চট্টগ্রাম মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

অর্থনীতির মূল স্রােতধারায় নিয়ে আসতে হবে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার বস্তিজীবন

২৯ নভেম্বর, ২০১৯ | ২:১১ পূর্বাহ্ণ

বস্তি আধুনিক জীবনে নগর-মহানগরের ক্ষত হিসেবেই চিহ্নিত। এ যেন এক অমোঘ অভিশাপ। নগরসভ্যতায় সবচেয়ে অসহায়, লাঞ্ছিত-বঞ্চিত-শোষিত মানুষরাই বস্তিবাসী। ২০০০ খ্রিস্টাব্দে জাতিসংঘের মিলেনিয়াম সামিটের অঙ্গীকার ছিল বস্তিবিহীন নগরী সৃষ্টি। সে বার বিভিন্ন দেশের শীর্ষ প্রতিনিধিরা ২০২০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে বিশে^র অন্তত ১০ কোটি বস্তিবাসীর জীবনমান উন্নয়নে ঐকমত্য পোষণ করেছিলেন। কিন্তু দুঃখজনকভাবে ২০১৯ খ্রিস্টাব্দের শেষ পাদে এসেও সে সব প্রতিশ্রুতি পূরণের ছিটে ফোঁটা উদ্যোগও দৃষ্টিগোচর হচ্ছে না। এখনও বস্তিবাসীর জীবনমান নিয়ে সচেতন জনগোষ্ঠীর উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা এতটুকু কমেনি। শুধু তাই নয়, এখন ক্রমশ বস্তিবাসীর জীবনমান নি¤œমুখী হচ্ছে। এর সঙ্গে নদীভাঙন, দারিদ্র্যের করাল গ্রাস ইত্যাদি কারণে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে বস্তিবাসীর সংখ্যা। এ অবস্থা অব্যাহত থাকলে আগামীতে বস্তিসমস্যা ভয়াবহ রূপ ধারণ করবে সন্দেহ নেই।

আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের বিভিন্ন অনুসন্ধানী রিপোর্ট বলছে, তৃতীয় বিশে^র বেশ কয়েকটি দেশে বস্তিসমস্যা প্রকট আকার ধারণ করেছে। নানা কারণে এসব দেশে বস্তি ও বস্তিবাসীর সংখ্যা বেড়ে চলেছে। কিন্তু এ সমস্যা সমাধানে বিশ^সম্প্রদায়ের বলিষ্ঠ কোন উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না। গত কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশেও সমস্যাটি ব্যাপক রূপ পরিগ্রহ করেছে। রাজধানী ঢাকা ও বন্দরনগরী চট্টগ্রামে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বস্তিবাসী রয়েছে। চট্টগ্রামকে বাণিজ্যিক রাজধানী ঘোষণার পর বস্তিবাসীর জীবনমান উন্নয়নে ব্যাপক কর্মসূচি নেয়ার কথা বলা হলেও এখনও পর্যন্ত সে বিষয়ে তেমন কোনো তৎপরতা নেই। ঢাকা-চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন নগর-মহানগরে জনসংখ্যার চাপ কমাবার জন্যে বিভিন্ন স্থানে নাগরিকসুবিধা দিয়ে পুনর্বাসনের চেষ্টা বছরকয়েক আগে করা হলেও এখন সে চেষ্টায়ও ভাটা পড়েছে। কৃষি ব্যাংকের সহায়তায় ১৯৯৯ খ্রিস্টাব্দে শহরাঞ্চলে ‘ঘরে ফেরা’ কর্মসূচির মাধ্যমে বস্তিবাসীদের নিজ নিজ গ্রামে পুনর্বাসনের জন্যে ক্ষুদ্র ঋণ বিতরণ কর্মসূচিতে সাফল্য পেলেও পুনর্বাসন এবং জীবনমান উন্নয়নে এখনো পর্যন্ত কোন বলিষ্ঠ কর্মসূচি নেই।

উল্লেখ্য, কেউ স্বেচ্ছায় বস্তিবাসী হতে চায় না। যারা বস্তিবাসী হয়েছেন তাদের জীবনের পশ্চাতেই রয়েছে এক সাগর দুঃখের কাহিনী। তারা কেউ নদী ভাঙনের শিকার হয়ে নিঃস্ব অবস্থায় নগরীর বস্তিতে আশ্রয় নিয়েছে। কেউ দারিদ্র্যের চরম কষাঘাত থেকে বাঁচতে কাজের সন্ধানে শহরে এসে বস্তিতে আশ্রয় নিয়েছে। কেউ এসেছে স্বামী মারা যাওয়া বা স্বামী পরিত্যক্ত হওয়ার পরে। সবাই এসেছেন জীবন ও জীবিকার তাগিদে। তাদের ছোট ছোট ছেলে-মেয়েরা কায়িক পরিশ্রম করে থাকে। বস্তিবাসীরা সাধারণত নগরীর বাড়ি-ঘর, রাস্তা-ঘাট নির্মাণ, পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা, রিকশা চালনা, হকারি, সিকিউরিটি গার্ডের কাজ, গার্মেন্টস শ্রমিক, যানবাহনের হেলপার, ড্রাইভার হিসেবে নিযুক্ত থাকা এবং কুলিগিরিসহ নানা কায়িক পরিশ্রম করে কোনমতে বেঁচে থাকেন। কিন্তু দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতির এ দুঃসময়ে তাদের পক্ষে বেঁচে থাকাও এখন দুঃসাধ্য হয়ে পড়েছে। বেঁচে থাকার এই দুঃসহ সংগ্রামের সুযোগকে কাজে লাগিয়েছে সমাজের অশুভ চক্র। বস্তিবাসীদের অল্পবয়সী ছেলেদের দিয়ে তারা নানা অপকর্ম, যেমন মাদকব্যবসা ও সন্ত্রাসী কর্মকা-সহ বিভিন্ন সমাজবিরোধী কাজ করে থাকে।

এখন সাধারণের কাছে বস্তিএলাকা নানা সমাজবিরোধী কাজের আখড়া হিসেবে চিহ্নিত। এটি দুঃখজনক। একটি সমৃদ্ধ ও সুন্দর সমাজ বিনির্মাণের স্বার্থে বস্তিবাসীদের জীবনমান উন্নয়ন এবং তাদের পুনর্বাসন কর্মসূচি থাকা জরুরি। আমরা মনে করি, দেশের উন্নয়ন ও সমৃদ্ধিকে এগিয়ে নিতে বস্তিবাসীর জীবনমান উন্নয়ন এবং পুনর্বাসনে সময়োপযোগী পরিকল্পনা প্রণয়ন ও তার যথাযথ বাস্তবায়নে মনোযোগী হতে হবে সরকারকে। পাশাপাশি গ্রামীণ জনপদগুলোর দরিদ্র মানুষদের শহরমুখী স্রােতের উজানে বাঁধ দিতে প্রত্যন্ত জনপদে কর্মসংস্থান বৃদ্ধি করে গ্রামীণ অর্থনীতিকে মজবুত কাঠামোর উপর দাঁড় করাতে হবে। নদী ভাঙনে নিঃস্ব মানুষদেরও পুনর্বাসনপরিকল্পনা থাকতে হবে সরকারের। সর্বোপরি দারিদ্র্য নির্মূলে সরকারকে মনোযোগী হতে হবে। দারিদ্র্যকে পরাস্ত করতে পারলে বস্তি ও বস্তিবাসীর সমস্যা নিরসন সহজতর হবে।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট