চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪

বিশ্ব পবর্ত দিবস

খন রঞ্জন রায়

১১ ডিসেম্বর, ২০১৯ | ২:৩২ পূর্বাহ্ণ

পর্বত ভূ-প্রকৃতির বৈশ্বিক অলঙ্কার। বিশ্ব প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যের অপরূপ জীবনধারার বিরাট একটি অংশ পর্বতকে সঙ্গে নিয়ে। সারাবিশ্বের মোট জনসংখ্যার ১২ শতাংশের বসবাস পর্বতে। আরো ৯ ভাগ মানুষের জীবন আবর্তিত হয় মমতাময়ী পর্বতকেন্দ্রীক। ভূ-প্রাকৃতিক পরিমাপে পৃথিবীর প্রায় এক-চতুর্থাংশ পর্বত। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৯ কিলোমিটার উঁচু বিশাল বৈচিত্র্যের পর্বত সর্বোচ্চ হলেও নানামাত্রিক ও ধরনের পর্বত ও পর্বতমালা ভূ-পৃষ্ঠের অবস্থানকে করেছে রূপবৈচিত্র্যে গ্রীষ্মম-লীয় বৃষ্টিপ্রবণ, বনবাদার, স্থায়ী বরফাচ্ছাদিত ভূ-ম-লীয় এলাকায় অবস্থান করা পর্বতরাশিকে নানা নামে চিহ্নিত করা হয়। প্রকারভেদ, অবস্থান, চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের গুণাগুণ নির্ভর ভঙ্গিল পর্বতের মধ্যে আছে হিমালয় পর্বতমালা, আল্পস পর্বতমালা, আন্দিজ পর্বতমালা, কানাডার রকি পর্বতমালা অন্যতম। স্তূপ পর্বতের নামে আছে বিন্ধ্যা পর্বত, কলোরাডোর রকি পর্বত। আছে আগ্নেয়গিরি পর্বত বা সঞ্চয়জাত পর্বত, রয়েছে গম্বুজ পর্বতের পশ্চিমাঘাট পর্বতমালা, ক্ষয়জাত পর্বতের মধ্যে রয়েছে আরাবল্লী পর্বত, আপালেচিয়ান পর্বতমালা, ইউরাল পর্বতমালা ইত্যাদি। এছাড়া ট্রান্স-অ্যান্টার্কটিক, জাগ্রোস, রুয়ানমোরি পবর্তমালা ইত্যাদি পৃথিবীর প্রাকৃতিক পরিবেশকে করেছে সৌন্দর্যময়, বৈচিত্র্যময়।

বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রা ও প্রসারে পর্বতসমূহের রহস্য উন্মোচন হচ্ছে নিয়ত-প্রতিনিয়ত। সাধারণভাবে বলা যায়, ভূ-অভ্যন্তরে নানাবিধ কারণে ভূ-আলোড়ন সৃষ্টি হয়, নানা ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া হয়, বিভিন্ন তেজষ্ক্রীয় পদার্থের উপস্থিতি ঘটে, তাপমাত্রার হ্রাসবৃদ্ধি, পানির প্রবাহ নি¤œভূমিতে পাললিক শিলার সঞ্চায়ন ইত্যাদি বহুবিধ কারণে কালক্রমে তাপ ও চাপের বিকিরণ প্রভাবে ভূমির উন্নতি-অবনতি ঘটে। সংকোচন প্রসারণ হয়। আলোড়ন বা কম্পন সৃষ্টি হয়। বলা যায় বিপর্যয় ঘটে। অধিক উত্তপ্ত পৃথিবী শীতল হওয়ার সময় গাঠনিক ও ভৌত গুণাবলীর ভিন্নতার কারণ হয়। একপাশ অধিক উত্তপ্ত, পার্শ্ববর্তী এলাকা কিছুটা শীতলতার প্রভাবে আসমান ভূমিরূপ সৃষ্টি হয়। ভূ-পৃষ্ঠের উর্দ্ধাংশের সাম্যবস্থার অবনতির ফলে উঁচু-নিচু আকার ধারণ করে, ফল হয় পর্বত, পর্বতমালার সৃষ্টি। বিজ্ঞানী গবেষক ব্যবহারকারী পর্বতকে নানাভাবে সজ্ঞায়িত করেছেন। সাধারণ হিসাবে ১ হাজার মিটার বা তার বেশি উচঁ উচুঁ, বেশ খানিকটা বিস্তৃত শিলাময় ভূ-ভাগকে পর্বত বলে চিহ্নিত করেছে। এর মধ্যে আবার কৌণিক আকাশ ছোঁয়া চূড়া বা শৃঙ্গ থাকে অনেকগুলি শৃঙ্গে আকাশের মেঘ সাদা বরফের অবরণে ঢেকে রাখে। ভূ-প্রাকৃতিক গঠন, পৃথিবীর সীমা-পরিসীমা, স্থান-এলাকার বিচারে পর্বতসমূহের গঠন প্রকৃতিও আলাদা।

উৎপত্তিকালের তুলনামূলক হিসাবে নবীন-প্রবীণ বা প্রাচীন ভাগেও বিভক্ত করা যায়। গঠন বৈশিষ্ট্যানুযায়ী ভারতবর্ষের হিমালয়, ইউরোপের আল্পস ও জুরা, উত্তর আমেরিকার রকি, দক্ষিণ আমেরিকার আন্দিজ, আফ্রিকার আটলাস এক শ্রেণির যা ভঙ্গিল বা ভাঁজ পর্বত হিসাবে অভিহিত করা হয়। মেক্সিকোর পোপোক্যাটেপেটল, দক্ষিণ আমেরিকার অ্যাকনকাগুয়া, কটোপক্সি, ইতালির ভিসুভিয়ান জাপানের ফুজিয়ানা, আফ্রিকার কিলিমাঞ্জারো, ভারতের আন্দামান নিকোবার দ্বীপপুঞ্জের ব্যারন ও নারকনডাম পর্বত শ্রেণি ভয়াবহ বিপদজনক ভয়ংকর অগ্নুৎপাত সৃষ্টি করে। ১৯৯৫ সালের জানুয়ারিতেও ভয়াবহ অগ্নুৎপাত থেকে গলিত লাভা আতংকের সৃষ্টি করেছিল। ভূ-পৃষ্ঠের উপরিভাগে বৃষ্টি, নদী, বায়ু, হিমবাহ প্রভৃতি কাজের ফলে শক্ত শিলায় গড়া জায়গাও ক্ষয়প্রাপ্ত হয়। এরকম ক্ষয়জাত পর্বতের মধ্যে আছে স্পেনের সিয়েরা নেভদা, নরওয়ে ও সুইডেনের পর্বতশ্রেণি, ভারতে আরাবল্লী, পূর্বঘাট পর্বত ইত্যাদি। এ সমস্ত পর্বতমালা পৃথিবীর অতি প্রাচীন হিসাবে চিহ্নিত। পর্বত নিয়ে মানুষের আশা-আকাক্সক্ষা, ভাবনা-কল্পনা, অনুরাগ-আগ্রহ, হিসাব-পরিসংখ্যান দিনদিন বেড়েই চলেছে। সম্পদ ও সমৃদ্ধির আধার পর্বতকে ঘিরে সভ্যতার গোড়াপত্তন হলেও এর বঞ্চনাও কম নয়। পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি দৃষ্টিনন্দন বৈচিত্র্যময় জীবনযাত্রার অংশ হলেও পর্বতবাসীরা সবথেকে সুবিধাবঞ্চিত ও দরিদ্র। পর্বত বিশ্ব পরিবেশ ও আবহাওয়ার প্রধান প্রভাবক। বিশ্বের অর্ধেক মানুষের পানীয়জল মহাযতনে পর্বতের বুকে ধারণ, লালিত ও সংরক্ষিত হচ্ছে। শহরের আরাম-আয়েশ বাড়াতে প্রকৃতিকে যেন হুমকির মুখে না ফেলি, আদিমকে আদিমতার সাথে মুকাবিলা করে জীবনের সার্থকতা খুঁজতে হবে। দুর্গম পর্বতে লুকিয়ে আছে মানব পদচারণা, আছে গুহা, ঝর্ণা উদ্ভিদ ও প্রাণীজগতের অপার রহস্য। রহস্যের কারণে পর্বতের উপর রূঢ়তা, অনাচার পরিহার করে শ্যামল, কান্তি, প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের প্রতি অনুরাগ জাগাতে জাতিসংঘের আহ্বানে প্রতিবছর পালন করা হয় আন্তর্জাতিক পর্বত দিবস। পর্বতের গুরুত্ব অনুধাবন করে বিশ্ববাসীকে সচেতন করতে জাতিসংঘ ২০০৩ সাল থেকে ১১ ডিসেম্বর শুরু করে জনগুরুত্বের এই দিবস। পার্বত্য মানুষের জীবন সংস্কৃতির টেকসই ভবিষ্যৎ গঠনের লক্ষে মৌলিক উপাদানগুলি নিশ্চিত করতে পারাই এই দিবস পালনের মূল চ্যালেঞ্জ।

খন রঞ্জন রায় টেকসই উন্নয়নকর্মী।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট