চট্টগ্রাম শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

বইপড়া আন্দোলনের পুরোধা মোহাম্মদ আমিন

জিয়া হাবীব আহসান

৩০ নভেম্বর, ২০১৯ | ২:১৩ পূর্বাহ্ণ

জীবনের পরতে পরতে ঘন কুয়াশা ভেদ করে আলোর ছটা ছড়ায় যে সূর্য তারই নাম বই। বইয়ের জগতে যে একবার প্রবেশ করেছে একনিষ্ঠভাবে সেই কুড়িয়েছে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম মণিমুক্তা। আমি একজন বইয়ের গ্রাহক, পাঠক, লেখক ও সংরক্ষক বিধায় চট্টগ্রাম মহানগরীর জনপ্রিয় লাইব্রেরীগুলোর সাথে আমার পরিচিতি একেবারে শৈশবের। আমার আব্বাজান এবং মরহুম দাদাজানও ছিলেন বইয়ের পোকা। নানা মরহুম এডভোকেট এজাহার হোসেইন বি.এল পঞ্চাশের দশকে মোমিন রোডে ‘দি স্ট্যান্ডার্ড লিটারেচার কোম্পানি লিঃ’ নামীয় একটি অত্যাধুনিক পাঠাগার প্রতিষ্ঠা করেন। শুনেছি অনেকের আজকের বাতিঘর-এর মতো তখন ঐ পাঠাগারে দেশী বিদেশী জার্নাল ও পত্রিকা পড়ার সুযোগ থাকায় সুধীজনের বিপুল আনাগোনা ছিল। এ কারণে আমার মরহুম আম্মাজানেরও বই পত্রিকা পড়ার অভ্যাস ছিল। আর আমার উত্তরাধিকারী সূত্রে প্রাপ্ত এই সু-অভ্যাস গুণে গুণান্বিত করতে সাহায্য করেছেন আমার শ্রদ্ধেয় মরহুম আব্বাজান প্রখ্যাত আইনজীবী মরহুম এ এম য়্যাহ্য়্যা। সময়টি ১৯৭১, দেশ স্বাধীন হলো সবেমাত্র। আমার বয়স আনুমানিক ৯ বছর। বই পড়ে বুঝার মত বুদ্ধি যথেষ্ট হয়েছিল। নিজে নিজে পাঠাগার গড়ে তুলতে শিখে ফেলেছি।

বাবা সব সময় বলতেন “বই কখনো বিশ্বাসঘাতকতা করবে না, বই জীবনের সর্বোত্তম বন্ধু।” তখনি কথাটা মনে বাসা বেঁধে ফেলে। সে ৯ বছর বয়সে বাবার সাথে প্রথম কারেন্ট বুক সেন্টারে গিয়েছিলাম। সেখানে ক্যাশে বসেছিলেন শ্রদ্বেয় আমিন চাচা, কর্মব্যস্ত হাতজোড়া, ক্যারোলিনের সাদা হাফশার্ট, চোখে কালো ফ্রেমের পুরো চশমা, মাথা ভর্তি টাক, শ্যামল বরণ সব মিলিয়ে রাশভারী চাচার। চাচার একটু মুচকি হাসি আজও চোখে ভাসে। তখনকার সময় চট্টগ্রামের কারেন্ট বুক সেন্টার নানাবিধ/ধরনের প্রকাশনা বিপননের অসংখ্য প্রতিষ্ঠান গুলোর মধ্যে ছিল অন্যতম। মহানগরীর প্রাণকেন্দ্র রিয়াজুদ্দিন বাজার এবং বিপণীবিতানের মধ্যবর্তী জুবিলী রোডে অবস্থিত জলসা সিনেমা ঘরকে আলোকিত করে রেখেছিল এই প্রতিষ্ঠান। সে গ্রন্থ বিপণীতে গিয়ে প্রথম সাক্ষাৎ পেয়েছিলাম মোহাম্মদ আমিন চাচার। সে দোকানে অজস্র মানুষ এসে ভিড় জমতো, আজ যা শুধু স্মৃতি। সেখানে যেকোন দেশী বিদেশী ম্যাগাজিন, ছড়া, পত্র-পত্রিকা, প্রকাশনা, কার্টুন, কমিকস, গল্প বই ইত্যাদি চাওয়া মাত্র পাওয়া যেত। চাচার বড় ছেলে মুবিনভাই দোকানে বাবাকে সহযোগিতা করতেন, আমরা কি বই খুঁজছি ইশারায় বুঝে যেতেন। অনেক সময় স্কুল ছুটির পর কত বইয়ের পাতা উল্টাতে উল্টাতে পড়ে ফেলেছি তাঁর ইয়াত্তা নেই। আমিন চাচার ছেলে মুবিনভাইয়ের সাথে ক্রমান্বয়ে সখ্যতা গড়ে উঠে। বড্ড বন্ধু বৎসল মানুষ। পিতার সংযোগগুলো তিনি এখনও রক্ষা করে চলেছেন। পাঁচ ভাই-বোনের (২ বোন ৩ ভাই) মধ্যে মুবিন ভাইদের মধ্যে বড়, শাহীন ও শামীম ছোট। বর্তমানে মিমি সুপার মার্কেটের ৩য় তলায় ও ভিআইপি টাওয়ারের ২য় তলায় কারেন্ট বুক সেন্টারের শাখা রয়েছে। মূল শাখাটির পরিবেশগত কারণে আর টিকে রইল না। এক কথায় শিক্ষক, অধ্যাপক, ডাক্তার, প্রকৌশলী, আইনজীবী, শিল্পী, বুদ্ধিজীবী, ছাত্র, আমলা, কর্মজীবী, চাকুরীজীবী, পেশাজীবী, শ্রমজীবী, ব্যবসায়ী, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, গল্পকার, নিবন্ধকার, কাল্পিক, উপন্যাসিক, প্রবন্ধকার, ছড়াকার, সকল ধর্ম বর্ণ গোত্রের লোকজনের মিলন মেলায় পরিণত হয়েছিল কারেন্ট বুক সেন্টার । যা শ্রদ্বেয় আমিন চাচার সাফল্য এবং কৃতিত্ব। গ্রন্থ বেচা-কেনার পাশাপাশি তিনি ক্রেতার সাথে খোশালাপে মগ্ন থাকতেন। কিন্তু ১৯৮৮ সালের ৩০ নভেম্বর মাসের ত্রিশ তারিখে তিনি অসংখ্য গুণগ্রাহীকে ফাঁকি দিয়ে অন্তিম যাত্রায় রওনা দিয়েছেন। স্মৃতিতে স্মরণে আজো তাঁর উপস্থিতি দেদীপ্যমান ও বিরজামান রয়েছে বাংলাদেশের সকল বইপ্রেমিক মানুষের হৃদয়ে। ‘বই হোক নিত্য সঙ্গী’ তাঁর এ শ্লোগানটি তিনি জনপ্রিয় শ্লোগানে পরিণত করেছিলেন।

কারেন্ট বুক সেন্টারের প্রতিটি বইতে একটি সীল মেরে দেয়া হতো ‘বই হোক নিত্যসঙ্গী’। বিপনী বিতানে অনেক বই এর দোকান ছিল। এখন সেগুলো দখল করেছে স্বর্ণের দোকান। এর থেকে বুঝা যায় আমাদের মানসিকতা ও রুচিবোধ কোথায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে। জ্ঞানের যায়গা দখল করেছে স্বর্ণালংকার। এই দৈন্যদশায় আমিন চাচার ভূমিকার কথা খুব মনে পড়ে। তাঁর অভাব পূরণীয় হবার নয়। মোহাম্মদ আমিন ১৯৩৩ সালে ঝালকাঠিতে জন্মগ্রহণ করেন। তালুকদারী পরিবারে তাঁর জন্ম। কিন্তু তাঁর আচরণে এবং আলাপে কখনো তালুকদার মনোভাব প্রকাশ পায়নি। চট্টগ্রামের মাটি ও মানুষের সাথে তাঁর বন্ধন ছিল সুদৃঢ়। তাঁর বাবা হাজী আব্দুল হামিদ তালুকদার, মা বিবি রত্না। এগারো ভাইবোনের মধ্যে তিনি ছিলেন তৃতীয়। মাত্র ১৭ বছর বয়সে ১৯৫০ সালে তিনি পৈতৃক ব্যবসার কারণে বিখ্যাত জনপদ ঝালকাঠি তালুকদার বাড়ি হতে চট্টগ্রামে পাড়ি জমান। তখন সদ্য স্বাধীন দেশ পূর্ব পাকিস্তান। মাত্র তিন বছর পূর্বে বৃটিশ পরাধীনতার নাগপাশ হতে দেশ স্বাধীন হয়েছিল। নিজেকে নিছক কোন সাধারণ ব্যবসার সাথে জড়াতে আগে থেকে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ছিলেন তাই সে সময় বই ও পত্র পত্রিকা বিক্রিকে তিনি তার জীবনের নেশা ও পেশা হিসেবে গ্রহণ করেন। তাছাড়া সে যৌবন বয়সে তার অন্তর জুড়ে চলছে শিক্ষা সংস্কৃতির ফাল্গুণ হাওয়া। ১৯৫১ সালে স্বল্প পুঁজিতে কোতোয়ালী থানার উত্তরের দিকে রাস্তার ধারে পত্র-পত্রিকার দোকান দিয়ে জীবনের পথ চলা শুরু করেন এবং ১৯৬৭ সালে তিনি জলসা ভবনে ক্যারেন্ট বুক সেন্টার নামে গ্রন্থ বিপনী শুরু করেন। আর এই বিপনি পরিচিতি পেতে বেশি সময় লাগে নি।

দোকান সবসময় ক্রেতার সমাগমে জমজমাট থাকত। তাই আমিন চাচাকে চট্টগ্রামের পাঠক সৃষ্টির কারিগরও বলা হতো। মাত্র ৫৫ বছর বয়সে আমিন চাচা মৃত্যুবরণ করলেও অল্প সময়ে তিনি দেশে হাজার হাজার বইপ্রেমিক মানুষ সৃষ্টি করেন যা বংশ পরস্পরায় জারী রয়েছে। তিনি চলে গেলেও তাঁর কর্ম ও স্মৃতির মাঝে অনাদীকাল অমর হয়ে থাকবেন। মহান প্রভূ এ সৃষ্টিশীল মানুষটিকে উত্তম পুরস্কার দান করুন। আমীন।

এ. এম জিয়া হাবীব আহসান আইনজীবী, কলামিষ্ট, সু-শাসন ও মানবাধিকারকর্মী।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট