁজি প্রতিহত করতে হবে। একচেটিয়া পুঁজির বিরুদ্ধে জনগণ গণপুঁজি বা সামাজিক পুঁজিতে গড়ে তুলতে পারে। সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ যদি একত্রিত হয়ে এই গণপুঁজি বা সামাজিক পুঁজি গড়ে তোলে, তাহলে একচেটিয়া পুঁজিকে প্রতিহত করতে পারে। এই জন্য জনগণ পুঁজির সমবায় করে এই একচেটিয়া পুঁজির দাপট থেকে রক্ষা পাওয়ার চেষ্টা করতে পারে। কাজটা হয়তো কঠিন কিন্তু অসম্ভব নয়। কারণ একচেটিয়া পুঁজি যে ব্যবসা করে তার প্রধান ভোক্তা এই জনগণ। তারা সংখ্যায় যেমন বেশি, উৎপাদনও তারা করে।

কৃষকের উৎপাদিত পণ্যের মূল্য ব্যবসায়ীদের দয়ার উপর ছেড়ে দিলে তারা তাদের মুনাফার জন্য এই কৃত্রিম সরবরাহের যোগানের মাধ্যমে বার বার ভোক্তাদের কাছ থেকে অতিরিক্ত অর্থ হাতিয়ে নিবে। এটা শুধু বাংলাদেশ নয় গোট পৃথিবীর সমস্যা। ভারতে পেঁয়াজের দাম ২০০ রুপি ছাড়িয়েছিল। পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য সরকারের এগিয়ে আসা সবচেয়ে বেশী প্রয়োজন কিন্তু সমস্যা হচ্ছে সরকার এখন নিয়ন্ত্রণ করছে ব্যবসায়ীরা। তার সাথে যোগ হয়েছে গণবিরোধী এবং অদক্ষ আমলাতন্ত্র। জনবান্ধব রাষ্ট্রব্যবস্থাপনা বা জনগণের অংশগ্রহণমূলক রাষ্ট্রব্যবস্থাপনা এবং একচেটিয়া পুঁজির বিরুদ্ধে সামাজিক পুঁজি গড়ে তুলে জনগণকেই এই ধরনের সংকট মোকাবিলা করতে এগিয়ে আসতে হবে। নতুবা এই ধরনের মুল্যবৃদ্ধির বিড়ম্বনা বার বার সইতে হবে।

নাওজিশ মাহমুদ রাজনীতি বিশ্লেষক
ও কলামিস্ট।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট