চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

মূল্য বৃদ্ধির লক্ষ্যে খাদ্যশস্য মজুদ রাখা ইসলামে নিষিদ্ধ

মাহমুদ আহমদ

২১ নভেম্বর, ২০১৯ | ২:১৪ পূর্বাহ্ণ

ইসলামী আইনশাস্ত্রবিদদের মতে, ইসলামী পরিভাষায় মজুদদারি হচ্ছে, খাদ্যশস্য মজুদ করে কৃত্রিম অভাব সৃষ্টি করা। অত:পর মূল্য বৃদ্ধি পেলে তা বিক্রি করে প্রচুর পরিমাণে লাভবান হওয়া। ইসলাম মানবতাকে এমন এক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা প্রদান করে যা সব বৈষম্য ও অসমতা দূরীভূত করে দিয়ে ইনসাফভিত্তিক এক অনন্য সমতার সমাজ কায়েমের পথ নির্দেশ করে। এই অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় সমাজের কোন ব্যক্তির ন্যায্য অধিকার ক্ষুণœ করার এবং কারও স্বার্থ বিনষ্ট করার কোন রূপ সুযোগ নেই। এই অর্থনৈতিক মতাদর্শে পরিশ্রম করে সুখী সুন্দর জীবন গড়ার সুযোগ নিশ্চিত করে দেয়, যার ফলে মানবিক মূল্যবোধ সুদৃঢ় বুনিয়াদ লাভ করে। পারস্পরিক সম্পর্ক ও লেনদেনের মধ্যে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা বজায় রাখার স্বার্থে সামাজিক ও অর্থনৈতিক কর্মকা-ে ইসলাম নিয়ম-নীতি নির্ধারণ করে দিয়েছে। অর্থনৈতিক কর্মকা-ের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হচ্ছে ব্যবসায়-বাণিজ্য।

ইসলাম ব্যবসায়-বাণিজ্য উৎসাহিত করতে যেমন বিভিন্ন রকম জাগতিক ও পারলৌকিক প্রাপ্তির ঘোষণা দিয়েছে তদ্রুপ বিভিন্ন ধরনের নৈরাজ্যকর ও অবাঞ্ছনীয় পদক্ষেপ প্রতিরোধে জাগতিক এবং পারলৌকিক শাস্তিও ঘোষণা করেছে। পণ্যসামগ্রী জমা রেখে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে সমাজের দুর্ভোগ বৃদ্ধি ও অতি মুনাফা অর্জন করাকে দ-ণীয় কাজ হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে। সম্প্রতি আমরা লক্ষ্য করছি যে পেঁয়াজের মূল্য অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে, যা মানুষের ক্রয় সীমার উর্ধে। অধিক মুনফালোভীরা তাদের গুদামে নিত্যপ্রয়োজনীয় কিছু খাদ্য দ্রব্য অবৈধ, অনৈতিকভাবে মওজুদ করে বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি করছে। অনেক গুদাম থেকে বস্তার বস্তা পঁচা পেঁয়াজ নদীতে ফেলার চিত্রও মিডিয়াতে প্রচার হচ্ছে। যদিও এদের সংখ্যা কম কিন্তু বাজার ব্যবস্থাকে এই কমসংখ্যক লোকই নিয়ন্ত্রণ করছে।

ইসলামের দৃষ্টিতে ব্যবসা-বাণিজ্য অন্যতম সম্মানজনক কাজ এবং ব্যবসায়-বাণিজ্যকে ইসলাম সব সময় উৎসাহিত করে থাকে। কিন্তু খাদ্যসামগ্রী ও নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি আটকে রেখে কৃত্রিম সংকট তৈরীর মাধ্যমে অধিক মুনাফা অর্জনের মানসিকতাকে ইসলাম নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। দুনিয়া ও আখিরাতে মজুদদারির ভয়াবহ শাস্তির কথা কোরআনে বর্ণনা করা হয়েছে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘যারা সোনা রূপা (ধন-সম্পদ) জমা করে এবং আল্লাহর রাস্তায় খরচ করে না তাদের জন্য আপনি যন্ত্রণাদায়ক আযাবের সংবাদ দিন। সে দিন এসব ধন-সম্পদ আগুনে গরম করা হবে। অত:পর তা দিয়ে তাদের কপাল, পাঁজর আর পিঠে দাগ দেয়া হবে। (বলা হবে), তোমরা যা কিছু নিজেদের জন্য জমা করে রেখেছিলে এগুলো তো সেসব ধন-সম্পদ। সুতরাং তোমরা যা কিছু জমা করে রেখেছিলে, এখন তার স্বাদ আস্বাদন করো’ (সুরা আত তাওবা: ৩৪-৩৫)। অপর এক স্থানে মহান আল্লাহ বলেন, ‘যাতে ধন-সম্পদ শুধু বিত্তবানদের মধ্যে পুঞ্জীভূত না হয়’ (সুরা আল হাশর: ৭)। ধন-সম্পদ পুঞ্জীভূত করে রাখাকে অর্থনৈতিক অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। কেননা এতে ধন-সম্পদ বিকেন্দ্রীকরণ ও বণ্টন হওয়ার পরিবর্তে শ্রেণি ও সম্প্রদায়-বিশেষের মধ্যে কেন্দ্রীভূত হয়ে পড়ে আর সাধারণ মানুষ হয় নি:স্ব ও দরিদ্র। লেনদেনেও স্থবিরতা দেখা দেয় এবং উন্নয়ন বাধাগস্ত হয়। অনুরূপভাবে পণ্যসামগ্রী আটকে রাখার ফলেও একই রকম সমস্যা পরিলক্ষিত হয়। সুতরাং সম্পদ পুঞ্জীভূতকারী এবং পণ্য মজুদকারী সমান অপরাধী হিসেবে বিবেচিত হবে। আল্লাহতায়ালা তাদের জন্য যন্ত্রণাদায়ক শাস্তির প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।

নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যদ্রব্য ক্রয় করে অস্বাভাবিক ও অধিক মূল্যে বিক্রি করার জন্য গুদামজাত করে রাখাকে ইসলামের পরিভাষায় ‘ইহতিকার’ বা মজুদদারি বলা হয়। আল-হিদায়া প্রণেতার ভাষায় ‘ইহতিকার বা মজুদদারি হচ্ছে, খাদ্যসামগ্রী ক্রয় করে মূল্য বৃদ্ধির আশায় গুদামজাত করা।’ আল্লামা ইমাম ইবনে আবেদীন শামীর বলেন- ‘ইহতিকার হচ্ছে, খাদ্যসামগ্রী বা নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যসামগ্রী ক্রয় করে উচ্চমূল্যের জন্য চল্লিশদিন পর্যন্ত আটক রাখা’। অর্থাৎ যেসব জিনিস আটকিয়ে রাখলে বা মজুদ করলে সর্বসাধারণের সীমাহীন কষ্ট ও ক্ষতি হয়। নবী করিম (সা.) বলেছেন, ‘মজুদদার খুবই নিকৃষ্টতম ব্যক্তি; যদি জিনিসপত্রের দাম হ্রাস পায় তাহলে চিন্তিত হয়ে পড়ে, আর যদি মূল্য বেড়ে যায় তাহলে আনন্দিত হয়’ (মিশকাত)। মহানবী (সা.) আরো ঘোষণা করেছেন, ‘যে ব্যক্তি বাজারে পণ্যের অভাবের সময় পণ্য মজুদ করে রাখে সে বড় পাপী’ (মুসলিম)। পণ্যসামগ্রী মজুদ করে দাম বৃদ্ধি অথবা অধিক মুনাফা করাও ইসলামে নিষিদ্ধ। হাদিস শরিফে মজুদদারকে নিকৃষ্ট, অভিশপ্ত বলে অভিহিত করা হয়েছে।

মজুদদার সেই ব্যক্তি যে মানুষের প্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রী সংগ্রহ করে এর মূল্য বৃদ্ধি করার লক্ষ্যে গোপনীয় স্থানে আটক করে রাখে। ব্যবসায় এটা অত্যন্ত জঘন্য পাপ ও এক প্রকার শোষণ হিসেবে চিহ্নিত। অত্যধিক মুনাফা লাভের উদ্দেশ্যে সাধারণত মজুদদারির মাধ্যমে বাজারে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করা হয়। ইসলাম একে একটি অনৈতিক, ঘৃণ্য ও নিষিদ্ধ কাজ হিসেবে অভিহিত করে। পণ্যসামগ্রী মজুদ করার কারণে জনসাধারণের দুঃখ-দুর্দশা ও কষ্ট-দুর্ভোগ বেড়ে যায়, অস্বাভাবিক হারে জিনিসপত্রের মূল্য বৃদ্ধি পায় এবং মাত্রাতিরিক্ত মুনাফা লাভের সুযোগ ঘটে। এজন্য মজুদদার ও অধিক মুনাফাখোর ব্যবসায়ীদের সম্পর্কে হাদিসে সতর্কবাণী উচ্চারণ করে এদেরকে পাপী হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘পণ্যদ্রব্য আটক করে অধিক মূল্যে বিক্রয়কারী অবশ্যই পাপী’ (মিশকাত)।

ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হজরত উমর (রা.) ব্যবসায়ীদের পণ্য মজুদকরণ সম্পর্কে ঘোষণা করেছিলেন, “আমাদের বাজারে কেউ যেন পণ্য মজুদ করে না রাখে। যাদের হাতে অতিরিক্ত অর্থ আছে তারা যেন বহিরাগত ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে সমস্ত খাদ্যশস্য কিনে তা মজুদ করে না রাখে। যে ব্যক্তি শীত-গ্রীষ্মের কষ্ট সহ্য করে আমাদের দেশে খাদ্যশস্য নিয়ে আসে সে উমরের মেহমান। অতএব সে তার আমদানীর খাদ্যশস্য যে পরিমাণে ইচ্ছা বিক্রি করতে পারবে, আর যে পরিমাণে ইচ্ছা রেখে দিতে পারবে” (মুয়াত্তা ইমাম মালিক)। ইমাম গাজ্জালির (রহ.) মতে, মজুদদারি হারাম। তিনি এর কারণ উল্লেখ করে বলেন, এতে আল্লাহর বান্দাদের কষ্ট ও অনিষ্ট সাধিত হয়ে থাকে। কোনো ব্যক্তি সব শস্য ক্রয়পূর্বক আটক করে রাখলে অবশিষ্ট সবাই এ থেকে বঞ্চিত থাকবে। এ উদ্দেশ্যে খাদ্যশস্য খরিদ ও মজুদ করে রাখা পাপ।

মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘আমদানিকারক রিজিকপ্রাপ্ত হয়, আর মজুদদার হয় অভিশপ্ত।’ আরো বলা হয়েছে, ‘বিভ্রান্ত লোকই শুধু মজুদদারী করে’ (ইবনে মাজা)। নবী করিম (সা.) মজুদদারকে কঠোর শাস্তি প্রদানের কথা ঘোষণা করেছেন, ‘যে মুসলিম সম্প্রদায়ের খাদ্যদ্রব্য চল্লিশ দিন যাবত মজুদ করে রাখবে আল্লাহ তাকে দূরারোগ্য ব্যাধি ও দারিদ্র্য দিয়ে শাস্তি দিবেন’ (ইবনে মাজা)।

মুনাফালোভী অসৎ ব্যবসায়ী মজুদদারদের সঙ্গে আল্লাহর কোনো সম্পর্ক নেই। মহানবী (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘যে ব্যক্তি চল্লিশ রাত পর্যন্ত খাদ্যদ্রব্য মজুদ করবে তার সঙ্গে আল্লাহর কোনো সম্পর্ক থাকবে না।’ নবীজি আরো বলেছেন, ‘মূল্যবৃদ্ধির উদ্দেশ্যে যে ব্যক্তি চল্লিশ দিন পর্যন্ত খাদ্যশস্য মজুদ রাখে, সে ব্যক্তি আল্লাহর দায়িত্ব থেকে মুক্ত এবং আল্লাহ তার প্রতি অসন্তুষ্ট’ (মিশকাত)। তাই দ্রব্যমূল্য মজুদ রেখে কৃত্রিম চাহিদা তৈরী করে দাম বাড়িয়ে দেয়া অত্যন্ত গোনাহের কাজ। এই পাপ কাজ করা থেকে আমাদের বিরত থাকতে হবে।

আমি যদি ব্যবসায়ী হই তাহলে আমাকে খেয়াল রাখতে হবে আমার দ্বারা যেন কোন ধরনের অবৈধ কাজ সংঘটিত না হয়। এছাড়া আমি যে কাজই করি

না কেন আমার দ্বারা যেন কারো কোন ক্ষতি না হয় সে খেয়ালও রাখতে হবে। মহান আল্লাহতায়ালা আমাদের সকলকে প্রকৃত ইসলামের শিক্ষানুসারে জীবন পরিচালার তৌফিক দান করুন, আমিন।

মাহমুদ আহমদ ইসলামী গবেষক ও কলাম লেখক

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট