চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

দেশে পেঁয়াজের দাম বৃদ্ধি এবং অর্থনীতির তত্ত্ব

প্রফেসর ড. নারায়ণ বৈদ্য

২০ নভেম্বর, ২০১৯ | ২:১৬ পূর্বাহ্ণ

অর্থনীতির জনক বলা হয় এডাম স্মিথ (অউঅগ ঝগওঞঐ)-কে। তিনি ১৭২৩ সালে যুক্তরাজ্যে জন্মগ্রহণ করেন। মাত্র চৌদ্দ বছর বয়সে তিনি গ্লাসগো বিশ^বিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষা লাভের জন্য পড়াশুনা আরম্ভ করেন। তিনি গ্রীক ভাষা, ল্যাটিন ভাষা, গণিতশাস্ত্র ও দর্শন বিষয়ে অধ্যয়ন করেন।

গ্লাসগো ও অক্সফোর্ডে লেখাপড়া শেষ করে তিনি প্রথমে ধর্মযাজক হতে স্থির করেন। পরবর্তীতে মত পরিবর্তন করে এডিনবরায় ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপক পদ গ্রহণ করেন। এরপর তিনি গ্লাসগো বিশ^বিদ্যালয়ে তর্কশাস্ত্রের অধ্যাপক পদে যোগ দেন। পরবর্তী বছর তিনি দর্শন শাস্ত্রের অধ্যাপক হন। এ সময়ে তিনি দর্শন শাস্ত্রের ওপর একটি গ্রন্থ রচনা করেন। উক্ত গ্রন্থ রচনা করে তিনি প্রচুর সুখ্যাতিও অর্জন করেন। দর্শনশাস্ত্রের অধ্যাপনা করতে করতে তিনি অর্থনীতি বিষয়ে মনোযোগী হন। এ সময়ে এডাম স্মিথ এক তরুণ ডিউকের ভ্রমণকালীন শিক্ষক হিসেবে নতুন চাকুরী পান। এ চাকুরী গ্রহণ করে তিনি প্রচুর অর্থ আয় করেন। ১৭৬৪ সালে তিনি একটি গ্রন্থ লিখতে শুরু করেন। তাঁর এই গ্রন্থটি অর্থনীতি বিষয়ের ওপর প্রথম রচনা, যা তাকে অর্থনীতির জনকের আসনে অধিষ্ঠিত করে। উক্ত গ্রন্থটিতে তিনি আলোকপাত করেন, কিভাবে যাবতীয় শিল্প প্রচেষ্টাকে সাফল্যমন্ডিত করে জাতিকে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে নেয়া যায়।

এ কারণে তিনি গ্রন্থটির নাম দিয়েছিলেন, “অঘ ঊঘছটওজণ ওঘ ঞঙ ঞঐঊ ঘঅঞটজঊ অঘউ ঈঅটঝঊঝ ঙঋ ডঊঅখঞঐ ঙঋ ঘঅঞওঙঘঝ.” যদিও গ্রন্থটিকে সংক্ষেপে ‘ডঊঅখঞঐ ঙঋ ঘঅঞওঙঘঝ’ বলে। ১৭৬৪ সালে ঐ গ্রন্থটি লিখতে আরম্ভ করলেও অবসর জীবনে তিনি গ্রন্থটির লেখা সমাপ্ত করেন। উদার অর্থনৈতিক মতবাদে সমৃদ্ধ গ্রন্থখানি প্রকাশিত হয় ১৭৭৬ সালে।
এডাম স্মিথের অর্থনীতির তত্ত্ব অনুসারে প্রত্যেক পণ্যের বাজার দর ও স্বাভাবিক দর বলে দুটো কথা আছে। যে কোন পণ্য উৎপাদন ক্ষেত্রে দেখা যায়, শুধুমাত্র শ্রম দ্বারা উৎপাদন করা সম্ভব নয়। এমন কি একজন তাঁতি তাঁত বুনতে গেলে সুতা, রং, যন্ত্র প্রভৃতির প্রয়োজন হয়। এগুলো হলো উৎপাদন খরচ। এ উৎপাদন খরচ বা ঈড়ংঃ ড়ভ চৎড়ফঁপঃরড়হ -এর কথা বিবেচনা করেই এডাম স্মিথ উৎপাদন খরচকে স্বাভাবিক দর (ঘধঃঁৎধষ চৎরপব) বলেছেন। স্বাভাবিক দরের মধ্যে ধরা হয় মজুরী খরচ, কাঁচামালের খরচ, যন্ত্রপাতির ব্যয়, জমির খাজনা ও পুঁজির প্রাপ্তি। এসব খরচের ওপরে আছে মুনাফা। খরচ অপেক্ষা মূল্য বেশি হলে মুনাফার উৎপত্তি হয়। আর কম হলে লোকসান হয়। আবার বাজার দর নির্ধারিত হয় চাহিদা ও জোগানের ওপর ভিত্তি করে। তবে চাহিদা বাজার দরের ওপর বেশি প্রভাব বিস্তার করে। বাজার দর যা-ই থাকুক না কেন, তা সর্বদায় স্বাভাবিক দরের দিকে ফিরে যাবার প্রবণতা থাকে। একটি উদাহরণ দিলে বিষয়টি স্পষ্ট হয়।

একটি দোলক যখন স্থিতি অবস্থায় আসে তখন তাকে বলা হয় ভারসাম্য বা ঊয়ঁরষরনৎরঁস. বাজার দরও তেমনি উঠানামা করতে করতে এরূপ অবস্থার দিকে আকৃষ্ট হয়। শেষে এরূপ অবস্থায় পৌছার পর যে দর ঠিক হয় তাহাই স্বাভাবিক দর। অতএব স্বাভাবিক দর ও বাজার দরের মধ্যে পার্থক্য থাকার কথা নয়। অনেক কারণে বাজার দর স্বাভাবিক দরের দিকে এগিয়ে যায়। যে সমস্ত কারণে বাজার দর স্বাভাবিক দরের ওপরে থাকে সেগুলো হল- জনসাধারণের উচ্চ মুনাফা সম্পর্কে অজ্ঞতা, উপযুক্ত জমির স্বল্পতা এবং একচেটিয়া বাজার।
কিন্তু বাজার দর কিভাবে নির্ধারিত হয়? এডাম স্মিথ তাঁর গ্রন্থে বাজার দর সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে চাহিদা ও জোগান সম্পর্কে আলোচনা করেন। যদিও তিনি চাহিদা সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেননি, তবুও জোগান সম্পর্কে তিনি বিস্তারিত আলোচনা করেন। অবশেষে বাজার দর সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে চাহিদা ও জোগানের সমতার কথা উল্লেখ করেন। অর্থাৎ চাহিদা ও জোগানের সমতায় বাজার দর নির্ধারিত হয়। এরূপ বাজার দর নির্ধারণ হওয়াই হল অদৃশ্য হস্ত। নিও-ক্লাসিক্যাল অর্থনীতিবিদরা এটাকে মার্কেট মেকানিজমও বলেছেন। অর্থাৎ অদৃশ্য হস্ত বা মার্কেট মেকানিজমের ভেতর দিয়ে যে কোন পণ্যের দাম নির্ধারিত হয়। এরূপ দাম নির্ধারণ হওয়াকে বাজার দর বলে। বাজার দর ও স্বাভাবিক দরের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। বিভিন্ন কারণে বাজার দর স্বাভাবিক দরের তুলনায় ওপরে থাকতে পারে। বিশেষ করে ক্রেতাসাধারণের অজ্ঞতা বা দাম সম্পর্কে ধারণা না থাকা, জমি তথা উৎপাদনের স্বল্পতা এবং পণ্য উৎপাদন বা ব্যবসায়ের ক্ষেত্রে একচেটিয়া কারবারের উদ্ভব। বাজার দর ও স্বাভাবিক দরের মধ্যে পার্থক্য দীর্ঘদিন বজায় থাকতে পারে। কারণ একচেটিয়া কারবারী তথা একচেটিয়া ব্যবসায়ীদের উচ্চ মুনাফার কথা দীর্ঘদিন গোপন থাকতে পারে। কোন কারণে বাজার দর যদি স্বাভাবিক দর হতে কম হয় তাহলে উৎপাদনকারী উৎপাদন কমিয়ে দেবে। এতে পণ্যমূল্য বৃদ্ধি পাবে। অতএব বাজার দর ও স্বাভাবিক দর আবার সমতায় আসবে। অর্থাৎ উৎপাদন ক্ষেত্রে যদি পূর্ণ স্বাধীনতা বিদ্যমান থাকে, তবে বাজার দর ও স্বাভাবিক দর সমতায় আসবে। সুতরাং বলা যায়, অদৃশ্য হস্তের ভেতর দিয়ে বাজার দর ও স্বাভাবিক দর পরস্পর সমান হয়।

কিন্তু বাংলাদেশের অর্থনীতিতে পেঁয়াজের দাম বা বাজার দর এত বেশি কেন? কেনইবা ব্যবসায়ীরা (এরা উৎপাদন নয় বরং আমদানীকারী) এত বেশি দাম নিচ্ছে। তাঁদের আমদানি ব্যয় কি এত বেশি? সরকারের কি করণীয় আছে?
বাণিজ্যমন্ত্রী মহোদয় ঘোষণা করেছেন যে, ‘আপাততঃ পেঁয়াজ একশত টাকার কম নয়। কেনইবা তিনি সেই ঘোষণা দিলেন? এডাম স্মিথের অর্থনীতির তত্ত্ব অনুসারে এর উত্তর খুবই সোজা। বাংলাদেশে উৎপাদিত সব পেঁয়াজ প্রায় নিঃশেষ হয়ে যায় প্রতি বছর মে মাসের মধ্যে। আবার বাংলাদেশে উৎপাদিত পেঁয়াজ বাজারে আসে প্রতি বছর ডিসেম্বরের শেষে। অতএব প্রতি বছর জুন মাস থেকে ডিসেম্বর- এ সাত মাস বাংলাদেশের জনগণের রসনা পরিতৃপ্ত করতে হয় বিদেশি পেঁয়াজ দিয়ে। যারা বা যে সব ব্যবসায়ী বিদেশ থেকে পেঁয়াজ আমদানি করে তারা মোটেই উৎপাদক নয়। বরং তারা ফটকা ব্যবসায়ী। এসব ব্যবসায়ীদের প্রধান উদ্দেশ্য থাকে মুনাফা। আবার যারা পেঁয়াজ আমদানির জন্য এলসি খুলে তারা পেঁয়াজ আমদানির সাথে সাথে বা তার পূর্বেই মালামাল বিক্রয় করে দেয় অন্য ব্যবসায়ীদের নিকট। এ সুযোগে আমদানিকৃত মালামাল যদি একজন বা দুইজন বা স্বল্পসংখ্যক ব্যবসায়ী কিনে নেয় তবে তারা হয়ে উঠে একচেটিয়া কারবারী বা অলিগোপলি ব্যবসায়ী। সুতরাং এডাম স্মিথের তত্ত্ব অনুসারে একচেটিয়া কারবারী উচ্চ মুনাফার কথা দীর্ঘদিন গোপন রাখতে পারে। কাজেই এ স্বল্পসংখ্যক অলিগোপলি কারবারী সেই উচ্চ মুনাফাকে আহরণ করার জন্য পেঁয়াজের দামকে বাড়িয়ে দেয়। তাই আজ পেঁয়াজের দাম প্রতি কেজি দুইশত ত্রিশ টাকা থেকে দুইশত পঞ্চাশ টাকা। এমন কি আরো তা বাড়তে পারে।

কিন্তু এডাম স্মিথের তত্ত্ব অনুসারে বাজার দর ও স্বাভাবিক দর সমান হচ্ছে না কেন? বাংলাদেশের অর্থনীতিতে পেঁয়াজের বাজার দর ও স্বাভাবিক দর কখনো সমান হবে না। কারণ উৎপাদন খরচ থেকে পাওয়া যায় স্বাভাবিক দর। আর বাজারের চাহিদা ও জোগান থেকে পাওয়া যায় বাজার দর। যেহেতু বাংলাদেশের উৎপাদিত পেঁয়াজ এখন বাজারে নেই এবং সবটুকু পেঁয়াজ আমদানি করতে হয় সেহেতু স্বাভাবিক দর সম্পর্কে জানা যাবে না।
আর বাজার দর নির্ভর করে পেঁয়াজের চাহিদা ও জোগানের ওপর। চাহিদা রয়েছে সমগ্র বাংলাদেশ জুড়ে। আর জোগান দিচ্ছে স্বল্পসংখ্যক আমদানিকারক। সুতরাং পেঁয়াজের দর তারাই নিয়ন্ত্রণ করছে। অতএব বলা যায়, আগামী মাসে বাংলাদেশে উৎপাদিত নতুন পেঁয়াজ না আসা পর্যন্ত এদেশের বাজারে পেঁয়াজের দাম কমবে না। বরং বাড়বে। কাজেই চাহিদা হ্রাস করাই উত্তম।

প্রফেসর ড. নারায়ণ বৈদ্য পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক, বিজিসি ট্রাস্ট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট