চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

বায়ুর প্রাণঘাতী দূষণ রোধ করতেই হবে

২ ডিসেম্বর, ২০১৯ | ১:২৮ পূর্বাহ্ণ

বাযু ছাড়া জীবজগতের অস্তিত্ব কল্পনা করা যায় না। যদিও পানি ছাড়া আমরা বেশ কিছুদিন বেঁচে থাকতে পারি। কিন্তু বায়ু ছাড়া দিন, ঘণ্টা দূরে থাক; আমরা সর্বোচ্চ তিন মিনিট অবধি বেঁচে থাকতে পারি। আর বিশুদ্ধ বায়ুর অভাব জীবনকে তিলে তিলে শেষ করে দেয়। মানুষ আক্রান্ত হয় নানা প্রাণঘাতী রোগ-ব্যাধিতে। যার কারণে জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে নির্মল বাযুসেবনের প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করার সুযোগ নেই। মহান সৃষ্টিকর্তা তাই জীবনধারনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান অফুরন্ত নির্মল বায়ু দিয়ে রেখেছেন প্রকৃতিতে। আমরা প্রকৃতি থেকে ইচ্ছেমতো বায়ু গ্রহণ করতে পারি কোনোরকম টাকা-পয়সার বিনিময় ছাড়াই। বাতাস থেকে আমরা যে অক্সিজেন গ্রহণ করি তা শরীরের বিপাক ক্রিয়ার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। আবার কার্বনডাইঅক্সাইড ছেড়ে দিয়ে আমরা শরীরকে দূষণমুক্ত রাখি। কিন্তু দুঃখজনক এবং আতঙ্কজনক ব্যাপারটি হচ্ছে, জীবন ধারণের এই অতি গুরুত্বপূর্ণ উপাদানটি এখন নানা দূষণের শিকার হচ্ছে। যে বাতাস আমরা বুক ভরে নিয়ে থাকি তা ধীরে ধীরে বিষময় হয়ে উঠছে। বায়ুদূষণের ঝুঁকিপূর্ণ তালিকায়

স্থান করে নিয়েছে আমাদের এই বাংলাদেশ। ঢাকার পর এখন বন্দরনগরী চট্টগ্রামও মারাত্মক বায়ুদূষণের শিকার। এটি চরম উদ্বেগকর।

‘দ্য স্টেট অব গ্লোবাল এয়ার-২০১৯’ শীর্ষক বৈশ্বিক প্রতিবেদন বলছে, বিশ্বের যে পাঁচ দেশের শতভাগ মানুষ দূষিত বায়ুর মধ্যে বসবাস করে, বাংলাদেশ সেগুলোর অন্যতম। আর বায়ুদূষণের ক্ষতিকর প্রভাবের ফলে মৃত্যুর সংখ্যার দিক থেকে বাংলাদেশ পঞ্চম। সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, পৃথিবীর যেসব শহর বায়ুদূষণে ধুঁকছে, সেগুলোর তালিকার একদম শীর্ষের কাছাকাছি রয়েছে ঢাকা। বায়ুদূষণের এমন চিত্র অত্যন্ত উদ্বেগের। নানা গবেষণা প্রতিবেদন বলছে, বিশ্বব্যাপী প্রতি বছর আনুমানিক ৭ মিলিয়ন মানুষ মারা যায় বায়ুদূষণের কারণে। এদের মধ্যে ৪ মিলিয়ন মানুষের বসবাস হলো এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে। আবার বায়ুদূষণের ফলে মৃত্যুবরণকারী নব্বই ভাগেরও বেশি মানুষ গরীব দেশগুলোর বাসিন্দা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার একটি হিসেবে দেখা যায়, বিশ্বে প্রতি ১০ জনের মধ্যে প্রায় ৯ জনই বেশি মাত্রায় দূষিত বায়ু শ্বাস-প্রশ্বাসে ব্যবহার করে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, বায়ুদূষণ এমন একটি মারাত্মক প্রভাবক, যার জন্য ২৪ শতাংশ পূর্ণবয়স্ক মানুষের হার্টের অসুখ, ২৫ শতাংশ স্টোক, ৪৩ শতাংশ পাল্মনারি রোগ এবং ২৯ শতাংশ ফুসফুস ক্যান্সার হয়ে থাকে। গ্রিনপিস থেকে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রতি ঘণ্টায় প্রায় ৮০০ মানুষ মারা যায় যারা বায়ুদূষণজনিত রোগে আক্রান্ত ছিল। বায়ুদূষণের অর্থনৈতিক প্রভাবও কম নয়। প্রতি বছর বিশ্বঅর্থনীতির ৫ ট্রিলিয়ন ডলার ক্ষতি হয় বায়ুদূষণের কারণে। বায়ুদূষণের শিকার শীর্ষ পাঁচ দেশেই রয়েছে বাংলাদেশ। তাহলে বাংলাদেশের ক্ষতির পরিমাণ কত হতে পারে তা সহজেই অনুমেয়।

আন্তর্জাতিক বিভিন্ন গবেষণা তথ্য বলছে, গত এক দশকে বৈশ্বিকভাবে পরিবেশ রক্ষায় বাংলাদেশ ৪০ ধাপ পিছিয়েছে। গতবছর প্রকাশিত বিশ্ব ব্যাংকের এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ২০১৫ খ্রিস্টাব্দে বাংলাদেশে যত মানুষ মৃত্যুবরণ করেছে তার ২৮ শতাংশই পবিবেশজনিত অসুখ-বিসুখের কারণে। নগর পরিবেশ ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থা শোচনীয়। অপরিকল্পিত ও দীর্ঘসূত্রতার উন্নয়নসহ নানা কারণে দেশের দুটি প্রধান শহর আজ মারাত্মক বায়ুদূষণের শিকার। কিন্তু দূষণ রোধে তেমন কোনো উদ্যোগ নেই। উন্নয়ন বরাদ্দের সময় এক শতাংশ পরিবেশ রক্ষায় ব্যয় করার শর্ত থাকলেও তা মানা হচ্ছে না। আবার যথাসময়েও শেষ করা হচ্ছে না উন্নয়ন কাজ। উন্নয়ন কাজে বিভিন্ন সংস্থার মধ্যেও নেই সমন্বয়। ফিটনেসহীন যানের বিরুদ্ধেও নেই আইনি পদক্ষেপ। ফলে এই শুষ্ক মৌসুমে রাস্তাঘাট ও নির্মাণাধীন বিভিন্ন স্থাপনার ধূলিকণা, সালফার ডাই-অক্সাইড, নাইট্রোজেন অক্সাইড, হাইড্রোকার্বন, কার্বন মনোঅক্সাইড, সিসা ও অ্যামোনিয়া নগরীর বায়ুকে প্রাণঘাতী করে তুলছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বায়ুদূষণ শিশুর বুদ্ধিমত্তা বিকাশ ও স্নায়ুর মারাত্মক ক্ষতিসাধন করে। গর্ভবতী মহিলাদের গর্ভপাত ও মৃত শিশু প্রসবের ঝুঁকি বৃদ্ধি করে। এর কারণে বিভিন্ন রোগ যেমন- হৃদরোগ, স্ট্রোক ও ফুসফুসের ক্যান্সার বাড়ছে। গবেষণায় দেখা গেছে, এরূপ দূষণের সঙ্গে দারিদ্র্য, স্বাস্থ্যসংকট ও সামাজিক অবিচারের বিষয়গুলোও অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত।

আমরা মনে করি, দেশ ও জনস্বার্থ বিবেচনায় বায়ুদূষণ প্রতিরোধে এখনই সুচিন্তিত পদক্ষেপ নেয়া জরুরি। এ বিষয়ে কালক্ষেপণের সুযোগ নেই। ধুলাদূষণ কমানোর জন্য প্রতিদিন নগরীর রাস্তায় পানি ছিটানো প্রয়োজন। উন্নয়ন ও সংস্কারের নামে যেসব সড়ক বছরব্যাপী খুঁড়ে রাখা হয়েছে দ্রুত সেসব সড়কের কাজ শেষ করতে ঠিকাদারকে চাপ দিতে হবে। বায়ুদূষণের সাথে জড়িত দায়ী ব্যাক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। একইসঙ্গে উন্নয়ন কাজে আইন অনুযায়ী পরিবেশ রক্ষার বিষয়টি গুরুত্ব পাচ্ছে কি না তা তদারক হওয়া জরুরি। বন্ধ করতে হবে অপরিকল্পিত উন্নয়ন কর্মকা-ও। বন্ধ করতে হবে বায়ুদূষণের উৎসসমূহ। জনসচেতনতা বৃদ্ধিতেও নিতে হবে বলিষ্ঠ কর্মসূচি।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট