চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

মসজিদুল হারমের মুদিরের সাথে আলোচনা

আহমদুল ইসলাম চৌধুরী

৯ ডিসেম্বর, ২০১৯ | ৩:৫২ পূর্বাহ্ণ

মসজিদুল হারমের মুদিরের সাথে গত হজের প্রায় ২ সপ্তাহ পর তার দপ্তরে আলোচনা করার সুযোগ হয়। মুদির আরবি শব্দ। মুদির অর্থ ডাইরেক্টর বা পরিচালক। আমাদের দেশে প্রমোশন পেতে পেতে উপরের পদে গিয়ে ডাইরেক্টর/ পরিচালক হয়। সৌদি আরবে তার সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম। অর্থাৎ প্রত্যেক শাখা-প্রশাখার প্রধানকে মুদির বা পরিচালক বলে। মসজিদুল হারমের এ মুদিরকে বলে আম অর্থাৎ সাধারণ।

মসজিদুল হারম ও মসজিদে নববী উভয় প্রশাসনিক তথা মুদিরের উপর আরও একজন মুদির রয়েছেন। তিনি হলেন হযরত শেখ ড. আবদুর রহমান সুদাইসী। তিনি নাকি আজিজিয়াতে বসেন, যা মসজিদুল হারম থেকে ৩/৪ কি.মি দূরে। পবিত্র মক্কায় সপরিবারে বসবাসরত চট্টগ্রামের ড. বশির হজ করতে গেলে আমার সাথে স্বাক্ষাত করতে আসেন। তাকে বললাম মসজিদুল হারমের মুদিরের সাথে দেখা করতে চাই। এতে তিনি যোগাযোগ রক্ষা করে আমার পরিচয়ের পাশাপাশি আমার পিতার সাথে সৌদি আরবের প্রতিষ্ঠাতা বাদশাহ আবদুল আজিজের সম্পর্কের কথা হয়তবা তুলে ধরে সাক্ষাতের অনুমতি পান। হজের ২ সপ্তাহ পর শনিবার সকাল ১০ টায় আমরা সাক্ষাত করতে যাই। তার মূল চেম্বারের পাশে কয়েকজন কর্মকর্তা নিয়ে প্রকান্ড অফিস। এতে ঐ কর্মকর্তাগণের মধ্যে তাঁর পিএস আমাদেরকে বসায়ে রেখে অনুমতি নিতে অভ্যন্তরে যান। অনুমতি পাওয়ার সাথে সাথে আমরা তার প্রকান্ড চেম্বারে প্রবেশ করি। ঐ সময় নায়েবে মুদির তথা ডেপুটি ডাইরেক্টর তথায় ছিলেন। মনে হয় আমার সাথে সাক্ষাতকারের প্রোগ্রাম আছে বিধায় ডেপুটি ডাইরেক্টরও তথায় উপস্থিত। ডাইরেক্টর হলেন গধলবফ গড়যধসসধফ অষ-গধংধঁফু. ডেপুটি মুদির হলেন গধলবফ ঝধষবয অষ-ঝধরফু. মুদিরের সাথে মৌলিকভাবে একটা বিষয় নিয়ে স্বাক্ষাৎ করতে উদগ্রীব থাকি। মৌলিক এই একটি বিষয় হল মসজিদুল হারম সম্প্রসারণ।
যেহেতু বর্তমানকালে তথা ক’বছর আগে মূল মসজিদ পুনঃ নির্মাণের পূর্বে ১৯৫০ এর দশকে পুনঃ নির্মাণ হয়েছিল। ঐ সময়কার পুনঃ নির্মিত বিধায় শীতাতপ নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা ছিল না। বাদশাহ ফাহাদ ১৯৮৫ খ্রিস্টাব্দে মসজিদে নববী বিশাল আকারের সম্প্রসারণ এবং পবিত্র মদিনা শহরকে নতুনভাবে ঢেলে সাজাতে লক্ষ কোটি হাজার রিয়ালের পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যান। এর মাত্র ৩ বছরের ব্যবধানে ১৯৮৮ খ্রিস্টাব্দে পবিত্র মক্কায় মসজিদুল হারমের সাথে সামসঞ্জ্য রেখে পশ্চিম দিকে বিশাল আকারে সম্প্রসারণ করে। এতে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা রয়েছে। কিন্তু দুঃখের ও দুর্ভাগ্যের বিষয়, বাদশাহ আবদুল্লাহ পবিত্র মসজিদুল হারম এবং সংলগ্ন এমন তিনটি কাজ করে গেছেন যা আমরা সাধারণ হজযাত্রীগণের দৃষ্টিতে গ্রহণযোগ্য নয়।
১.মসজিদুল হারমের দক্ষিণ পার্শ্বে তুর্কি কিল্লার স্থানে ৭টি টাওয়ার সমেত সুউচ্চ বিশাল বিলাসবহুল হোটেলাদি নির্মাণ করা। ২.মসজিদুল হারমের পশ্চিম-উত্তর কোণা অর্থাৎ সামিয়ার দিকে বিশাল আকৃতিতে মসজিদুল হারম সম্প্রসারণ করা। ৩. ১৯৫০ এর দশকে নির্মিত মসজিদুল হারম পুনঃ নির্মাণ করা।

আমরা সাধারণ হজযাত্রীগণের দৃষ্টিতে তার এ তিনটি কাজ অপরিকল্পিত দূরদর্শিতার অভাব এবং বর্তমান বা ভবিষ্যৎ সরকারের সম্প্রসারণ কাজে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করবে। অপরদিকে বাদশাহ ফাহাদ পবিত্র মদিনায় যেখানে ৫/৬ হাজার নর-নারী নামাজ পড়তে কষ্ট হত, সেখানে বর্তমানে ৫/৬ লাখ তথা ৭০/৮০ শত হাজার মানুষ নামাজ পড়তে পারছে যাবতীয় সুযোগ সুবিধা সমেত অতি আরামে। শুধু তাই নয় পবিত্র মদিনার সেকালের সমস্ত অবকাঠামোসমূহ ভেঙ্গে নতুনভাবে সাজিয়ে দিয়েছেন।
পবিত্র মক্কায় ১৯৮৮ খ্রিস্টাব্দে পশ্চিম দিকে মসজিদুল হারম সম্প্রসারণ ঐ সময়কার জন্য যথাযথ ছিল। কিন্তু দুঃখের বিষয় পরবর্তী বাদশাহ আবদুল্লাহ মহাপরিকল্পনা হাতে নিয়ে এগিয়ে যান নাই বলে মনে করি। ফলশ্রুতিতে আজকে হজ ও ওমরাকারীগণকে উত্তপ্ত রোদের মধ্যে রাস্তায় বা যেনতেন স্থানে ওয়াক্তে ওয়াক্তে নামাজ পড়তে হচ্ছে। আমরা বাংলাদেশীসহ কয়েক লক্ষ হাজী মিসফলার দিকে থাকি। আমাদেরকে ওয়াক্ত ওয়াক্ত নামাজ পড়তে নিরাপত্তা বাহিনী ব্যারিকেড দিয়ে প্রায় ১ কি.মিটারের কাছাকাছি দূরত্বে আবদুল্লাহ হেরেমের দিকে যেতে বাধ্য কার হয়। ওয়াক্ত ওয়াক্ত নামাজ পড়তে কতদূর যাওয়া যায়!

আমরা সম্মানিত মুদিরের চেম্বারে প্রবেশের সাথে সাথে আরবী রীতিতে তিনি এবং তার সহকর্মী আমাদেরকে স্বাগত জানায়। গাহওয়া এবং চা খেজুর দিয়ে আতিথেয়তা করেন। আতিথেয়তার পাশাপাশি খোলামেলা আলাপ হচ্ছিল। প্রথমেই তিনি এবং তার সহকর্মী ডেপুটি ডাইরেক্টর, আমি এবং আমার পিতার বিষয়ে জানবার কৌতহল বুঝতে পারি। ঐ সময় তথা ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দে বাদশাহ আবদুল আজিজ হজ উপলক্ষে পবিত্র মক্কায় ছিলেন। সেই সময় সড়ক যোগাযোগের প্রাথমিক অবস্থা বিধায় রিয়াদ থেকে পবিত্র মক্কা আসতে ৪/৫ দিন সময় লাগত।

অতঃপর আমি আমার মূল এক পয়েন্ট নিয়ে আলাপ করি। আর তা হল মসজিদুল হারম সম্প্রসারণ। আলাপ শুরু করতেই তারা উভয়ে মুশকি হেসে এ রকম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি তাদের নজরে আছে তা সহজে বুঝা গেল। কিন্তু বাস্তবায়ন বড়ই কঠিন। অর্থাৎ মসজিদুল হারম মিসফালাহ-জিয়াদের দিকে সম্প্রসারণ করতে হলে ঐ দিকের ৫/৭টি প্রাসাদ আরও দূরে দক্ষিণ দিকে সরিয়ে নিয়ে এ তিনটি বিলাসবহুল হোটেল ভেঙ্গে মিসফালাহ ও জিয়াদের দিকে মসজিদুল হারম সম্প্রসারণ করতে হবে। লাখ লাখ হাজী ও ওমরাকারী জুমাত বটেই ওয়াক্তে ওয়াক্তে নামাজ পড়তে হচ্ছে ৪০/৪৫ ডিগ্রী তাপমাত্রায় রাস্তার উপর। যা বড় কঠিন। অর্থাৎ হজ ও ওমরাকারীগণের দুর্ভোগ সহজে সুরাহা হবার নয়। তবে এ বিষয়ে বাদশাহ সালমানসহ রাজপরিবার এবং যথাযথ কর্তৃপক্ষের হৃদয়ে জাগরুক থাকুক।
আলাপে আগ্রহ দেখে আসরের নামাজের সময় নিয়ে আলাপ শুরু করি। আমাদের হানাফী মাজহাব মতে তথাকার আসরের সময়ে আমাদের আসর শুরু হয় না। এতে তারা উভয়ে অপ্রস্তুত হয়ে যান। মনে হচ্ছিল বিষয়টি তাদের অনুধাবনে নেই। তখন আমাকে ডেপুটি ডাইরেক্টর প্রশ্ন করলেন, ফজরের ওয়াক্তে কোন সমস্যা আছে কি না। আমি বললাম অন্য চার ওয়াক্তে আমাদের মাজহাব মতে ওয়াক্তে নামাজ পড়ছি। কিন্তু আসর আমাদের মাজহাব মতে ওয়াক্তে আগে হচ্ছে-যদিওবা বৃহত্তর চিন্তায় আমরা পড়ছি।

রাজতন্ত্রে কঠোর আইনের শাসনের দেশ। আমার প্রস্তাব যে উপরের দিকে পৌঁছিয়ে দিবে তা অনেকটা নিশ্চিত। বিদায়কালীন মসজিদুল হারম থেকে প্রকাশিত গ্রন্থ নিয়ে আরবি কায়দায় বিদায় নিলাম।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট