চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ২৮ মার্চ, ২০২৪

সর্বশেষ:

ছাত্ররাজনীতির একাল-সেকাল

অধ্যাপক রতন কুমার তুরী

১৯ নভেম্বর, ২০১৯ | ২:২৮ পূর্বাহ্ণ

১৯৫২ থেকে ১৯৭১ এই সুদীর্ঘ পথপরিক্রমায় এদেশের ছাত্ররাই ছিল বিভিন্ন আন্দালন-সংগ্রামের নিয়ামক শক্তি। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে ছাত্রদের অংশগ্রহণের ফলেই এদেশের মানুষ আজ তাদের নিজ ভাষায় কথা বলতে পারছে। ১৯৬৯-এর গণআন্দোলনে ছাত্ররা অংশগ্রহণ করেছিল বলেই বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল। অবশেষে বাঙালির মুক্তি আন্দোলনে ছাত্রদের ব্যাপক উপস্থিতি এবং রাজপথে সাহসী মিছিল মুক্তির সংগ্রামকে বেগবান করেছিল। পরবর্তীতে ১৯৯০ সালের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনেও ছাত্রসমাজের অগ্রণী ভূমিকা ছিল। ৯০-এর দশকের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে বলা যায় ছাত্রদের ব্যাপক অংশগ্রহণই স্বৈরাচার এরশাদের গদি টলেছিল। বাংলাদেশের ছাত্ররাজনীতি নিয়ে অনেক গৌরবগাঁথা ইতিহাস আছে। যেসব ইতিহাস চাইলেও কেউ উড়িয়ে দিতে পারবেনা। বাংলাদেশ ছাত্রলীগ নামের এই ছাত্র-সংগঠনটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এদেশের অবিসংবাদিত নেতা জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের হাত ধরে। বঙ্গবন্ধুর আদর্শ এই সংগঠনটির প্রতিটি পরতে পরতে লেগে আছে। আর ছাত্রলীগ রাজনীতি করে অনেকেই আজ প্রতিষ্ঠিত এমনকি আজকের দেশের প্রধানমন্ত্রীও এক সময় ছাত্রলীগের রাজনীতির সাথে যুক্ত ছিলেন। এমন একটি ছাত্র সংগঠন কিছু ছাত্রের জন্যে দুর্নামের ভাগিদার হবে, তা হতে পারেনা। প্রকৃতপক্ষে এদেশে ছাত্ররাজনীতিতে লেজুরভিত্তিক নেতাদের আগমন ঘটে ৭৫-এর পট পরিবর্তনের মাধ্যমে। সেসময় কিছু রাজনৈতিক দল ছাত্রদের কলমের পরিবর্তে হাতে অস্ত্র তুলে দেয় এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে হল দখল করে ভিন্ন মতাবলম্বী ছাত্র-ছাত্রীদের দাবিয়ে রাখার পথ অবলম্বন করে। সে ধারা আজও অব্যাহত রয়েছে।

ছাত্রদের এমন আচরণের জন্য ছাত্ররাজনীতি বন্ধ করে দিলেই কি এ সমস্যার সমাধান হবে? নাকি প্রতিটি রাজনৈতিক দল তাদের ছাত্র সংগঠনকে নিবিড় তত্ত্বাবধানে রাখলে এ সমস্যা কেটে ওঠা যাবে। প্রকৃতপক্ষে ছাত্ররাজনীতি বন্ধ করে দিলে দেশে ভালো নেতৃত্ব কখনই গড়ে উঠবেনা। এর ফলে দেশে নেতৃত্বের সংকট দেখা দেবে। যেহেতু দেশ পরিচালনায় ভালো নেতৃত্বের দরকার রয়েছে সেহেতু ছাত্ররাজনীতি বন্ধ করার কথা কোনো রাজনৈতিক দলই ভাববেনা। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্ররাজনীতি করতে হলে কিছু নিয়মনীতি বেঁধে দেয়া উচিত, যেমন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহে সকল রাজনৈতিক দলসমূহের ছাত্র সংগঠনের সহ-অবস্থান নিশ্চিত করা। ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে সহমর্মিতা বাড়ানোর জন্য প্রশাসনিক ভাবে বিভিন্ন সভা-সেমিনার অনুষ্ঠান করা। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহে রেগিং চিরতরে নিষিদ্ধ করা। যেকোনো হলে প্রভোস্টদের রাত্রিকালিন অবস্থান বাধ্যতামূলক করা। যেকোনো ঘটনা ঘটলে তার সমাধান কল্পে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করা। এ বিষযে বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের ভিসিদের সর্বাত্মক ক্ষমতা দেয়া। যেকোনো অন্যায় কর্মকা-কে কোনো রাজনৈতিক দল সমর্থন না দেয়া ইত্যাদি। প্রকৃতপক্ষে স্বাধীনতা পূর্ববর্তী এদেশে ছাত্ররা রাজনীতি করতো তাদের নীতি-নৈতিকতা ঠিক রেখে এবং দেখা গেছে সবচেয়ে ভালো ছাত্র-ছাত্রীরাই রাজনীতিতে যোগ দিতো। তারা বিভিন্নভাবে ছাত্র-ছাত্রীদের অধিকার আদায় করে নিতো এবং জাতির দুর্দিনে তাদের পাশে থাকতো।

এখন রাজনীতিতে মেধাবিরা এগিয়ে আসেনা তাদের রাজনীতি বিমুখতার কারণ হলো শিক্ষাঙ্গনসমূহে পরিশুদ্ধ এবং পরিশীলিত রাজনীতির অভাব রয়েছে। শিক্ষাঙ্গনসমূহে অনেক আগে থেকেই এই হল দখলের রাজনীতি ছিল এবং বিরুদ্ধ মতকে দাবিয়ে রাখার নিয়ম ছিল। সেটা থেকে বের হতে হলে রাজনৈতিক দলসমূহের সৎ ইচ্ছার বড় বেশি প্রয়োজন রয়েছে তারা যদি তাদের ছাত্র সংগঠন গুলোকে অন্যায় কাজে উৎসাহ না দেয় তাহলে ছাত্ররাজনীতি আরো পরিশুদ্ধ হবে। আমরা ছাত্ররাজনীতি চিরতরে বন্ধ হোক, এটা কখনও কামনা করিনা। আশার কথা, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ছাত্ররাজনীতি পরিশুদ্ধ করতে মাঠে নেমেছেন। এ বিষয়ে তিনি বিভিন্ন দিক-নির্দেশনা দিচ্ছেন। আশা করা যায়, এর ফল আসবে। আমরা চাই ছাত্রদের মধ্যে একটি পরিশুদ্ধ রাজনৈতিক ধারা। যে রাজনীতিতে থাকবেনা কোনো হিংসা বিদ্বেষ, ঘৃণা। যে রাজনীতিতে থাকবেনা কোনো হত্যার মতো নির্মম ঘটনা। ছাত্ররাজনীতি এগিয়ে যাবে, ছাত্র-ছাত্রী এবং দেশের মানুষের কল্যাণে – এমন প্রত্যাশা সকলের।

অধ্যাপক রতন কুমার তুরী
কলেজ শিক্ষক, প্রাবন্ধিক, মানবধিকার কর্মী

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট