চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪

অর্থপাচার রোধে কাক্সিক্ষত সাফল্য না আসার কারণ

চিকিৎসা শ্রমিকের দিনলিপি

ডা. হাসান শহীদুল আলম

১১ ডিসেম্বর, ২০১৯ | ২:৩২ পূর্বাহ্ণ

অগ্রহায়ণের মাঝামাঝি। ১৪২৬ বঙ্গাব্দ। পটিয়াস্থ চেম্বার।

নি¤েœর সংবাদচিত্রসমূহের প্রতি সম্মানিত পাঠকবৃন্দের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি : ১) ‘কিছুদিন আগে মাননীয় অর্থমন্ত্রী জনাব আ হ ম মোস্তফা কামাল বলেছেন, ‘আমদানী রফতানীর মাধ্যমে অর্থপাচাররোধে আমরা শতভাগ স্ক্যানারের ব্যবস্থা করছি।’ মাননীয় মন্ত্রী এমন বক্তব্য আশা জাগানিয়া হলেও বিদ্যমান বাস্তবতা এখনও এর বিপরীত (সমকাল ১৫/৯/১৯)’ ২) ‘অর্থনীতিবিদরা জানাচ্ছেন, বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর যে পরিমাণ অর্থ পাচার হয় তার পরিমাণ বার্ষিক রাজস্ব আয়ের ৩৬ শতাংশ। কিন্তু নানা পদক্ষেপ নেয়া সত্ত্বেও অনাদায়ী ঋণ এবং অর্থ পাচার কিছুতেই নিয়ন্ত্রণে আনা যাচ্ছেনা (আমাদের সময়, ২২-১১-২০১৯) ৩) ‘বাংলাদেশ ফিনানশিয়াল ইনটেলিজেনস ইউনিট বা বিএফআইইউ-এর পরিদর্শনে বেরিয়ে আসা অর্থপাচারের একটি প্রতিবেদন ২০১৫ সালে পাঠানো হয় দুদকে। এতে পণ্য আমদানীর নামে দুবাইয়ে অর্থ পাচারের প্রমাণ পাওয়ার পর এখন পর্যন্ত ব্যবস্থা নেয়া হয়নি বলে জানা গেছে। আমদানী রফতানীর আড়ালে দেশ থেকে প্রতিবছর বিপুল অংকের অর্থ পাচারের ঘটনায় বিএফআইইউ-এর কার্যক্রম নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকগুলোতে থাকা বাংলাদেশীদের টাকার খবর বের করতেও কোন সফলতা দেখাতে পারেনি এই গোয়েন্দা ইউনিট। যদিও সুইজারল্যা- ভারত সরকারকে তাদের ব্যাংকগুলোতে থাকা অর্থের তথ্য দিতে রাজি হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকসূত্রগুলা বলছে, বাণিজ্য অর্থায়নের মাধ্যমে দেশ থেকে কি কি উপায়ে টাকা পাচার হচ্ছে তার কোন সমীক্ষা বা গবেষণা নেই। ফলে কোন নির্দেশনাও দিতে পারেনি বাংলাদেশ ব্যাংক। আমদানী ঋণপত্র খোলার সময় ব্যাংকগুলো ওয়েবসাইট বা রয়টার্স সার্ভিস থেকে তথ্য নিয়ে থাকে। তবে মূলধনি যন্ত্রপাতির দাম দেশ ভিত্তিতে হওয়ায় গ্রাহকের চাহিদার ভিত্তিতেই ঋণপত্র খোলে ব্যাংকগুলো। এর মাধ্যমেই বড় অংকের অর্থ পাচার হচ্ছে বলে মনে করছে বাংলাদেশ ব্যাংক (প্রথম আলো, ২৭-৫-১৭)।’ ৪) ‘এমন কোন সরকারী সংস্থার নাম করা যাবে না যেটা খানিকটা দুর্নীতিমুক্ত। এছাড়া বর্তমান জাতীয় সংসদে সাংসদদের ৬২ শতাংশই ব্যবসায়ী। এ সংসদে ব্যবসায়ীদের সংসদ এবং রাজনীতি এখন লোভনীয় ব্যবসায় পরিণত হয়েছে (ড. মঈনুল ইসলাম, বাংলাদেশ প্রতিদিন, ২৩-১১-১৯)।’

উল্লিখিত সংবাদচিত্র সমূহে দেখা যাচ্ছে, ১) আমদানী রফতানী সংশ্লিষ্টরা জানান, আমদানী পণ্য স্ক্যানিং করে খালাস করা হলে কোন আমদানীকারক এক পণ্য এনে অন্য পণ্য ঘোষণা দিয়ে বিদেশে অর্থ পাচার করতে পারবে না (আজাদী, ১৭-৩-১৯)।’ ২)‘এ ব্যাপারে চট্টগ্রাম চেম্বার সভাপতি মাহবুবুল আলম দুটি স্ক্যানার স্থাপন প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল উল্লেখ করে বন্দরের সব গেটে স্ক্যানার বসানোর দাবী জানান (দেশ রূপান্তর, (২০-৩-১৯)।’ অর্থাৎ মন্ত্রীর বক্তব্য অনুযায়ী দুটি স্ক্যানার মেশিন বসালে সমস্যা মিটছে না ৩) খেলাপী ঋণ আদায় ও অর্থ পাচার বন্ধে সরকার ব্যর্থ হচ্ছেন ৪) দুদক এর কার্যক্রমেও যথেষ্ট জোরালো নয়। ৫) ব্যাংকগুলো ঋণপত্র খোলার সময় আমদানীতব্য মূলধনী যন্ত্রপাতির মূল্য দেশভেদে কম বেশী হওয়ায় উক্ত যন্ত্রপাতিসমূহের মূল্য ধরতে গ্রাহকের চাহিদাকে অগ্রাধিকার দেয়ায় আমদানীতব্য পণ্য সমূহ অতিমূল্যায়িত হবার সুযোগ পাচ্ছে ৬) সাংসদদের ৬২ শতাংশই ব্যবসায়ী হওয়ায় সংসদ জনগণের চাইতেও ব্যবসায়ীদের স্বার্থের অনুকূলেই কাজ করছে। আজকের লেখায় কেন অর্থ পাচার রোধে কাক্সিক্ষত সাফল্য আসছে না সে ব্যাপারে আলোকপাত করছি।

ক)ভ্রান্তনীতি : ১) ‘অর্থনীতিবিদদের মত, ভ্রান্তনীতির কারণেই অর্থনীতির অনেক খাতে ধ্বস নেমেছে। ২) বেসরকারী খাতে বিনিয়োগে স্থবিরতা ৩) মুদ্রাপাচার বিরোধী আইন সমূহের কার্যকারীতা না থাকা : বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিট, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড বা এনবিআর, দুর্নীতি দমন কমিশন বা দুদক, পুলিশসহ আরও কিছু সংস্থা মুদ্রা পাচাররোধে কাজ করে আসছে। কিন্তু সাফল্য খুবই কম। ৪) সরকারের দায়িত্বশীল পদধারীগণ কর্তৃক টাকা পাচারকে আমলে না নেয়া : ‘সোনালী ব্যাংকের হলমার্ক কেলেংকারীর পর অর্থমন্ত্রী বলেছেন, ‘৪ হাজার কোটি টাকা তেমন কিছু না’ (সাপ্তাহিক একতা, ৩-৯-১৯)।’

খ) অর্থপাচারের সাথে ক্ষমতার সম্পৃক্ততা : ১) ‘ড.কামাল হোসেন বলেছেন, টাকা পাচারকারীরা দেশের শত্রু। যারা টাকা পাচার করে তারা ক্ষমতার সাথে সম্পৃক্ত। তা না হলে এদের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা ঠিকই নেয়া হতো। টাকা পাচারকারীদের বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত সরকার কার্যকর কোন উদ্যোগ নেয়নি (যুগান্তর, ২৭-৫-১৯)। ২) ‘বিদেশে সেকে- হোম নিয়েছেন এমন ৬৪৮ ব্যক্তির বিষয়ে তিনবছরেরও বেশী সময় ধরে তদন্ত করছে বাংলাদেশের দুই সংস্থা। অনুসন্ধান চালাচ্ছে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) এক উপপরিচালকের নেতৃত্বে তিন সদস্যের বিশেষ টিমও। পাশাপাশি একই তালিকা ধরে তদন্ত চালাচ্ছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড। এই তালিকাভুক্তের মধ্যে রাজনীতিক আছেন ৩৮৩ জন এবং সাবেক সরকারী কর্মকর্তা, শিক্ষকসহ বিভিন্ন পেশাজীবী আর ব্যবসায়ী ২৬৫ জন। তদন্ত কার্যক্রম চলছে তো চলছেই, এর যেন শেষ নেই। বিদেশে পাচার করা টাকাও যেমন দেশে ফিরিয়ে আনা যায়নি, তেমনি তালিকাভুক্ত পাচারকারীদের কারও বিরুদ্ধে কোরকম ব্যবস্থাও নেওয়া হয় নি (বাংলাদেশ প্রতিদিন, ২১-১১-১৯)।’

গ) সরকারী কর্মকর্তাদের দুর্নীতি :
বাংলাদেশের আমদানীকারক দেশী ব্যাংকের মাধ্যমে টাকা বিদেশের ব্যাংকে পাঠায়। বিদেশী ব্যাংক থেকে ঐ সব অর্থ স্থানান্তর করা হয় রফতানীকারকের ব্যাংকের হিসাবে। রফতানীকারক ঐ অর্থ আমদানীকারকের হিসাবে স্থানান্তর করে দিচ্ছে। এ প্রক্রিয়ায় দেশী ব্যাংক, বিদেশী ব্যাংক, আমদানীকারক ও রফতানীকারক মিলে টাকা পাচার করছে। আর এ কাজে সহযোগিতা করছে আমদানী তদারককারী সংস্থা কাস্টমস বন্দর কর্তৃপক্ষ। এ সব প্রতিষ্ঠানের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তারা পণ্য দেশে না আনলেও কাগজপত্রে দেখিয়ে দিচ্ছে পণ্য দেশে এসেছে। একই প্রক্রিয়ায় কম পণ্য দেশে আনার মাধ্যমে বা কমদানী পণ্য দেশে আনার মাধ্যমে টাকা পাচার করা হচ্ছে।
ঘ) ফাইনানশিয়াল ইনটেলিজেনস ইউনিট এর ব্যর্থতা :
১) ‘ড. আবদুর রাজ্জাক বলেন, ওভার ইনভয়েসিং ও আন্ডার ইনভয়েসিং করে টাকা পাচার হচ্ছে। ফাইনানশিয়াল ইনটেলিজেনস ইউনিট এর কাজটা কি (কালের কণ্ঠ ১১-৮-১৯)?’ ২) দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয়ের অভাব থাকা ৩) টাকা পাচার বন্ধে পাশর্^বর্তী দেশ সফল হলেও বাংলাদেশের ব্যর্থতা : ‘ভারত সরকার সে দেশ থেকে অর্থ পাচারের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান গ্রহণের পরিপ্রেক্ষিতে এখন সে দেশ থেকে অর্থ পাচার গত এক বছরে ১০ থেকে ২০ শতাংশ কমেছে। অথচ বাংলাদেশে দিন দিন অর্থপাচার অস্বাভাবিক মাত্রায় বেড়ে চলেছে (দৈনিক নয়াদিগন্ত, ১০-৭-১৮)’ ৪) শিল্প বিনিয়োগের মন্দার মধ্যেও শিল্পের যন্ত্রপাতি ও কাঁচামাল আমদানী বৃদ্ধি পাওয়া : সচেতন মহলের মতে শিল্পের যন্ত্রপাতি ও কাঁচামাল আমদানীর নামে দেশ থেকে টাকা পাচার করা হচ্ছে। কেননা যেভাবে শিল্পের যন্ত্রপাতি ও কাঁচামাল আমদানী হয়েছে সেভাবে শিল্পের উৎপাদন বাড়েনি। তাহলে আমদানী করা ঐসব শিল্প উপাদান কোথায় গেল? ৫) কৃষিতে কয়েক বছর ধরে বাম্পার ফলন হবার পরেও সাম্প্রতিক সময়ে ব্যাপকভাবে চাল আমদানী বৃদ্ধি পাওয়া : সরকারীভাবে বলা হচ্ছে, দেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। তারপরও কেন চাল আমদানী হচ্ছে?

ঙ) কোন পদক্ষেপ না নেয়া : ১) টাকা পাচার সংক্রান্ত তথ্যাদি প্রকাশিত হলেও সে ব্যাপারে পদক্ষেপ নিতে নির্লিপ্ততা : প্রসঙ্গত : জিএফআই হলো ওয়াশিংটন ভিত্তিক একটি অলাভজনক সংস্থা যারা উন্নয়নশীল দেশগুলোর অবৈধ অর্থপ্রবাহ বা মুদ্রাপাচার নিয়ে গবেষণা ও বিশ্লেষণ করে থাকে।
একই সঙ্গে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর সরকারের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের সঙ্গে অর্থপাচার রোধে বিভিন্নরকম পরামর্শ ও নীতিগত সহায়তা দিয়ে থাকে। এরই অংশ হিসেবে তারা অর্থ পাচার সংক্রান্ত তথ্যাদি প্রতি বছর প্রকাশ করে থাকে ২) অর্থপাচার কারীদের নামের তালিকা প্রকাশ না করা : ‘জাতীয় সংসদে দেশের শীর্ষ ১০০ ঋণখেলাপী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের নামের তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে যেখানে পাওনা টাকার পরিমাণ ১ লাখ ১১ হাজার ৩৪৭ কোটি টাকা। তাহলে বিদেশে অর্থ পাচারকারীদের নামের তালিকা প্রকাশ করা যাবে না কেন (সংগ্রাম, ১৫-৭-১৭)?’
৩) রিজার্ভ চুরির মতো বড় ঘটনা ঘটলেও সেই ঘটনার তদন্ত রিপোর্ট এখনও প্রকাশ না পাওয়া। ৪) মোবাইল নেটওয়ার্ক দ্বারা হু-ির মাধ্যমে অব্যাহতভাবে টাকা পাচার করা : সরকারের দায়িত্বশীল অন্তত আটটি সংস্থার ব্যাপক নজরদারি, নিয়মিত অভিযান পরিচালনা, নানা প্রজ্ঞাপন জারীর মাধ্যমে ব্যাংকিং লেনদেনে কড়াকড়ি আরোপ করেও নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছেনা হু-ি বাণিজ্য।

উপসংহার : এ পর্যন্ত যেটুকু আলোচনা হলো তার সারমর্ম হিসেবে বলতে চাই যে, ভ্রান্তনীতির কারণে বিনিয়োগ না হওয়া, অর্থ পাচারের সাথে ক্ষমতার সম্পৃক্ততা এবং সরকারি কর্মকর্তাদের দুর্নীতি- মূলত এই তিনটি কারণেই সরকারের যথেষ্ট আন্তরিকতা সত্ত্বেও অর্থপাচার রোধে কাক্সিক্ষত সাফল্য আসছে না। আগামীতে অর্থপাচার রোধে সরকারের করণীয় সম্পর্কে লেখার আশা রাখছি।

ডা. হাসান শহীদুল আলম চর্মরোগ ও ডায়াবেটিস-এ ¯œাতকোত্তর প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত চিকিৎসক, চট্টগ্রাম।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট