চট্টগ্রাম মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

চাই বলিষ্ঠ প্রতিরোধ উদ্যোগ লাম্পি স্কিন রোগের প্রাদুর্ভাব

১ ডিসেম্বর, ২০১৯ | ২:০৩ পূর্বাহ্ণ

চট্টগ্রামসহ সারাদেশে গবাদি পশুর ভাইরাসজনিত চর্মরোগ লাম্পি স্কিন ডিজিজ (এলএসডি) দ্রুত ছড়িয়ে পড়ার খবরটি উদ্বেগকর। কারণ একটা খামারকে অর্থনৈতিকভাবে ধসিয়ে দেয়ার জন্য খুরারোগের চেয়ে অনেক বেশি ভয়ংকর রোগ হিসাবে ধরা হয় এই রোগটিকে। এ অবস্থায় খামারি ও গবাদি পশুর মালিকদের মধ্যে আতঙ্ক তৈরি হওয়াই স্বাভাবিক। তবে রোগটির বিস্তার ঠেকাতে জরুরিভিত্তিতে বলিষ্ঠ প্রতিরোধ উদ্যোগ থাকলে ক্ষয়ক্ষতি এড়ানো সম্ভব। আশার কথা হচ্ছে, এ ব্যাপারে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর খামারিদের সচেতন করার পাশাপাশি রোগটির বিস্তার রোধে উদ্যোগ নিয়েছে।

দৈনিক পূর্বকোণে গতকাল প্রকাশিত এক খবরে দেখা যাচ্ছে, চট্টগ্রামের রাউজানে খামার ও গৃহস্থালির বিভিন্ন গরুর মধ্যে ছড়িয়ে পড়ছে লাম্পি স্কিন রোগ। গত এক মাসে এ রোগে আক্রান্ত হয়েছে উপজেলার প্রায় ৩ হাজার গরু। এদিকে রোগটির টিকা ও সঠিক ওষুধ না পাওয়ায় উৎকণ্ঠায় আছে খামারি ও গৃহস্থালিরা। অন্যান্য স্থানেও রোগটির দ্রুত বিস্তার ঘটছে বলে গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়েছে। শীতে রোগটির প্রকোপ আরো বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। উল্লেখ্য, মূলত এক প্রকার পক্স ভাইরাস বা এলএসডি ভাইরাসের সংক্রমণে গবাদিপশুতে এই রোগ দেখা দেয় এবং এক গরু থেকে আরেক গরুতে ছড়িয়ে পড়ে। প্রধানত যে সময়ে মশা মাছি অধিক বংশবিস্তার করে, সে সময়ে প্রাণঘাতী এই রোগটি ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়ে। এ রোগে আক্রান্ত গরুর শরীরের তাপমাত্রা থাকে ১০৩-১০৫ ডিগ্রিতে। গরু খাওয়া-দাওয়া বন্ধ করে দেয়। এই রোগে গরু বা মহিষের চামড়ার নিচে গোটা শরীর জুড়ে গুটি আকারে ছড়িয়ে পড়ে। এক পর্যায়ে ক্ষত সৃষ্টি হয়। তবে এ রোগে মানুষ আক্রান্ত হয় না। আক্রান্ত গবাদি পশুর শরীরে প্রথমে ছোট আঁচিল আকারে রোগটি দেখা দেয় ও পরে তা ছড়িয়ে পড়ে। এক পর্যায়ে ক্ষত হওয়া স্থান থেকে চামড়া খসে পড়ে যায়। ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দে আফ্রিকার ‘জাম্বিয়া’ প্রথম অফিসিয়ালি সনাক্ত হয় রোগটি। ১৯৪৩ থেকে ৪৫ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে রোগটি মহাদেশের বিস্তীর্ণ এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। এই সময়ের মধ্যে দক্ষিণ আফ্রিকা, বতসোয়ানা, মোজাম্বিকসহ পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতে হাজার হাজার গরু আক্রান্ত হয়ে মারা যায় এবং শত শত খামার বন্ধ হয়ে যায়। পরবর্তীতে সত্তর এবং আশির দশকে আফ্রিকার প্রায় সব দেশের গরু এই রোগে আক্রান্ত হয় এবং হাজার হাজার খামার বন্ধ হয়ে যায়। এই রোগের গড় মৃত্যুহার আফ্রিকাতে ৪০%।

মূলত আফ্রিকায় একাধিকবার মহামারী আকারে দেখা গেলেও বাংলাদেশে গরুতে লাম্পি স্কিন ডিজিজের প্রাদুর্ভাব কখনো মহামারী আকারে দেখা যায়নি। বাংলাদেশে এই প্রথম রোগটির প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে চট্টগ্রাম ও নওগাঁসহ কয়েকটি জেলায়। চলতি বছরের জুলাইয়ে কর্ণফুলী উপজেলার একটি খামারে ধরা পড়ে রোগটি। পরবর্তী সময়ে ছড়ায় অন্যান্য জেলায়। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, এরই মধ্যে ৪০টি জেলায় ছড়িয়েছে লাম্পি স্কিন ডিজিজ। এসব জেলায় আক্রান্ত হয়েছে প্রায় আড়াই লাখ গরু। কিছু গরু মারাও গেছে। চট্টগ্রামের মিরসরাই ও সাতকানিয়া এবং নওগাঁর রাণীনগর ও সাপাহার উপজেলার খামারি ও গবাদি পশু মালিকদের মধ্যে এই রোগ রীতিমতো আতঙ্ক তৈরি করেছে। মিরসরাইয়ে প্রায় ৬ হাজার গবাদি পশু এ রোগে আক্রান্ত হয়েছে। মারা গেছে ১০টি গরু। এখন রাউজানে হানা দিয়েছে রোগটি। তবে সতর্ক পদক্ষেপ থাকলে রোগটির বিস্তার ঠেকানো সম্ভব। এ ব্যাপারে প্রাণীসম্পদ অধিদপ্তর জনসচেতনতা বৃদ্ধি ও প্রয়োজনীয় পথ্য সরবরাহ এবং দ্রুত চিকিৎসা দিয়ে রোগটির বিস্তার ঠেকাতে ভূমিকা রাখতে পারে।

উল্লেখ্য, ভারত থেকে আমদানি বন্ধ হওয়ার পর দেশে গরু পরিপালন বাড়তে থাকে। এতে সাফল্যও পান খামারিরা। গত অর্থবছরই ২ কোটি ৪২ লাখ ছাড়িয়ে গেছে গরুর সংখ্যা। বাড়ছে খামারের সংখ্যাও। লাম্পি স্কিন ডিজিজের প্রাদুর্ভাব থেকে খামারকে মুক্ত রাখা না গেলে এ অগ্রযাত্রায় বিঘœ ঘটতে পারে। এ রোগে মৃত্যুহার কম। এটি আশার কথা। কিন্তু ঝুঁকি বাড়াচ্ছে দুগ্ধ ও চামড়াশিল্পে। কারণ এ রোগে আক্রান্ত হলে পশুর চামড়া অনেকটাই অকার্যকর হয়ে যায়। আবার গাভী আক্রান্ত হলে দুগ্ধ উৎপাদন শূন্যের কোটায় নেমে আসে। দেশের দুগ্ধ উৎপাদন খামারগুলোয় এর প্রভাব পড়ছে।

উৎপাদন কমে যাওয়ায় আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন খামারিরা। অনেকে বাণিজ্যিকভাবে গরু পালন ছেড়েও দিচ্ছেন।

এ অবস্থায় দ্রুত রোগটি প্রতিরোধের ব্যবস্থা না নিলে ঝুঁকির মধ্যে পড়বে দেশের প্রাণিসম্পদ খাত। জানা গেছে, প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম বিভাগের সব উপজেলায় এ রোগে আক্রান্ত গরুর সুস্থতার জন্য প্রচারণা চালাচ্ছে। খামারিদের সঙ্গে বসে সমস্যা সমাধানের পথ দেখাচ্ছে। এটি ইতিবাচক। তবে যেহেতু মশামাছির মাধ্যমেই প্রধানত রোগটি ছড়াচ্ছে সেহেতু খামারিদের এ ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখতে হবে। মশামাছি বা কোনো প্রকারের পোকামাকড় যাতে গবাদি পশুর উপর বসতে না পারে, সে ব্যাপারে সাবধান থাকতে হবে। প্রয়োজনে মশারি টানানোর ব্যবস্থা করতে হবে। এতে সহজে রোগটি ছড়াতে পারবে না। সংশ্লিষ্ট এলাকায় ভেটেরিনারি মেডিক্যাল টিমের কার্যক্রম এবং সেবাও জোরদার করতে হবে।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট