চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪

৬ দফা কর্মসূচীর উৎস ও নতুন মেরুকরণ

পূর্ব প্রকাশিতের পর

নাওজিশ মাহমুদ

৮ ডিসেম্বর, ২০১৯ | ৫:১১ পূর্বাহ্ণ

ভবিষ্যতে পূর্ব ও পশ্চিমের দুটি অঞ্চলের স্বায়ত্তশাসনের ব্যাপারে রদ করবেন, এমন উক্তি প্রদান করার পর মুসলিম লীগের নেতা জিন্নাহ ক্যাবিনেট মিশনের প্রস্তাবের সমর্থন থেকে সরে আসেন। কারণ বৃটিশরা প্রথমে বলেছিল যে কোন দল মানলেই এটা বাস্তবায়ন হবে। বৃটিশরা তাঁদের প্রস্তাব থেকে পিছু হটে। সংবিধানে ক্যাবিনেট মিশনের শর্তবলীর ব্যাপারে নমনীয় হওয়ার শর্তে নেহেরুকে সরকার গঠন করা সুযোগ দেয়া হয়। প্রতিবাদে ১৯৪৬ সালের ১৬ই আগস্ট প্রত্যক্ষ সংগ্রামের ডাক দেয় জিন্নাহ। ভারতে অন্যান্য অঞ্চল শান্তিপূর্ণ থাকলেও কলকাতা ও নোয়াখালীর ভয়াবহ দাঙ্গা পরিস্থিতিকে দ্রুত পাল্টে দেয়। সোহরাওয়ার্দী বাংলার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দাঙ্গা দমনে ব্যর্থ হওয়ায় কলকাতার সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুদের আস্থা হারান। ফলে বাংলা বিভক্তি অপরিহার্য হয়ে পড়ে।

১৯৪৬ সালের কলকতার দাঙ্গা বৃটিশকে বিচলিত করে। বৃটিশ দ্রুত সিদ্ধান্ত নেয় ভারত ত্যাগ করবে। লর্ড মাউন্ট ব্যাটেনকে নিয়োগ দেয় ১৯৪৮ সালের পূর্বেই ভারতের স্বাধীনতা নিশ্চিত করার। দ্রুত বৃটিশ ত্যাগের পূর্বেই শুধু ভারতকে ভাগ করে নি। বৃটিশরা অন্যতম দুটি জাতিকে ধর্মীয় ভিত্তিতে দ্বিখন্ডিত করে যায়। একটি লড়াকু জাতি পাঞ্জাবী। আরেকটি জ্ঞান-বিজ্ঞানে, চিন্তা -চেতনায় ধর্ম ও সাহিত্যে এগিয়ে থাকা বাঙালি।
আমাদের দুর্ভাগ্য পাঞ্জাবের অগ্রসর অংশ এবং রাজধানী লাহোর পাকিস্তানের ভাগে পড়ে আর বাঙালির অগ্রসর মধ্যবিত্ত এবং রাজধানী কলকাতা ভারতে পড়ে। এই পরিস্থতিতে পাঞ্জাবের অগ্রসর অংশকে মোকবিলার প্রস্তুতি হতে পশ্চাদপদ পূর্ব বাংলার বাঙালিকে সময় নিতে হয়েছে।
ভাষা আন্দোলন দিয়ে শুরু করে ১৯৬৬ সালে এসে ৬ দফা কর্মসূচীর মাধ্যমে প্রথম দিকনির্দেশনামূলক রাজনীতি খুঁজে পায়। যেখানে রাজনীতি অর্থনীতি এবং সামরিকনীতি সকল কিছু সমন্বিত করা হয়েছিল।

পূর্ব বাংলার মধ্যবিত্ত, যার প্রধান অংশ মুসলিম, সে প্রথমে পশ্চিম বঙ্গে মধ্যবিত্তকে ত্যাগ করে পাঞ্জাবের অভিজাত ও মধ্যবিত্ত এবং মুম্বাইয়ে মুসলিম পুঁজির (যার অধিকাংশ করাচীতে স্থানান্তর হয়েছিল) কাছে আশ্রয় নিয়েছিল। সেখানে প্রতারিত ও প্রত্যাখ্যাত হয়ে এবার নিজের পায়ে দাঁড়াবার নৈতিক ভিত্তি খুঁজতে থাকে। এই ভিত্তিটা ভাষা অন্দোলনের মধ্যে শুরু হলেও যুক্তফ্রন্টোর মাধ্যমে জনগণ ঐক্যবদ্ধ হলেও নেতৃত্ব এবং সময় দুটোই ছিল প্রতিকুলে।
১৯৬২ সালের সামরিক শাসন, সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যু, প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে আইউবের কারচুপী করে জয়লাভ, ১৯৬৫ সালে যুদ্ধে অরক্ষিত বাঙালি মধ্যবিত্তের মধ্যে চিন্তা ও মনোজগতে ব্যাপক পরিবর্তন সাধিত হয়। বাঙালির প্রতি পাকিস্তান শাসকদের রাজনৈতিক বঞ্চনা অর্থনৈতিকভাবে পঙ্গু করা, কোরিয়ার যুদ্ধে পাটের চাহিদা বৃদ্ধির ফলে পাকিস্তানে বৈদেশিক মুদ্রার স্ফীতি থেকে বাঙালিকে বঞ্চিত করা, পাটের দাম বৃদ্ধির ফলে কৃষকদের মধ্যে আর্থিক স্বচ্ছলতার সাথে চিন্তা-চেতনাতেও নতুন মাত্রা যোগ করে। বাংলার কৃষক, বাঙালি বুদ্ধিজীবী, বাঙালি আমলা এবং বাঙালি সামরিক বাহিনীর আকক্সক্ষার সাথে বাঙালি উঠতি পুঁজির এবং মধ্যবিত্তের আকক্সক্ষার সম্মিলন ঘটে। তাশখন্দ চুক্তির কারণে আইউব বিরোধী সারা পাকিস্তনের ক্ষোভ কাজে লাগিয়ে একটি অভিন্ন কর্মসূচী নির্ধারণের জন্য ১৯৬৬ সালে ৬ই ফেব্রুয়ারি লাহোরে সকল দলের বিরোধীদলের নেতাদের প্রতিনিধি সভার আয়োজন করা হয়। বাঙালির আকাক্সক্ষাকে সমন্বিত করে শেখ মুজিব ৬ দফা পেশ করলে পাকিস্তানের বিরোধীদলের নেতারা এটি বিবেচনায় আনতে অস্বীকার করে। এর প্রতিবাদে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ১৯৬৬ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি লাহোরে সংবাদ সম্মেলনে আনুষ্ঠানিকভাবে ৬ দফা পেশ করেন। এই ৬ দফা পাকিস্তানের রাজনীতিতে নতুন মেরুকরণ সৃষ্টি করে। এই ৬ দফা প্রথমে সাত দফা আকারে খসড়া রচিত হলেও তাজ উদ্দিন একে ৬ দফায় নিয়ে আসেন। ৬ দফা পেশ নিছক পূর্ব পাকিস্তানের আঞ্চলিক স্বায়ত্বশাসনের দাবী বললে ভুল হবে। এটি ছিল দীর্ঘ লড়াইয়ের জন্য তৎকালীণ বাঙালি সমাজের একটি ক্ষুদ্র অংশের লৌহ কঠিন সংগ্রামের জন্য নিজেদের উৎসর্গীত করার আনুষ্ঠানিক যাত্রা।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নেতৃত্বে জনাব তাজউদ্দিন, আবদুল মালেক উকিল, নুরুল ইসলাম চৌধুরী, এবিএম নুরুল ইসলাম, মোঃ ইউসুফ আলী, জহুর আহমদ চৌধুরী প্রমুখকে নিয়ে গঠিত একটি দল করাচী হয়ে লাহোরে যান। যেহেতু ৬ দফা পাকিস্তান আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সভায় পাশ হয় নি। এমনকি পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ সভাতেও পাশ হয়নি। এটা নিয়ে আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরে যেমন মেরুকরণ হয়, তেমনি পাকিস্তানের রাজনীতিতেও মেরুকরণ হয়।

এমনকি ছাত্রলীগেও নতুন মেরুকরণ হয়। দৃঢ়ভাবে সমর্থন যোগায় নিউক্লিয়াসের তিনজন এবং তাঁদের সমর্থিত ছাত্রলীগের অনুসারীরা। চট্টগ্রামের আজিজ-জহুর উভয়ে সমর্থন করে। জহুর আহমদ চৌধুরী পেশের সময় সাথে ছিলেন। ইত্তেফাকের সাংবাদিক সিরাজুল হোসেন ও চট্টগ্রামের ব্যুরো চিফ মইনুল আলমের তৎপরতার এম, এ, আজিজ জরুরী সভা করে বিবৃতির মাধ্যমে সাথে সাথে ৬ দফা সমর্থন দেন। পাকিস্তান আওয়ামী লীগ, যার সভাপতি ছিলেন নওয়াবজাদা নসুরুরল্লাহ খান ৬ দফা বিরোধীতা করেন। পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের মনসুর আহমদ ও আতাউ রহমান খান, আবদুস সালাম খান এবং পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সভাপতি আবদুর রশিদ তর্কবাগিশ সবাই ছিলেন ক্ষুদ্ধ, এমনকি তোফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়াও। কারণ কাউকে জিজ্ঞেস না করে, আলোচনা না করে হঠাৎ ৬ দফা পেশ কেউ মেনে নিতে পারেন নি। চট্টগ্রামের আজিজ-জহুরের সমর্থনের ফলে ঢাকার অধিকাংশ নেতা বিরোধীতা করতে সাহস করেন নি। পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সভাপতি আবদুর রশীদ তর্কবাগিশ প্রথমে মৃদু আপত্তি করলেও পরে সমর্থন দেন। ইত্তেফাকের তোফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া পরে দৃঢ়ভাবে ৬ দফাকে সমর্থন দেন। তাঁকে এ জন্য জেলও খাটতে হয়। এই কারণে ইত্তেফাক বন্ধ করে দেয়া হয়।

জামাতে ইসলাম, নেজামে ইসলামসহ যারা পাকিস্তানের সংহতি চেয়েছে, যারা ইসলামী মূল্যবোধে বিশ^াস করতেন, তারা সরাসরি ৬ দফার বিরোধীতা করেন। ক্ষমতাসীন কনভেনশন মুসলিম লীগ বিরোধীতা করেছে, সাথে বিরোধী কাউন্সিল মুসলিম লীগও বিরোধীতা করেছে। এমনকি ন্যাপের দুটি অংশ এবং মনিসিংহের কমিউনিস্ট পার্টিসহ সকল বাম ঘরানা ‘শ্রমিক-কৃষকের মুক্তির কথা নাই’ এই বলে বিরোধীতা করেছেন। অনেকে একে সিআইয়ের এজেন্ডা বলেও প্রচার করেছে। এই মেরুকরণে মধ্য দিয়ে চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগে দৃঢ়ভাবে একে সমর্থন করে। প্রথম জনসভা চট্টগ্রামেই অনুষ্ঠিত হয়। তরুণ ছাত্র এবং নিউক্লিয়াসের প্রভাবাধীন ছাত্রলীগের অংশ দৃঢ়ভাবে সমর্থন করে। ছাত্রলীগকে সংগঠিত করে। ফেরদাউস আহমদে কোরাইশীর নেতৃত্বাধীন ছাত্রলীগের অংশ এর বিরোধীতা করে। ১৯৬৯ সালের সম্মেলনে তাঁরা ছাত্রলীগ থেকে বের হয়ে আলাদা ছাত্ররলীগ করে। সকল নেতা যখন নির্যাতনে জেলে তখন আমেনা বেগম দৃঢ়ভাবে এই ৬ দফার পক্ষে সারাদেশে প্রচারণা চালান কিন্তু রহস্যজনক কারণে ১৯৭০ সালে তিনি আওয়ামী লীগ থেকে বের হয়ে আলাদা রাজনৈতি সংগঠন করেন।

৬ দফার মাধ্যমে বাঙালি নতুন রাজনৈতিক দিক-নির্দেশনা পায়। এর মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু সকল বাঙালি রাজনৈতিক নেতাকে ছাপিয়ে অবিংসংবাধিত নেতা হিসেবে স্থান করে নেন। ৬ দফার প্রশ্নে জেল- জুলুম ও নির্যাতনের মধ্যেও হিমালয় পাহাড়ের মত অটল থাকেন। তাঁর সাথে তার কিছু সহকর্মী, তরুণ ছাত্র এবং শ্রমিক শ্রেণিও অকুন্ঠ সমর্থন দেয়। ৬৬ সালের ৭ জুনে হরতাল করে, তাঁরা তাদের জীবনের বিনিময়ে ৬ দফার পক্ষে দাঁড়ায়। ৬ দফাকে কেন্দ্র করে উনসত্তরের গণভ্যূত্থান ঘটে। ৭০ এর নির্বাচনে একচেটিয়াভাবে আওয়মী লীগ জয়লাভ করে। ৬ দফার মাধ্যমে বাঙালি জাতীয়তাবাদ রাজনৈতিক ভিত্তি ও অর্থনৈতিক ভিত্তির যাত্রা শুরু করে। স্বশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করে ভৌগোলিক স্বাধীনতা নিশ্চিত করে। সবচেয়ে বিস্ময়কর হলো এতে সময় লাগে মাত্র ৫ বছর।

আজকের প্রজন্ম যেন, জনগণের রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্জন এবং অর্থনৈতিক বৈষম্যকে প্রতিহত করে অর্থনৈতিক সাম্য কায়েমের লক্ষ্য ৬ দফা থেকে শিক্ষা ও প্রেরণা লাভ করে। কারণ যে প্রতিকুল অবস্থা থেকে ৬ দফা কর্মসূচী একটি দিশেহারা জাতিকে পথ দেখায় এবং জাতিকে এগিয়ে নিয়ে যায়, তার তুলনা ইতিহাসে আর একটিও খুঁজে পাওয়া কী না সন্দেহ। (সমাপ্ত)

নাওজিশ মাহমুদ রাজনীতি বিশ্লেষক ও কলামিস্ট।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট