চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

ফাতেহা-ই-ইয়াজদাহম হযরত সৈয়্যদ মুহিউদ্দিন আব্দুল কাদের জিলানি (রা.)

সৈয়দ মুহাম্মদ জুলকরনাইন

৯ ডিসেম্বর, ২০১৯ | ৩:৫২ পূর্বাহ্ণ

‘যে দিন ঈমান নিয়ে চিরবিদায় নিতে পারব সে দিন হবে আমার জন্য খুশির দিন’ কথাগুলো শেখ সৈয়্যদ সুলতান আব্দুল কাদের জীলানীর (রা.)। অথচ তাঁকে সায়্যিদুল আউলিয়া (অলিকুল স¤্রাট) বলা হয়। তাঁর মত এত বড় অলিই যদি এ ধরনের মন্তব্য করেন তাহলে আমাদের মত সাধারণ মানুষদের চিন্তা-চেতনায় কি ধরনের ভয় থাকা উচিৎ মৃত্যুকালীন সময়ের ব্যাপারে, তা ভাবতেও শিউরে উঠতে হয়। ‘ওয়ালায়া’ মুলধাতুর শব্দ অলি একবচন, অর্থ- নিকটবর্তী হওয়া, ধর্মোপাসক (উবাড়ঃবব) যখন আল্লাহর নৈকট্য লাভ করে বা আল্লাহতাআলার নিকটবর্তী হয়ে যায় তখন সে অলী হিসেবে বিবেচিত হয়। অলী হলে মহান আল্লাহর সত্তা ও গুণাবলী সম্পর্কে পরিপূর্ণ জ্ঞান লাভ করা যায়। তখন বিশ্বজগত, জগতের স্রষ্টার প্রতিনিধি হিসেবে যে সকল দায়িত্ব বিশ্ববাসীর জন্যে পালন করতে হয় তার ধারনাও স্পষ্ট হয়ে উঠে। এ কারণেই অলীদের সর্বাঙ্গীন জীবনের ক্ষেত্রে তাঁদের কথা ও কর্মে মানুষের প্রতি সত্য, সুন্দর ও সততার আহবান পরিলক্ষিত হয় বহুভাবে। অলীদের জীবনে যে কোন অপকর্মের প্রত্যাখ্যান এবং সৎকর্মের নির্দেশনা প্রদান একটি রুটিন কাজ হিসেবে আমরা দেখতে পাই। তাই মহান রাব্বুল আলামীনও অলীদের এবাদতের বা সনির্ব›দ্ধ মিনতির যোগ্যতা দান করে তিনি (আল্লাহ) এবং তাঁর রাসূল (সা.) এর পথ থেকে কোন ভাবে যাতে বিচ্যুতি না ঘটে তার ব্যবস্থা করে দেন। প্রকৃত পক্ষে আল্লাহর কুদরত বা সামর্থ্য প্রকাশের মাধ্যম হচ্ছে নবী ও রাসূল (সা.) এর পর অলীয়ে কেরামগণ। অলীয়ে কেরামগণের শীর্ষে যাঁর নাম আসে তিনি হচ্ছেন, মাহবুবে ছোবহানি, গাউছে ছামাদানী, কুতুবে রব্বানী হযরত শেখ সৈয়্যদ আব্দুল কাদের জিলানী (রাহ.)।
শেখ সৈয়্যদ আব্দুল কাদের জিলানী (রাহ.) পারস্যের (বর্তমান ইরান) এর জীলান নগরীতে ৪৭০/৪৭১ হিজরি ১ রমজান মতান্তরে ২৯ সাবান তবে বিশুদ্ধ মতানুযায়ী ১ রমজান পৃথিবীতে তশরীফ আনেন। তাঁর পিতা অলীয়ে কামেল, আলেমে দ্বীন শেখ আবু ছালেহ জঙ্গী(রাহ.)। যাঁর বংশপরম্পরা হযরত ঈমাম হাসান (রা.) থেকে এসেছে। হযরত আব্দুল কাদের জিলানী (রাহ.) এর মাতা মহিয়সী উম্মুল খায়ের ফাতেমা (রাহ.) হযরত ঈমাম হোসাইন (রা.) পর্যন্ত বংশ পরম্পরায় মিলিত হয়েছে। মাতা-পিতা উভয় দিক থেকে রাসূলে করীম (সা.)’র বংশের এ সমুজ্জল প্রদীপ চল্লিশ বছর এশার অজু দিয়ে ফজরের নামাজ আদায় করেছেন। ৩০ হতে ৪০ দিন পর্যন্ত দিবারাত্রি অনাহারে রোযা (সাওমে বেছাল) রাখতেন, পঁচিশ বছর মাঠ-ঘাট, বনভূমি, উঁচু নিচু পাহাড়-পর্বত সর্বত্র কষ্টসাধ্য জীবন যাপন করেছেন। পনেরো বছর একনাগাড়ে রাত্রিকালনি দাঁড়িয়ে দু’রাকাত নামাযে সম্পূর্ণ কুরআন শরীফ খতম করেছেন। সুতরাং উনি গাউসুল আযম হওয়ার প্রকৃত হকদার বা যোগ্যতা রাখেন এতে কোন সন্দেহ নেই।

ইতিহাস পাঠে জানা যায়, ইসলামী হুকুমতের চতুর্থ খলিফা হযরত আলী ইব্নে আবি তালিব (রা.) এর শাহাদাতের পরবর্তী সময়ে হযরত মুয়াবিয়া ইব্নে আবু সুফিয়ান উমাইয়া খেলাফত প্রতিষ্ঠা করলে রাজতন্ত্রের সূচনা হয়। তারই ধারাবাহিকতায় হযরত মুয়াবিয়ার (রা.) ইন্তিকালের পর তাঁর পুত্র ইয়াযিদ শাসনভার গ্রহণ করে একনায়কত্ব তথা স্বৈরাচারী ভূমিকায় অবতীর্ন হয়।

ইয়াযিদের জুলুম অত্যাচার সীমাহীন পর্যায়ে পৌঁছে গেলে মহানবী (সা.) কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত পবিত্র ধর্ম ইসলামের মহান আদর্শ এবং মূল্যবোধগুলো চরম প্রতিকূলতার সম্মুখীন হয়। এমনি অবস্থায় রাজশক্তি কর্তৃক নিয়োজিত ও নিয়ন্ত্রিত কতক জ্ঞানী নামের ফেত্নাবাজ ভিন্ন ভিন্ন মতবাদে আর শরীয়াহ বহির্ভূত আদর্শ প্রচার করতে থাকে। যার কারণে মুসলমানদের মধ্যে আত্মকলহের সৃষ্টি হয়। ইসলামী ভ্রাতৃত্বের বন্ধন ভেঙ্গে সাংঘাতিক বিশৃংঙ্খলা দেখা দেয়। ইসলামের সঠিক পথ থেকে বের হয়ে বেশ কিছু ভ্রষ্ট সম্প্রদায় জন্ম নেয়। এমনি অরাজক পরিস্থিতি এবং ইসলামের ক্রান্তিলগ্নে হযরত আবু মুহাম্মদ মুহিউদ্দিন শেখ সৈয়্যদ আব্দুল কাদের জিলানী (রাহ.) বাগদাদ নগরীতে আগমন করেন। অতপর ১০৬৫ খ্রিস্টাব্দে বিখ্যাত মন্ত্রী আবু আল-হাসান নিযামুল মুল্ক কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত মাদ্রাসা এ নিযামিয়ায় এল্ম হাসিল করার পর পঁয়ত্রিশ বছর সেখানে অধ্যাপনা করেন। সর্বশক্তিমান আল্লাহতাআলা পবিত্র কুরআনের সূরা বাকারায় ১৯৫ নং আয়াতে করীমাতে ঘোষণা করেছেন ‘তোমরা সৎ কাজ করো, আল্লাহ পাক সৎকর্মপরায়ণ লোকদের ভালোবাসেন।’ হযরত সৈয়্যদ মুহিউদ্দিন আব্দুল ক¦াদের জিলানী (রাহ.) এর জীবনীতে আল্লাহর উক্ত নির্দেশনার শতভাগ প্রতিফলন ঘটেছে। তাই উনি আল্লাহর বন্ধু বা নিকটবর্তী একজন। তাঁর অসাধারণ বাগ্মিতা ও শরীয়তের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ বাগদাদবাসীকে নতুন জীবন তথা সঠিক পথের সন্ধান দিতে পেরেছিল। এ কারণেই গাউসে পাকের ভাষণ শোনার জন্য ৫০ হাজার থেকে দেড় লাখ পর্যন্ত লোক একাগ্রচিতে অপলক বসে থাকত। সে সময়ে হযরত আবু মুহাম্মদ মুহিউদ্দীন আব্দুল কাদের জিলানী (রাহ.) যদি বিশ্ববাসীর কাছে প্রকৃত ইসলাম তুলে না ধরতেন তাহলে আজ অবদি আমরা ভুল পথে পরিচালিত হয়ে মহান আল্লাহর পরিবর্তে কোন না কোন ভাবে, কারো না কারো দাসত্বে নিয়োজিত থাকতাম। তাই জ্ঞানীজনের অভিমত “মুহিউদ্দিন” উপাধি পাওয়া হযরত আব্দুল কাদের জিলানীর জন্য যথার্থ। কেন না তার অর্থই হচ্ছে ধর্মের জীবন দানকারী।

সৈয়দ মুহাম্মদ জুলকরনাইন রাজনীতিক, প্রাবন্ধিক।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট