চট্টগ্রাম শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

জননেতা মঈন উদ্দিন খান বাদল

মুসলেহ্উদ্দিন মুহম্মদ বদরুল

১৮ নভেম্বর, ২০১৯ | ২:২৫ পূর্বাহ্ণ

রাজনৈতিক মতাদর্শ ভিন্ন হলেও ব্যক্তি ও রাজনীতিবিদ মঈন উদ্দিন খান বাদল আমার পছন্দের তালিকার একজন মানুষ। বাংলাদেশে যে ক’জন তুখোড় পার্লামেন্টারিয়ান এর আমরা নাম শুনি বাদল ভাই তাঁদের মধ্যে অন্যতম। তিনি যে দশের নেতা ছিলেন দলটি দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে ক্ষুদ্র হলেও নেতা হিসাবে মঈন উদ্দিন খান বাদল ছিলেন জাতীয় পর্যায়ের নেতা। যুক্তিতর্ক ও বাগ্মীতায় তাঁর জুড়ি নেই। জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর মত ভরাট কণ্ঠ ছিল তাঁর। টকশোতে, সেমিনারে, জনসভায়, সংসদে তাঁর আলোচনা ছিল শাণিত, যুক্তি নির্ভর ও শ্রুতিমধুর। আমার মনে হয়, জননেত্রী শেখ হাসিনা বাদল ভাইকে এই সকল অনন্য সাধারণগুণের জন্যই পর পর তিন বার মহাজোট থেকে বোয়ালখালী-চান্দগাঁও (আংশিক) আসনে মনোনয়ন দিয়েছিলেন। যদিও, দলের তৃণমূল কর্মীদের দাবী ছিল নিজ দল থেকে প্রার্থী দেয়ার জন্য।

মঈন উদ্দিন খান বাদল ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রামের বোয়ালখালী উপজেলার সারোয়াতলী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা মরহুম আহমদ উল্লাহ খান ছিলেন পুলিশের একজন উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা ও মা যতুমা খাতুন ছিলেন সুনিপুণা গৃহীনি। বাদল ভাই ৬০ এর দশকে ছাত্রলীগের সাথে যুক্ত ছিলেন। ১৯৭১ সালে ভারতে প্রশিক্ষণ নেন এবং মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। চট্টগ্রাম বন্দরে অস্ত্র বোঝাই জাহাজ সোয়াত থেকে অস্ত্র খালাস প্রতিরোধের অন্যতম নেতৃত্বদাতা তিনি। মুক্তিযুদ্ধের পর জাসদ হয়ে বাসদ ও পরে আবারো জাসদে যোগ দেন। ১২ মার্চ ২০১৬ সালে জাতীয় কাউন্সিলে জাসদ আবার দুই ভাগ হয়। এর এক অংশের কার্যকরী সভাপতির দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন মঈন উদ্দিন খান বাদল । ১৪ দল গঠনেও তাঁর ভূমিকা ছিল। ২০০৮ সালের নবম জাতীয় সংসদে তিনি আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোটের প্রার্থী হয়ে চট্টগ্রাম-৮ আসন থেকে সাংসদ নির্বাচিত হন। এরপর ২০১৪ সালের দশম ও ২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদে একই জোট থেকে তিনি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। রাজনীতি করার জন্য পড়ালেখা প্রয়োজন। পড়ালেখা ছাড়া আজকাল রাজনীতি অনেকেই করেন। কিন্তু, সত্যিকার অর্থে তাঁরা রাজনীতিবিদ নন।

সম্প্রতি কোন একটি বিশ^ বিদ্যালয়ের সমাবর্তনে মহামান্য রাষ্ট্রপতির ভাষণের কথা মনে পড়ে। সরকারি আমলা, কূটনীতিক, বিচারক, সেনা কর্মকর্তা সকলেই অবসরপ্রাপ্ত হয়ে রাজনীতিতে ঢুকে পড়েন। অবশ্য, ওনারা উচ্চ শিক্ষিত লোক। তবে, কথা হচ্ছে পড়ালেখার সাথে সাথে রাজনীতির যে পাঠ ছাত্র জীবন থেকেই শিখতে হয় তা তাঁরা রপ্ত করেন নি। ফলে, অবসর জীবনে তাঁদের রাজনীতির মুখ্য উদ্দেশ্যই হচ্ছে রাজনৈতিক দলে যোগ দিয়ে এমপি হওয়া, মন্ত্রী হওয়া। ‘জননেতা’ তাঁরা কখনোই হতে পারেন না। আরও দুঃখের বিষয়, আজকাল রাজনীতি পুঁজি বিহীন সবচেয়ে সহজলভ্য হওয়ার কারণে যে কেউ রাজনীতিতে অভিষিক্ত হতে কোন বাধা নেই।

আগেকার দিনে মেধাবী ছাত্ররাই ছাত্র রাজনীতির সাথে যুক্ত ছিলেন। আমার জানা মতে, ছাত্র নেতা হিসাবে যাঁদেরকে দেখেছি, তোফায়েল আহমদ, মতিয়া চৌধুরী, কাজী জাফর আহমদ, রাশেদ খান মেনন, নুরে আলম সিদ্দিকী, আ.স.ম আবদুর রব, শাহজাহান সিরাজ, আবদুল কুদ্দুস মাখন, মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, ওবায়দুল কাদের তাঁরা প্রত্যেকেই ঢাকা ভার্সিটির মেধাবী ছাত্র ছিলেন।
বীর মুক্তিযোদ্ধা মঈন উদ্দিন খান বাদলও ছিলেন ঢাকা ভার্সিটির একজন মেধাবী ছাত্র। মেধাবী ছাত্র ছিলেন বলেই ছাত্র রাজনীতি থেকে উঠে আসা বাদল ভাই, রাজনীতিতে সফলতা অর্জন করেছেন। আমরা দেখেছি, পার্লামেন্টে তাঁর বক্তৃতা শোনার জন্য স্পীকারসহ সরকারি ও বিরোধী দলীয় সাংসদদের গভীর আগ্রহ। তিনি আজীবন স্বৈরাচার, সাম্প্রদায়িকতা, মৌলবাদ ও জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে একটি সোচ্চার কণ্ঠ ছিলেন। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে মঈন উদ্দিন খান বাদলের ভূমিকা কিছুটা বিতর্কিত ছিল বটে তবে এর জন্য তিনি নিজের ভুল স্বীকার করে জাতির কাছে ক্ষমাও চেয়েছেন। আসলে, দোষেগুণেই তো মানুষ। ভুল স্বীকার করাও একটি মহৎ গুণ।

আমি অগ্রজতুল্য প্রিয় সাংবাদিক নাসিরুউদ্দিন চৌধুরীর ফেসবুক স্টাটাস থেকে কোড করতে চাই,
“স্বর্গে গেলেও মনে হয় বাদল ভাইয়ের আত্মা শান্তি পাবে না, কারণ, তাঁর একটি স্বপ্ন অপূর্ণ রয়ে গেলো। তিনি চেয়েছিলেন, কর্ণুফুলী নদীর উপর দিয়ে বোয়াখালী রেল-কাম সড়ক সেতু নির্মাণ করতে। এ সেতু নির্মাণের জন্য তিনি পার্লামেন্টে যেমন সরব ছিলেন, তেমনি মাঠে-ময়দানে বহু আন্দোলন-সংগ্রাম ও মিছিল করেছেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তাঁকে আশ^াস দিয়েছিলেন বলেও শুনেছি। তাঁর মৃত্যুর পর হয়তো তিনি বাদল ভাইয়ের আত্মার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে কর্ণফুলীর উপর বোয়ালখালী সেতুটা করে দেবেন।”

বাদল ভাইয়ের মৃত্যুতে গত ৮ নভেম্বর চট্টগ্রামের প্রচারবহুল দৈনিক পূর্বকোণের শিরোনাম ছিল, ‘চট্টলপ্রেমী বাদল আর নেই।’ বোয়ালখালী থেকে প্রতিবেদক সেকান্দর আলম প্রদত্ত পূর্বকোণের প্রতিবেদনে ছিল, ‘আর শোনা যাবে না ক্ষুরধার বক্তব্য, ইতিহাসের পরতে পরতে বিচরণ করে আহরিত রসটুকু আর মানুষের মাঝে বিলীন হবে না এমন ভাবে। সংসদে বক্তব্য শোনার জন্য টিভি সেট অন করা হবে না, সব কিছুকে পেছনে ফেলে চলে গেলেন তিনি। তাঁর চলে যাওয়াটার স্বাভাবিক কারণ তিনি অভিমান করেছেন, বড্ড অভিমান। নিজ এলাকার মানুষের দুর্ভোগ লাঘবে একটা কালুরঘাট সেতুর দাবি নিয়ে এমনিতেই তিনি জনগণের কাতারে চলে এসেছেন বারে বারে। ভাগ্যের নির্মম নিয়তি, স্বল্প দেখিয়ে কালুরঘাট সেতুটা তিনি নির্মাণ করে যেতে পারেন নি। পূর্বকোণের প্রতিবেদন ও শ্রদ্ধেয় সাংবাদিক নাসিরুদ্দিন চৌধুরীর সাথে আমি আর একটু যোগ করব, বীর মুক্তিযোদ্ধা, জননেতা মঈন উদ্দিন খান বাদল এমপি ঘোষণা দিয়েছিলেন, ডিসেম্বর ২০১৯ এর মধ্যে কালুরঘাট সেতুর কার্যক্রম দৃশ্যমান না হলে তিনি সংসদ থেকে পদত্যাগ করবেন। অত্যন্ত দুঃখের বিষয়, পদত্যাগ করার আগেই এক বকু ভরা ব্যথা নিয়ে তিনি দুনিয়া থেকে চির বিদায় নিয়েছেন। নিজ সংসদীয় এলাকার মানুষের স্বার্থে এমন ঘোষণা সত্যিই নজরবিহীন।

জাতির শ্রেষ্ট সন্তান, চট্টলপ্রেমী এই বীর মুক্তিযোদ্ধার অপূর্ণ ইচ্ছাকে সম্মান জানানোর জন্য ভবিষতে নির্মিতব্য কালুরঘাট সেতুর নাম আমি মঈন উদ্দিন খান বাদল সেতু” নামকরণের প্রস্তাব করছি এবং এ ব্যাপারে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, জননেত্রী শেখ হাসিনার সদয় দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।
আজ অবসরে ভাবি, নেতা আসবে, নেতা যাবে। কিন্তু, ‘জননেতা’ তকমা সবার ভাগ্যে জুটবে না। নেতা হওয়া সহজ, জননেতা হওয়া কঠিন। রাজনীতির সুদীর্ঘ পথ-পরিক্রমায় জনতার হৃদয় জয় করা মঈন উদ্দিন খান বাদল নিঃসন্দেহে একজন জননেতা ছিলেন।

লেখক : প্রাবন্ধিক, নির্বাহী সম্পাদক, মদীনার আলো।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট