চট্টগ্রাম বুধবার, ২৪ এপ্রিল, ২০২৪

জনজীবনে বায়ুদূষণের প্রভাব

মো. দিদারুল আলম

৮ ডিসেম্বর, ২০১৯ | ৫:১১ পূর্বাহ্ণ

বর্তমানে পুরো চট্টগ্রামই ধুলাবালির নগরীতে পরিণত হয়েছে। বিশেষ করে বহদ্দারহাট থেকে শাহ আমানত সেতু সড়ক, মুরাদপুর থেকে অক্সিজেন, বহদ্দার হাট থেকে জিইসি, বাস টার্মিনাল থেকে কাপ্তাই রাস্তার মাথা, ওয়াসা সড়ক, স্টেশন সড়ক, চান্দগাঁও আরাকান সড়ক, ষোলশহর দুই নম্বর গেট মোড়, পলিটেকনিক সড়ক, পূর্ব নাসিরাবাদ হাউজিং সোসাইটি সড়ক, কালামিয়া বাজার, এক্সেস রোড, পোর্ট কানেক্টিং রোড, সদরঘাটসহ আরও কয়েকটি সড়কে ধুলাবালি এত বেশি যে, দেখে মনে হবে কুয়াশায় ঢাকা। এতে সবচেয়ে বেশি ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে স্কুলগামী শিশু ও পথচারীদের। ধুলাবালি থেকে রেহাই পায় না সড়কের পাশে থাকা বিভিন্ন স্থাপনাসহ দোকানপাট। সড়কের পাশে থাকা সবুজ পাতাগুলোও ধূসর হয়ে গেছে।

পরিচ্ছন্ন নগরী হিসেবে সুনাম ছিল চট্টগ্রামের। সে গৌরব বুঝি আর থাকছে না। এখানকার বাতাসে দিন দিন বাড়ছে দূষিত ধূলিকণার পরিমাণ। বাতাসে ব্লাক কার্বন হিসেবে পরিচিত পিএম (পার্টিকুলেট ম্যাটার) ১০ এবং পিএম ২ দশমিক ৫-এর পরিমাণ মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে। যেখানে বাতাসে স্বাভাবিক পিএম-১০-এর পরিমাণ ১৫০ থাকার কথা, সেখানে গত নভেম্বরে সর্বোচ্চ রেকর্ড করা হয় ৩১৯। এ কারণে নগরীতে শ্বাসকষ্টসহ নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ। এ ধরনের স্বাস্থ্যঝুঁকি এড়াতে মাস্ক ব্যবহারসহ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

পিএম-১০ এবং পিএম ২ দশমিক ৫ হলো ব্লাক কার্বন। এগুলো যত বেশি হবে তাপমাত্রার তারতম্যও তত বেশি হবে। চট্টগ্রাম শহরে বিভিন্ন ফ্লাইওভার নির্মাণ, সড়ক সংস্কার এবং ডিজেলচালিত যানবাহন বেশি হওয়ার কারণে এ ধরনের ধূলিকণার পরিমাণ বাড়ছে। এ ধরনের দূষণ রোধ করতে ডিজেলচালিত বাস ও ট্রাকের ইঞ্জিনে ফিল্টারের সংখ্যা বাড়াতে হবে।

সিটি কর্পোরেশন এবং ওয়াসার ড্রেন পরিস্কার করে ময়লার স্তুপ রাস্তার পাশে রাখা হচ্ছে। দোকান-পাট ও গৃহস্থালীর আবর্জনা যেখানে সেখানে ফেলে রাখা, মেরামতহীন ভাংগাচোরা রাস্তায় যানবাহন চলাচল, পুরাতন ভবন ভাঙ্গা, মেশিনে ইট ভাঙ্গা, যানবাহনের কালো ধোঁয়া, শিল্পপ্রতিষ্ঠানের ধোঁয়া, ইত্যাদি ধুলা দূষণের অন্যতম কারণ বলে মনে করছেন পরিবেশবাদিরা।
এসব উৎস থেকে বিপুল পরিমাণ ধুলা বাতাসে মিশে জনস্বাস্থ্য, পরিবেশ ও অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব ফেলছে উল্লেখ করে পরিবেশবাদী সংগঠনগুলো বলছে, খোঁড়াখুঁড়ির মাটি ও অন্যান্য আবর্জনা দ্রুত অপসারণের জন্য পৃথক খাতে খরচ হয়। কিন্তু বিধি মোতাবেক কাজটি হয় না। এছাড়াও ড্রেনের ময়লা আবর্জনা রাস্তার দুপাশে দীর্ঘদিন ফেলে রাখা হয়। ফলে যানবাহন চলাচলের সময় ধুলা-বালি ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ার কারণে শীতে ধুলাদূষণের মাত্রা অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যায়। ধুলাদূষণে শ্বাসকষ্ট, হাঁপানী, এলার্জি, চর্মরোগসহ নানা জটিল রোগব্যাধি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। ধুলাদূষণে জনদুর্ভোগের পাশাপাশি একদিকে যেমন স্বাস্থ্যগত সমস্যা হচ্ছে তেমনি আর্থিক ও পরিবেশেরও ক্ষতি হচ্ছে। রাস্তার ধুলাবালির কারণে শিশু ও বয়স্কদের ফুসফুস এবং শ্বাসনালিতে সংক্রমণ দেখা দেয়। এ ছাড়া যক্ষ্মা, ব্রঙ্কাইটিস, চোখের সমস্যা, বদহজম, অ্যালার্জিসহ ভাইরাসজনিত নানা রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। দীর্ঘদিন ধুলাবালির পরিবেশে থাকার ফলে একপর্যায়ে ক্যান্সার, এমনকি কিডনিতেও সমস্যা হতে পারে। নারী ও শিশুদের এ ধুলাবালি থেকে আরও বেশি দূরে থাকা উচিত।

বিশ্বব্যাংক পরিচালিত জরিপে ব্লাক কার্বন বাড়ার জন্য ৫০ শতাংশ দায়ী করা হয় ইটভাটাগুলোকে। আবার গাড়ির কালো ধোঁয়া, বিভিন্ন জায়গায় ময়লা ফেলা, উন্মুক্তভাবে নির্মাণকাজ করার কারণেও বাতাসে ধূলিকণার পরিমাণ বাড়ছে। এ ধরনের দূষণ রোধে ইটভাটায় আধুনিক প্রযুক্তি, গাড়ির কালো ধোঁয়া এবং খোলা জায়গায় ময়লা-আবর্জনা ফেলা থেকে বিরত থাকতে হবে।
ইবনে সিনা বলেছিলেন, ‘পৃথিবীর সকল রোগের মূল কারণ হলো ধুলা-বালু’। এই মনীষীর বাণী যদি সত্য হয়, তাহলে ধুলা-বালু শ্বাস-প্রশ্বাসজনিত রোগ বৃদ্ধি করছে, বাড়ছে ক্যান্সারসহ জটিল রোগ। ধুলার কারণে ফুসফুস ও হার্টের রোগসহ সৃষ্টি হচ্ছে নানা জটিল শারীরিক সমস্যা।
২০১৭ সালের একটি রিপোর্ট অনুযায়ী বাংলাদেশে যতোগুলো লোক মারা যায় তাদের ২৫ ভাগ মানুষ পরিবেশের কারণে মারা যায়। আর এই ২৫ ভাগের মধ্যে ৭৫ ভাগ মানুষ বায়ুদূষণের কারণে মারা যায়।
বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, প্রতিবছর প্রায় ১৫হাজার বাংলাদেশি মৃত্যুবরণ করে প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে শুধু বায়ুদূষণের কারণে। সরেজমিনে এমনও দেখা গেছে, শহরের আবাসনগুলোতে আমরা স্থপতিরা যতই প্রাকৃতিক আলো-বাতাস প্রবেশ ও চলাচলের কথা বলি না কেন, অতিরিক্ত ধুলোবালি ও শব্দের কারণে সুবিধা থাকা সত্ত্বেও ৭০-৭৮ শতাংশ শহুরে নাগরিক, বিশেষ করে রাস্তার ধারের বাসিন্দারা তাদের ঘরের দরজা-জানালা দিনের প্রায় সব সময় বন্ধ রাখে, যেন ধুলোবালি ভেতরে ঢুকতে না পারে। তাদের মধ্যে বেশ কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, অতিরিক্ত ধুলোবালির কারণে পরিচ্ছন্নতার জন্য মাসিক ব্যয় বেড়ে যায় প্রায় এক-চতুর্থাংশ, অনেক সময় যা তাদের সামর্থ্যের বাইরে চলে যায়।

অন্যদিকে ১৯৯৫ সালে প্রণীত চট্টগ্রামের মাস্টারপ্লানের মেয়াদ ২০১৫ সালেই শেষ হয়ে গেছে। আর সেই উন্নয়নের প্ল্যান চাপা পড়ে গেছে চকচকে পৃষ্ঠার মধ্যেই। আলোর মুখ আর দেখা হয়নি, যার সুফল নাগরিকদের অদেখাই থেকে গেল। যেখানে শহরকে টেকসইভাবে গড়ে তোলার ব্যাপারে বেশ কিছু দিকনির্দেশনা ছিল।
ধুলাবালি থেকে মুক্ত থাকতে কিছু প্রস্তাবনা : ব্যাপক সবুজায়ন আর সঠিক পরিকল্পনা পারে মুক্তি দিতে ধুলাযন্ত্রণা থেকে। সিটি করপোরেশনের পানি ছিটানোর স্প্রেগুলোকে সক্রিয় রাখতে হবে। প্রতিদিন রাত ৪টা থেকে ৭টা পর্যন্ত তারা যদি (সিটি কর্পোরেশন) পানি স্প্রে করে, তাহলে অক্সিজেন প্রাপ্তি বেড়ে যাবে এবং শহরে ধুলাবালি অনেক কমে যাবে, পৃথিবীর কোনো শহরে প্রতিবছর রাস্তা খুঁড়াখুঁড়ি হয় কিনা জানা নেই।

প্রতিবছর এই রাস্তা খুঁড়াখুঁড়ির সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসলে ধুলার পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ করা যাবে, অপরিকল্পিত পরিবহন চলাচল বন্ধ করতে হবে। জরাজীর্ণ বাস চলাচল নিষিদ্ধ করা নয় শুধু আইনের সঠিক প্রয়োগ করতে হবে। রাজধানীতে ট্রাক চলাচল সীমিত করতে হবে, ময়লা ব্যবস্থাপনার সঠিক পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তা, কর্মচারী এবং পরিচ্ছন্নতা কর্মীকে উন্নত নগরায়নের প্রশিক্ষণ প্রদান করতে হবে। আসল ব্যাপারটি হলো, কর্তৃপক্ষগুলোর উপরি আয়ের যে ধান্দা সেখান থেকে বেরিয়ে এসে প্রত্যেককে যার যার দায়িত্ব পালন করতে হবে।
মো. দিদারুল আলম কলাম লেখক ও প্রাবন্ধিক

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট