চট্টগ্রাম মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

শ্রমিকের অধিকার মানবাধিকার

ফজলুল কবির মিন্টু

১৫ ডিসেম্বর, ২০১৯ | ৩:৪২ পূর্বাহ্ণ

১০ ডিসেম্বর আন্তর্জা তিক মানবাধি কার দিবস। ২য় বিশ্বযুদ্ধের পরে ১৯৪৮ সালের সার্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণাকে কার্যকর করার লক্ষ্যে এদিবসটি বিশ্বব্যাপী পালিত হয়ে আসছে। মানবাধিকার শব্দটিকে ভাঙ্গলে দু’টি শব্দ পাওয়া যাবে। মানব এবং অধিকার। জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত প্রতিটি মানুষের জন্মগত ও মৌলিক অধিকারসমূহ হচ্ছে মানবাধিকার। পুরুষের অধিকার, নারীর অধিকার, দাসত্ব থেকে মুক্তির অধিকার এবং শ্রমিকের অধিকার ইত্যাদিকে সামগ্রিক অর্থে মানবাধিকার বলা হয়। মানবাধিকার প্রশ্নে সমাজের অপরাপর অংশের তুলনায় শ্রমজীবী বা শ্রমিক শ্রেণিই মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার হয় সবচেয়ে বেশি।

রাষ্ট্র, প্রতিষ্ঠান ও নিয়োগকারীর নিকট বিভিন্ন আন্তর্জাতিক এবং জাতীয় ঘোষণা ও আইন দ্বারা স্বীকৃত শ্রমিকের প্রাপ্যই হচ্ছে শ্রমিকের অধিকার। চুক্তি এবং আইএলও কনভেনশন এর আলোকে গঠিত বাংলাদেশ শ্রম আইনে কর্মঘণ্টা, ছুটি, মজুরী, মজুরী পরিশোধের সময়কাল, নিরাপদ কর্মপরিবেশ ইত্যাদি বিষয়ে বিস্তারিত আলোচিত হয়েছে।
শ্রমিকের অধিকার বলতে আমরা বুঝি যা শ্রমিকদের বেতন-ভাতা, বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা এবং নিরাপদ কর্মপরিবেশ পাওয়ার নিশ্চয়তা প্রদান করে। আজকের সামাজিক, রাষ্ট্রিক বাস্তবতায় বিভিন্ন আইন, কনভেনশান, চুক্তি, সাংবিধানিক অধিকারসমূহ সংজ্ঞায়িত থাকলেও পদে পদে শ্রমিকের অধিকার লংঘনের ঘটনা অহরহ ঘটছে আমাদের সমাজে।

আমাদের দেশের মোট শ্রমিকের ৮৭ শতাংশ অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের। বিদ্যমান শ্রম-আইনে তাদের অধিকারের ব্যাপারে কোন কিছুই উল্লেখ নেই। ফলে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ শ্রমিক জানেই না তাদের জন্য কি ধরনের অধিকার সংরক্ষিত আছে? এদের যেহেতু সুনির্দিষ্ট কোন নিয়োগকর্তাই নাই তাই এদের অধিকার সুরক্ষার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকদের অধিকার সুরক্ষায় রাষ্ট্রীয় নীতিমালা থাকা খুব জরুরী।

শ্রম আইন বা বিধিমালা শ্রমিকশ্রেণির প্রত্যাশা পূরণে রাষ্ট্রপক্ষ বারবার ব্যর্থ হচ্ছে। অন্যদিকে শ্রম আইন বা বিধিমালা মোতাবেক শ্রমিকের যে সকল অধিকার বর্ণিত আছে সেগুলো মেনে প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করার ক্ষেত্রে মালিক পক্ষের বরাবরই অনীহা পরিলক্ষিত হয়। অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ ও পরিচয়পত্র কিছুই প্রদান করা হয় না। কিছু প্রতিষ্ঠানে নিরাপত্তার স্বার্থে পরিচয়পত্র দেয়া হলেও নিয়োগপত্র দেয়া হয় না।

শ্রম আইনের ১০০ ধারা মোতাবেক দৈনিক ৮ ঘণ্টা কর্ম দিবস অথচ ৮০% শ্রমিককে দৈনিক ১২ থেকে ১৪ ঘন্টা কাজ করতে হয়। আবার অনেক

সময় অতিরিক্ত কর্মঘন্টার মজুরীও আইনসম্মতভাবে প্রদান করা হয়না। সবেতন ছুটি পাওয়া যায় না। দেশে প্রায় ৬৫টি শিল্প সেক্টর থাকলেও ৪২টি সেক্টরে নি¤œতম মজুরি ঘোষণা হয়েছে। এখনো ২৩টি সেক্টরে নি¤œতম মজুরি ঘোষিত হয় নি। তারমধ্যে বেসরকারী স্বাস্থ্য সেবাখাত অন্যতম। বাজার দর এবং অন্যান্য বিষয় বিবেচনায় নিয়ে ৫ বছর অন্তর নি¤œতম মজুরি পুননির্ধারনের নিয়ম থাকলেও গার্মেন্টস শিল্প ছাড়া অন্যান্য সেক্টরে তা নিয়মিতভাবে মানা হয় না। টাইপ ফাউন্ড্রি খাতে সর্বশেষ নি¤œতম মজুরি ঘোষিত হয়েছে ১৯৮৩ সালে যা অদ্যাবধি পুনর্নিধারিত হয়নি।
শ্রম আইনের ২৬ ধারা বলে একজন মালিক কোন শ্রমিককে কোন কারণ না দেখিয়ে শুধুমাত্র ১২০ দিন পূর্বে নোটিশ দিয়ে কিংবা ১২০ দিনের মজুরি দিয়ে চাকুরিচ্যুত করার অধিকার রাখেন, যা শ্রমিক শ্রেণির পক্ষ থেকে কালো আইন হিসাবে অবিহিত করা হলেও শ্রম আইনের এই ধারাটি পরিবর্তনের কোন উদ্যোগ নেয়া হচ্ছেনা। ফলে শ্রমিকেরা যেকোন সময় চাকুরি হারানোর শঙ্কায় থাকে। এভাবে শ্রমিকশ্রেণি একটি গণতান্ত্রিক যুগোপযোগী শ্রম আইন থেকে বঞ্চিত হওয়ার পাশাপাশি আইনে বর্ণিত সুযোগ-সুবিধা থেকেও বঞ্চিত হচ্ছে। যা মানবাধিকের লঙ্ঘনের সামিল।

আমাদের দেশে মোট শ্রমিকের সংখ্যা প্রায় সাড়ে ৬ কোটি। এই বিশাল সংখ্যক জনগোষ্ঠিকে অধিকার বঞ্চিত রেখে জাতীয় উন্নয়ন কখনও সম্ভব নয়। অধিকারবঞ্চিত এই সকল শ্রমিকেরা প্রতিনিয়ত অনিশ্চয়তায় ভুগছে। তাই জাতীয় সার্থে শ্রমিকের এই অনিশ্চিত জীবনের অবসান হওয়া জরুরী। এজন্য চাই গণতান্ত্রিক শ্রমনীতি, যুগোপযোগী শ্রম আইন। দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠি তথা শ্রমিকশ্রেণির অধিকার প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়েই মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা সম্ভব।

ফজলুল কবির মিন্টু সংগঠক, বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র, চট্টগ্রাম জেলা

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট