চট্টগ্রাম শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

নগরীর বাতাসে স্বাস্থ্যঝুঁকি

২ ডিসেম্বর, ২০১৯ | ১:২৮ পূর্বাহ্ণ

চট্টগ্রামে চলতি মাসে বাতাসে ভাসমান বস্তুকণার পরিমাণ ছিল এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্সেও বা একিউআই ২৫৬। যেটিকে পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তা বলছেন, অসহনীয় ও খুবই অস্বাস্থ্যকর। এ মাসের কয়েকটি দিন ছাড়া বেশিরভাগ দিনই চট্টগ্রাম নগরীর বাতাসের কিউআইয়ের পরিমাণ ছিল সহনশীলতার বাইরে। নগরীর বায়ুদূষণের অন্যতম কারণ হচ্ছে, চট্টগ্রাম উন্নয়ন কতৃপক্ষ, ওয়াসা অনিয়ন্ত্রিত উন্নয়ন কাজসহ বিভিন্ন সংস্থার উন্নয়নমূলক কর্মকা-।

তাছাড়া নগরীর বিভিন্ন এলাকায় সড়ক সংস্কার, সম্প্রসারণ ও রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ির কারণে বাতাসে মিশে ভয়াবহ রাসায়নিক বর্জ্যের সৃষ্টি হয়। যা মানবস্বাস্থ্যের জন্য ভয়াবহ ক্ষতিকর। নগরীর আরাকান সড়ক, বহদ্দারহাট, চকবাজার, জামালখান, নন্দনকানন, আগ্রাবাদ একসেস রোড, হালিশহর, বাকলিয়া, পোর্ট কানেকটিং রোড, বন্দর, পতেঙ্গা ইপিজেড থানা এলাকাসহ অনেক জায়গায় এসব কারণে অসহনীয় বায়ুদূষণ হচ্ছে। এসব তদারকি ও খুঁড়াখুড়ি অবস্থায় ধুলাবালি নিয়ন্ত্রণ ও কাজ শেষে দ্রুত রাস্তা মেরামত করার দায়িত্ব সিটি কর্পোরশনের। কিন্তু বরাবরই নির্বিকার দায়িত্বশীল সংস্থা চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন ও পরিবেশ অধিদপ্তর। চট্টগ্রাম বিভাগীয় পরিবেশ অধিদপ্তর প্রদত্ত তথ্যমতে, চট্টগ্রামে বায়ুদূষণ দিন দিন বাড়ছে। শীত মৌসুমের শুরুতেই বাতাসে বস্তুকণার পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। স্বাভাবিক নিয়মে যার সহনীয় পরিমাণ ২০০ এসপিএম হলেও এখন তা ৪০০ পর্যন্ত গেছে। যেখানে বাতাসে এসপিএমের সহনীয় মাত্রা প্রতি ঘনমিটারে ২০০ মাইক্রোগ্রাম। সেখানে একে খান মোড়ে এর পরিমাণ ৩৮০ মাইক্রোগ্রাম। সিটি গেটে ৪০০ মাইক্রোগ্রাম, জিইসি মোড়ে ৪২০ মাইক্রোগ্রাম, আগ্রাবাদে ৪০০ মাইক্রোগ্রাম, ষোলশহরে ৪২০ মাইক্রোগ্রাম ও নিউমার্কেট মোড়ে ৪২০ মাইক্রোগ্রাম।

দিনে দিনে চট্টগ্রামে বায়ুদূষণের মাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাতাসে সালফার ডাই-অক্সাইড, সিসা, নাইট্রোজেন ডাই-অক্সাইডসহ অন্যান্য ক্ষতিকর উপাদান বিপজ্জনক মাত্রায় ছড়িয়ে পড়ায় পরিবেশ দূষিত হচ্ছে। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সহকারী অধ্যাপক (প্রাক্তন) ডা. শাহাবুল হুদার মতে, শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে রোগ-জীবাণু মিশ্রিত ধুলা বাতাসে ভাসমান বস্তুকণার কারণে শিশুদের নিউমোনিয়ার মতো মারাত্মক রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। মারাত্মক বায়ুদূষণের কারণে মানুষ প্রতিনিয়ত অ্যাজমা, হাঁপানি, শ্বাসকষ্ট, টাইফয়েড, সর্দিকাশি, চোখের ইনফেকশন ফুসফুসের ক্যান্সারসহ মারাত্মক ক্রনিক রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। বাতাসে ধুলার পরিমাণ বেশি থাকায় শ্বাসকষ্টে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যাও বাড়ছে আগের চেয়ে ৩-৪ গুণ। চট্টগ্রামকে ধুলোবালি মুক্ত রাখার দায়িত্ব সিটি কর্পোরশনের, কিন্তু চসিক সেই দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করছে না। চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের (চসিক) স্বয়ংক্রিয়ভাবে রাস্তার ধুলাবালি পরিষ্কারের তিনটি ‘সুইপিং গাড়ি আছে। কয়েক বছর ধরে চসিকের গ্যারাজে পড়ে আছে। ১৬টি পানিবাহী বিশেষ গাড়ি থাকলেও সেগুলো নিয়মিত ব্যবহার হয়না। চসিকের ৭০০ পরিছন্নকর্মী রয়েছে। কিন্তু এক তৃতীয়াংশ রাস্তার ধুলোবালি পরিস্কারের কাজ করা হয় না। ঈষবধহ অরৎ ধহফ ঝঁংঃধরহধনষব ঊহারৎড়হসবহঃ (ঈঅঝঊ)-)-এর অধীনে উবঢ়ধৎঃসবহঃ ড়ভ ঊহারৎড়হসবহঃ বাতাসের গুণগত মান পরীক্ষা করে তাদের রিপোর্টে বলেছে, ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট, বরিশাল, রাজশাহী, খুলনা, গাজীপুর ও নারায়ণগঞ্জের বাতাস অতিরিক্ত দূষিত। এই পরিবেশে স্বাস্থ্যসম্মত জীবন একেবারেই অসম্ভব। কারখানা থেকে নির্গত ধোঁয়া, যন্ত্রচালিত যানবাহন ও ইটভাটা থেকে নির্গত গ্যাস, নির্মাণাধীন জায়গা থেকে বের হওয়া ধুলোই হলো বাতাস বিষাক্ত হওয়ার মূল কারণ।

গবেষণায় তথ্য অনুযায়ী, বায়ুদূষণের ক্ষতিকর প্রভাব সব থেকে বেশি পড়ে শিশুদের ওপর, তাদের বয়স ১০ থেকে ১২ বছরের নিচে। বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশের বিভিন্ন শহরে বছরে প্রায় ৮০ হাজার মানুষ মারা যাচ্ছেন শুধু বায়ুদূষণের কারণে এবং প্রায় ১০ লাখ মানুষ, বিশেষ করে শিশু এবং গর্ভবতী মায়েরা আছেন অনেক ধরনের স্বাস্থ্যঝুঁকিতে। এর প্রধান কারণ হিসেবে বাতাসে সিসার উপাদান বেশি থাকাকে চিহ্নিত করা হয়েছে। যে কারণে শিশুরা সহজেই হৃদরোগ এবং শ্বাস-প্রশ্বাসজনিত রোগে ভুগে থাকে। বর্তমানে আমাদের দেশে শহরগুলোর রাস্তাঘাটে শিশুরা মুখে মাস্ক পরে চলাফেরা করছে, এই দৃশ্য এখন একটি সাধারণ বিষয়। রাস্তায় যেমন ধুলাবালি তেমন গাড়ি এবং কলকারখানার বিষাক্ত ধোঁয়া। এ থেকে বাঁচার জন্য মুখে মাস্ক পরা হয়। কিন্তু এতেও পুরোপুরি নিরাপদ নয় শিশুরা। বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের মতে মাস্ক পরলেও নিঃশ্বাসের সঙ্গে কিছু জীবাণু শরীরের ভেতর প্রবেশ করবেই। যা পরর্বতী সময়ে ভয়ংকর হয়ে ওঠে। বায়ুুদূষণ নিয়ে কাজ করে এমন একটি সংস্থা ‘স্টেট অব গ্লোবাল এয়ার’র প্রতিবেদনেও বিষয়টি ওঠে এসেছে। সেখানে বলা হচ্ছে, বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর বাসিন্দাদের ৯০ শতাংশের বেশি মানুষ কোনো না কোনোভাবে বায়ুুদূষণের মধ্যে বাস করছেন। বায়ুুদূষণের কারণে বাংলাদেশে প্রতি বছর মারা যাচ্ছেন ১ লাখ ২৩ হাজার মানুষ আর ভারত ও চীনে মারা গেছেন ১২ লাখ মানুষ। সংস্থাটি তাদের প্রতিবেদনে বলেছে, ২০১৭ সালের হিসাবে প্রতি ১০ জনের মধ্যে একজন বায়ুুদূষণের কারণে মারা যাচ্ছেন। বায়ুুদূষণের শিকার হয়ে যে ১০টি দেশের মানুষ সবচেয়ে বেশি মারা যাচ্ছেন, সেসব দেশের মধ্যে রয়েছে চীন, ভারত, পাকিস্তান, ইন্দোনেশিয়া, বাংলাদেশ, নাইজেরিয়া আর যুক্তরাষ্ট্র অন্যতম। যার মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান পঞ্চম।

আলীউর রহমান
সাংবাদিক; পরিবেশকর্মী।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট