চট্টগ্রাম বুধবার, ২৪ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধগতি, জনদুর্ভোগ ও ব্যবসা বিষয়ে ইসলামের নির্দেশনা

ড. মুহাম্মদ নুর হোসাইন

২৯ নভেম্বর, ২০১৯ | ২:৩০ পূর্বাহ্ণ

বিগত কয়েক বছর যাবৎ দ্রব্যমূল্য মোটামুটি স্থিতিশীল ছিল। হঠাৎ করে পেঁয়াজের দরে আগুন লেগেছে, যা রেকর্ড হয়ে গেছে। পেঁয়াজের দর নিয়ে আলোচনা হয়েছে জাতীয় সংসদ থেকে রান্না ঘর পর্যন্ত সর্বত্র। পনের-বিশ টাকার পেঁয়াজ দুইশ টাকা ছাড়িয়ে যাওয়া রীতিমত অবিশ্বাস্য। পরামর্শ এসেছে পেঁয়াজ মুক্ত খাবারে অভ্যস্ত হওয়ার। বিলম্বে হলেও ভর্তুকি দিয়ে পাকিস্তানসহ কয়েকটি রাষ্ট্র থেকে পেঁয়াজ আমদানি শুরু হয়েছে। এ সুবাদে পেঁয়াজের অর্থমূল্যের পাশাপাশি মর্যাদাগত মূল্যও বেড়েছে। আগে আসত ট্রাকে চড়ে আর এখন আসছে বিমানে চড়ে। বিগত সেপ্টেম্বর থেকে পেঁয়াজসহ কয়েকটি নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ার কারণ কমবেশি সবার জানা আছে। মূল কারণ হলো, পেঁয়াজের ক্ষেত্রেও আমরা আমদানিনির্ভর। দেশীয় উৎপাদনের কয়েকগুণ বেশি আমদানি করতে হয় আশে-পাশের রাষ্ট্র থেকে। তাদের রপ্তানি বন্ধ করা মাত্র মন্দ প্রভাব পড়ে বাংলাদেশের বাজারে। এবারও তার ব্যত্যয় ঘটেনি।

এবার পেঁয়াজের দাম এত বেশি বেড়ে যাওয়ার পেছনে আরেকটি কারণ হলো সুযোগ সন্ধানী ব্যবসায়ীরা, যারা ঝোপ বুঝে কোপ মারার জন্য উৎপেতে থাকেন এবং সময়ে সময়ে এভাবে সুযোগ গ্রহণ করেন। তাঁরা কয়েকদিনের ব্যবসায় বহুগুণ লাভে পণ্য বিক্রি করে কাড়ি কাড়ি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। তাঁরা এবার পেঁয়াজের ব্যবসায় হাতিয়ে নিয়েছেন প্রায় দেড়শ কোটি টাকা (দৈনিক পূর্বকোণ, ২০/১১/২০১৯)। একেক সময় একেক পণ্যের ক্ষেত্রে এমন হয়ে থাকে। অস্থির হয়ে উঠে বাজার। এর মন্দ প্রভাব পড়ে সর্বত্র। খেটেখাওয়া ও নি¤œবিত্ত পরিবারের অবস্থা হয়ে যায় কাহিল। তখন মিডিয়ার ভাইদেরকে লেখালেখি করতে হয়। সরকারকে ব্যবস্থা নিতে হয় বাজার মনিটরিং করা, টিসিবির মাধ্যমে আমদানি করা, খোলাবাজারে পণ্য বিক্রি করা ইত্যাদির। এ সুযোগে রাজনৈতিক মাঠ গরম হয়ে উঠে। ইস্যু পেয়ে যায় বিরোধী পক্ষ। সাধারণ জনগণের ব্যবহার্য নিত্যপণ্য হলে তো তাদের দুর্ভোগের সীমা থাকে না। যেমনটি এখন হচ্ছে পেঁয়াজ নিয়ে। এ ক্ষেত্রে সরকারের আগাম ব্যবস্থা থাকা প্রয়োজন। টিসিবিকে আরো সক্রিয় করে অসাধু আমদানিকারক ও ব্যবসায়ীদের দৌরাত্ম বন্ধ করা উচিৎ। বাজার মনিটরিং সেলকে নিয়মিত করা প্রয়োজন। চাকুরীজীবীদের ন্যায় আমদানিকারকদেরও টিন সার্টিফিকেট অনুযায়ী দৈনিক আয়-ব্যয়ের খতিয়ান বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক মনিটরিং করার বিষয়টি বিবেচনা করা যেতে পারে। তবে মুক্তবাজার অর্থনীতিতে ব্যবসায়ীদেরকে এতবেশি নিয়ন্ত্রণ করাও কঠিন। তাই ব্যবসায়ীরা যদি সরকারবান্ধব না হন তাহলে শুধু শাস্তির ব্যবস্থা করে সরকারের পক্ষে দ্রব্যমূল্যের লাগাম টেনে ধরা অসম্ভব। ব্যবসায়ীরা সদা ব্যবসাবান্ধব সরকার চান। কিন্তু সরকারবান্ধব ব্যবসায়ী হওয়ার বিষয়টি তেমন গুরুত্ব পায় না। সরকারবান্ধব মানে হলো জনবান্ধব বা ভোক্তাবান্ধব। মূলত কোন রাষ্ট্র সমৃদ্ধ হতে হলে সরকারকে প্রত্যেক পেশাজীবীবান্ধব এবং প্রত্যেক পেশাজীবীকে সরকারবান্ধব হওয়ার বিকল্প নেই। সেক্ষেত্রে সরকারের কেউ যদি অসাধু সিন্ডিকেটের সাথে জড়িত থাকেন অথবা তাদেরকে মদদ দেন তাহলে সেটি আত্মঘাতিমূলক কর্মকা- ছাড়া কিছু নয়। এমতাবস্থায় বাজার নিয়ন্ত্রণ করা আরো কঠিন হয়ে পড়ে। কারণ, রক্ষক যখন ভক্ষক, তখন তো বেঁচে থাকা দায়। পেঁয়াজের মূল্যবৃদ্ধি এবং এ ক্ষেত্রে কৃত্রিম সংকট তৈরির পেছনে আমদানিকারক ও আড়তদারদের যারাই জাড়িত থাকুক না কেন তারা সরকার ও জনগণের শত্রু।

পণ্যের উৎপাদন মূল্য (ঈড়ংঃ ড়ভ চৎড়ফঁপঃরড়হ) বা কেনা মূল্যের এবং বাজার মূল্যের (গধৎশবঃ চৎরপব) ব্যবধানের ভিত্তিতে বিক্রেতা মুনাফা করবেন- এটা স্বাভাবিক। কিন্তু কোন্ পণ্যে কত টাকা মুনাফা করবেন তার নীতিমালা থাকা উচিৎ। এক্ষেত্রে জেলা ভিত্তিক নিত্যদিনের পণ্যমূল্য ওয়েবসাইটে এবং বড় বড় বাজারের মুখে ডিজিটাল বোর্ডে দেখানোর ব্যবস্থা করা যেতে পারে। প্রত্যেক দোকানে পণ্যের গায়ে দাম লিখে রাখার বর্তমান বিধানকে আরো কার্যকর করা প্রয়োজন। ক্রেতাসাধারণের উচিৎ পেকেটজাত দ্রব্যের গায়ে লেখার চেয়ে বেশি দামে পণ্য ক্রয় না করা এবং গুজবে কান দিয়ে প্রয়োজনাতিরিক্ত পণ্য ক্রয় না করা।

তাহলে ব্যবসায়ীদেরকে ন্যায্য মূল্যে পণ্য বিক্রি করতে হবে। যদি পরিবহণ ব্যয়, কাঁচা মাল, আমদানি ব্যয় বেড়ে যায় তাহলে তা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ পুনঃনির্ধারণ করে প্রকাশ করবে। গুদাম মনিটরিং করারও ব্যবস্থা রাখা দরকার। স্থায়ী সমাধান হলো নিত্যপণ্যের ক্ষেত্রে স্বনির্ভরতা অর্জন করা। চাউলের ক্ষেত্রে ইতিমধ্যে স্বনির্ভরতা এসেছে। অন্যান্য পণ্যের ক্ষেত্রেও স্বনির্ভরতা অর্জন করতে হবে। এটা অসম্ভব কিছু নয়। তবে এক্ষেত্রে জনগণকে স্বদেশীয় পণ্য ব্যবহার করার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। “দেশীয় পণ্য কিনে হবো ধন্য” শ্লোগানকে কথায় না রেখে বাস্তবে রূপ দিতে হবে। অব্যবহৃত প্রতিটি ইঞ্চি জায়গাতে চাষাবাদ করার বিষয়টি নতুন করে ভাবতে হবে। গবেষণা করে আরো উন্নত পেঁয়াজ-রসুন এবং এজাতীয় পণ্য উৎপাদনের ব্যবস্থা করা হলে এবং দেশীয় কৃষককে ন্যায্য মূল্য দেয়া হলে এ জাতীয় সমস্যার স্থায়ী সমাধান হবে। বিগত কয়েক বছর থেকে পশু পালন এবং পশু মোটাতাজাকরণের ক্ষেত্রে খামারীদেরকে সরকারীভাবে সহযোগিতা দেয়ার ফলে কুরবানির পশুর অপ্রতুলতা দূর হয়েছে। এখন দেশীয় পশু দিয়ে অধিকাংশ কুরবানি হচ্ছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় প্রত্যেকটি পণ্যের ক্ষেত্রে একই ব্যবস্থা গ্রহণ করলে এক্ষেত্রে আমদানি ও পরনির্ভরশীলতা কমবে। আমদানিব্যয়ও কমবে। পার্শ¦বর্তী রাষ্ট্রের সাথে আমাদের বাণিজ্য ঘাটতিও হ্রাস পাবে।

শিল্পপতি, আমাদানিকারক ও আড়তদারদেরকেও জনবান্ধব হতে হবে। তাঁরা মুনাফার জন্য ব্যবসা করবেন; কিন্তু অতিমুনাফা, রাতারাতি কোটিপতি হওয়ার চিন্তা, বাজার অস্থিতিশীল করে জনগণকে কষ্ট দেয়া, গুজব ছড়িয়ে মূল্য বৃদ্ধি করা, বিপদের সময় ভোক্তাদের পাশে না দাঁড়িয়ে তাদের থেকে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার প্রবণতা বন্ধ করতে হবে। “কম লাভ, বেশি বিক্রি” ফর্মুলাতে ফিরে যেতে হবে। যে ব্যবসায়িক পদ্ধতিতে জনগণকে জিম্মি হতে হয় সেটি সৎ ব্যবসা হতে পারে না। এমন ব্যবসায় অর্জিত টাকা দিয়ে মসজিদ-মন্দির নির্মাণ করার কোন গুরুত্ব নেই। কারণ, সৎ ব্যবসা ইবাদতও বটে। বিশ্বনবি হযরত মুহাম্মদ (দ.) ব্যবসা করেছেন। সৎ ব্যবসায়ী হিসেবেও তিনি বিশ্ববাসীর নিকট আদর্শ হয়ে আছেন। ব্যবসার ক্ষেত্রে তাঁর আমানতদারিতা, নিষ্ঠা ও সততা দেখে হযরত খদিজা (র.) তাঁর প্রতি বিমুগ্ধ হয়েছিলেন। তাঁর ব্যবসায়িক নীতি হলো, দামবৃদ্ধির লক্ষ্যে পণ্য গুদামজাত করা যাবে না। তিনি বলেন, “যে ব্যক্তি গুদামজাত করল সে বড় অপরাধ করল” (মুসলিম, হাদিস নং-১৬০৫)। আরো বর্ণিত হয়েছে, “যে ব্যক্তি মূল্যবৃদ্ধির লক্ষ্যে চল্লিশ দিন পর্যন্ত পণ্য গুদামজাত করে রাখল সে আল্লাহর জিম্মা থেকে মুক্ত হয়ে গেল এবং আল্লাহও তার জিম্মা ছেড়ে দিয়েছেন। অর্থাৎ সে এমন পাপ করল, যে পাপের কারণে আল্লাহ তার ওপর অসন্তুষ্ট হয়েছেন।

আরেক হাদিসে বলা হয়েছে, “সে পণ্য যদি ছদকাও করে দেয় তবুও গোদামজাতের অপরাধের কাফ্ফারা বা বিনিময় হবে না” (মুসনাদ রযিন)। আল্লাহর নবি (দ.) সর্বপ্রকার প্রতারণামূলক ব্যবসাকে হারাম ঘোষণা করেছেন। সুদসহ জাহিলি যুগের প্রায় চল্লিশ প্রকারের ব্যবসাকে ইসলামি শরিয়ায় নিষিদ্ধ করা হয়েছে। কারণ, সেগুলোতে ক্রেতা-বিক্রেতার কোন না কোন পক্ষ প্রতারিত বা ক্ষতিগ্রস্ত হতো। এক পক্ষ হতো ‘আঙ্গুল ফুলে কলা গাছ’ হলেও অপর পক্ষ হয়ে যেতো সর্বশান্ত। মধ্যসত্ত্বভোগীদের দৌরাত্মাকে তিনি বন্ধ করে দিয়েছেন। কৃষক ও প্রান্তিক চাষী যেন ন্যায্য মূল্য পায় তার ব্যবস্থা করেছেন। হযরত আনাস র. বলেন, আল্লাহর নবি (দ.) শহুরে কর্তৃক গ্রামীন ব্যক্তির পণ্য ক্রয় করে তা মওজুদ রেখে পরবর্তী সময়ে বিক্রি করার ব্যবসাকে নিষিদ্ধ করেছেন (মুসলিম, হাদিস নং-১১৫৫)। এর ব্যাখ্যা হলো, গ্রামীণ ব্যক্তি যেন সরাসরি বাজারে পণ্য বিক্রি করে তার ন্যায্য মূল্য পায় এবং শহুরে ব্যক্তি তার থেকে ক্রয় পূর্বক গুদামজাত করে যেন পরবর্তীতে বেশি দামে বিক্রি করার সুযোগ না পায়। অর্থাৎ ক্রেতা-বিক্রেতা তথা ব্যবসায়ী ও ভোক্তা উভয়ের অধিকার যেন সুনিশ্চিত হয় এবং মধ্যসত্ত্বভোগী ও দালালের দৌরাত্ম থেকে মানুষ মুক্তি পায়। পণ্যের বেচা-কেনাও যেন সহজ হয়। মূল উদ্দেশ্য হলো, বেচা-বিক্রি সহজীকরণ এবং চড়া মূল্যে যেন পণ্য ক্রয় করতে না হয়- তা নিশ্চিতকরণ। সৎ ও ন্যায্য ব্যবসায়ীদের ব্যাপারে তিনি বলেন, “সৎ ও আমানতদার ব্যবসায়ী কিয়ামতের দিন নবি, ছিদ্দিক (অতি সত্যবাদী) এবং শহীদগণের সাথে থাকবে” (তিরমিজি, হাদিস নং-১২০৯)।

পবিত্র কুরআন-সুন্নাহর আলোকে সর্বোত্তম পেশা হলো চাষাবাদ, এরপর ব্যবসা এবং এরপর চাকুরী। পবিত্র কুরআনের ছাব্বিশটি আয়াতে চাষাবাদের কথা এসেছে। পবিত্র হাদিসের ভাষ্য অনুযায়ী কোন জমি চাষাবাদহীন রাখা যাবে না। হয়ত জমির মালিক চাষ করবে অথবা অন্যকে দিয়ে করাবে অথবা বর্গা দেবে অথবা কোন চাষীকে জায়গাটি দিয়ে দেবে। অর্থাৎ চাষাবাদের প্রতি উৎসাহিত করা হয়েছে এবং জমি অনাবাদি ফেলে রাখার ব্যাপারে অনুৎসাহিত করা হয়েছে। যেমন বলা হয়েছে, “যার জমি আছে সে যেন তাতে চাষ করে অথবা তার ভাইকে দিয়ে (অন্যকে দিয়ে) চাষ করাই। যদি নিজে করতে না পারে অথবা কাউকে দিয়ে করাইতে না পারে শুধু তখনই খিল রাখতে পারবে” (ছহিহ মুসলিম, হাদিস নং-১৫৩৬)।

ড. মুহাম্মদ নুর হোসাইন সহযোগী অধ্যাপক, আরবি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও খতিব, চবক জামে মসজিদ।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট