চট্টগ্রাম শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

প্রতিবন্ধীদের অবহেলা নয় পাশে দাঁড়াতে হবে

৩ ডিসেম্বর, ২০১৯ | ৪:১০ পূর্বাহ্ণ

আজ আন্তর্জাতিক প্রতিবন্ধী দিবস। বিশ্বের প্রতিবন্ধী মানুষের চিরন্তন মর্যাদা ও মূল্য এবং সমান অধিকার আদায়ে জাতিসংঘ ১৯৯২ খ্রিস্টাব্দ থেকে ৩ ডিসেম্বর দিবসটি পালন করে আসছে। বাংলাদেশেও নানা কর্মসূচিতে আজ পালিত হচ্ছে দিবসটি। উল্লেখ্য, প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠী এখন আর পরিবার ও সমাজের জন্যে বোঝা বলে বিবেচিত হচ্ছে না। একটু যত্ন ও পরিচর্যা, শিক্ষা-দীক্ষা ও নাগরিক অধিকার ভোগের সুযোগ পেলে তারাও যে বিভিন্ন ক্ষেত্রে মেধার পরিচয় দিতে পারেন, রাখতে পারেন পরিবার, সমাজ ও দেশের অগ্রগতিতে অবদান, তা প্রমাণিত হয়ে গেছে। যার কারণে এখন পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীর উন্নয়নে বহুমুখী কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। বাংলাদেশেও প্রতিবন্ধীদের উন্নয়ন এবং তাদের নাগরিক অধিকার সুরক্ষায় নেয়া হয়েছে বহুমাত্রিক কর্মসূচি। সরকারের উদ্যোগের ফলে প্রতিবন্ধীরা শিক্ষা-দীক্ষা, খেলাধুলা, চাকরি, বৈজ্ঞানিক আবিস্কারসহ নানা ক্ষেত্রে অংশগ্রহণের সুযোগ পাচ্ছেন। একইসঙ্গে তারা প্রমাণ দিচ্ছেন নিজেদের যোগ্য হিসেবে। নানা ক্ষেত্রে বিষ্ময়কর সাফল্যের ফলে এখন প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীর ব্যাপারে মানুষের নেতিবাচক ধারনায়ও এসেছে ইতিবাচক পরিবর্তন। ফলে দেশ-উন্নয়নে প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীর ভূমিকা রাখারও সুযোগ পাচ্ছেন। তবে, প্রতিবন্ধী সুরক্ষা আইনের পুরোপুরি বাস্তবায়ন না হওয়া, বাজেটে পর্যাপ্ত বরাদ্দ না থাকা, সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সমস্যা সম্ভাবনা নিয়ে ধারণা না থাকায় বৃহৎ এই জনগোষ্ঠী অধিকারবঞ্চিত হচ্ছে। একইসঙ্গে দেশও তাদের পূর্ণাঙ্গ সেবা ও অবদান থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
বাংলাদেশে প্রায় ১০ শতাংশ মানুষ কোনো না কোনোভাবে প্রতিবন্ধিতার শিকার। বিভিন্ন জরিপ প্রতিবেদন বলছে, ১৩ শতাংশ দুর্ঘটনায়, ৪৪ শতাংশ অসুস্থতায়, ২০ শতাংশ জন্মগতভাবে এবং ১৪ শতাংশ অজানা কারণে প্রতিবন্ধী হয়েছেন। আর মোট প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীর ৬ শতাংশ অর্থাৎ ৩.৫ মিলিয়ন হচ্ছে শিশু, যাদের বয়স ১৮ বছরের নিচে এবং ১০.২ মিলিয়ন হচ্ছে পূর্ণবয়স্ক প্রতিবন্ধী ব্যক্তি। প্রতিবন্ধী নাগরিকদের অধিকার রক্ষায় বাংলাদেশ ২০০৮ খ্রিস্টাব্দে জাতিসংঘের প্রতিবন্ধী সুরক্ষা সনদে স্বাক্ষর করেছে। ২০১৩ খ্রিস্টাব্দে প্রতিবন্ধী সুরক্ষা আইন হয় বাংলাদেশে। তারপরও সচেতনতা, পরিকল্পনায় অগ্রাধিকার না থাকা, আইন ও নীতির বাস্তবায়ন না হওয়া, বাজেটে অপ্রতুল বরাদ্দের কারণে প্রতিবন্ধীদের খারাপ অবস্থার ইতিবাচক পরিবর্তন হচ্ছে না কাক্সিক্ষত পরিমাণে। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, আন্তর্জাতিক সনদে স্বাক্ষর আর দেশে আইন থাকা সত্ত্বেও প্রতিবন্ধীরা অধিকারবঞ্চিত থাকছেন শুধু নীতিগুলোর বাস্তবায়নের অভাবে। সে কারণে দেশের প্রায় ১৫ ভাগ প্রতিবন্ধীদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বিনোদন ও চলাফেরায় নানা সমস্যায় পড়তে হয়। তাদের উন্নয়নে যে বাজেট বরাদ্দ হয় তা কোনো ভাবেই পর্যাপ্ত নয়। আবার বরাদ্দকৃত বাজেটেরও সুচারু বাস্তবায়ন হয় না। ফলে প্রতিবন্ধীদের উন্নয়ন ফিরিস্তির যে ঘোষণা শোনা যায়, বাস্তবে তা দেখা যায় না। প্রতিবন্ধীরা যেহেতু উন্নয়নকে ইতিবাচক এবং নেতিবাচক ভাবে প্রভাবিত করতে পারেন, সেহেতু যে কোনো উন্নয়ন পরিকল্পনায় তাদের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করতে হয়। এটা এখন প্রথিবীর সব দেশেই হচ্ছে। বাংলাদেশেও হচ্ছে। কিন্তু অপ্রতুল বাজেট এবং বাজেটের সুচারু বাস্তবায়ন না হওয়ায় কাক্সিক্ষত ফল আসছে না।
এসডিজি পরিকল্পনায় ৪, ৮, ১০, ১১ এবং ১৬ লক্ষ্যমাত্রায় প্রতিবন্ধীদের বিষয়টি আছে। আর এই জনগোষ্ঠীকে নিয়ে কাজ করতে হলে অর্থের দরকার হবে। তাই যৌক্তিক পরিমাণে অর্থ বরাদ্দ এবং দুর্নীতিমুক্ত অবস্থায় সে অর্থ খরচের বিষয়টি নিশ্চিত করা দরকার। বাজেট হতে হবে প্রতিবন্ধীবান্ধব। প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীর সঠিক তথ্যও নেই। ফলে, প্রতিবন্ধীদের নিয়ে পরিকল্পনা করতে গিয়ে সমস্যায় পড়তে হয়। পাশাপাশি সরকারি-বেসরকারি সব সেক্টরে প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীর জন্যে সংবিধান ও আইন স্বীকৃত সুযোগ-সুবিধা ও অধিকার গুলো দেওয়া হচ্ছে কী না, তা নজরদারী এবং মেনে চলতে কঠোরভাবে সবাইকে বাধ্য করা উচিত। এখনো কোনো পরিবহনে প্রতিবন্ধীদের চলাচলের জন্য সুযোগ-সুবিধা চালু করা হয়নি। সরকারি কর্মকর্তাদের মধ্যে প্রতিবন্ধীদের সমস্যা সম্ভাবনা নিয়ে ধারণা খুবই কম। বাংলাদেশের নীতি-নির্ধারকরা উন্নয়ন-চিন্তাও করছেন এই বিশাল জনগোষ্ঠীর কথা না ভেবেই। এখন সময় এসেছে এসব বিষয় আমলে নেওয়ার।
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশেই প্রতিবন্ধীদের বোঝা না ভেবে দেশ-উন্নয়নের সহায়ক শক্তি ভাবা হচ্ছে এখন। তারা প্রতিবন্ধীদের উন্নয়নে নানামুখী কর্মসূচি গ্রহণ করে মূলস্রােতে ফিরিয়ে এনেছে এবং তাদের সৃষ্টিশীল অবদানকে সমাজ ও দেশের অগ্রগতিতে সংযুক্ত করেছে। আমাদেরও উচিত হবে সে সব দৃষ্টান্ত অনুসরণে দেশের প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীর উন্নয়নে ব্যাপকভিত্তিক পদক্ষেপ নেয়া এবং দেশের সমৃদ্ধিতে তাদের সৃষ্টিশীল ভূমিকা রাখার সুযোগ করে দেয়া। আমাদের মনে রাখতে হবে, প্রতিবন্ধীরা সমাজের বোঝা নয়। তারা আমাদের সংসার, সমাজ ও দেশেরই অবিচ্ছেদ্য অংশ। তাই তাদের প্রতি কোনো প্রকার অবহেলা অনভিপ্রেত। তাদের বিকাশের জন্যে প্রয়োজন সংবেদনশীলতা, সহমর্মিতা ও সহযোগিতা। তারাও আমাদের পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের অংশ। দেশের নাগরিক। মানুষ ও নাগরিক হিসাবে প্রতিবন্ধীদের অধিকার কোনোভাবেই উপেক্ষা করা অনুচিত।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট