চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪

নতুন সড়ক পরিবহন আইন : একটি পর্যালোচনা

সৈয়দ মুহাম্মদ জুলকরনাইন

১৮ নভেম্বর, ২০১৯ | ২:২৫ পূর্বাহ্ণ

নতুন সড়ক পরিবহন আইন পর্যালোচনা করলে দেখা যায় দু’টি জরুরি পয়েন্ট সেখানে গুরুত্ব পায়নি। ১টি হচ্ছে যানবাহনে গ্যাস সিলিন্ডার ব্যবহার।

আমি যখন এ লিখা শুরু করেছি ঘুর্ণিঝড় ‘বুলবুলে’র আপডেট দেখার জন্যে কিছুক্ষণ পর পর টেলিভিশনে ব্রেকিং নিউজ দেখছিলাম। ‘বুলবুলে’র পাশাপাশি স্ক্রলে ভেসে উঠলো ‘কুমিল্লায় মাইক্রোবাসের সিলিন্ডার বিস্ফোরণে (যদিও দুর্ঘটনা কবলিত হওয়ার ফলে) ৩জন নিহত। আমাদের স্মরণে আছে শোকাবহ ২১ ফেব্রুয়ারির প্রারম্ভে পুরনো ঢাকার (চকবাজার) চুড়িহাট্টাতে যানবাহনের গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণে ৭০ জন মানুষের প্রাণহানী ঘটে।

সাম্প্রতিক সময়ে আরো একটি হৃদয়বিদারক ঘটনা আমরা দেখেছি। গত ১৭ অক্টোবর চট্টগ্রাম থেকে অ্যাম্বুলেন্সে করে বাড়ি ফিরছিলেন পরিবারের ৬ সদস্য। চিকিৎসা শেষে বাড়ি ফেরার পথে তাঁদের বহনকারী অ্যাম্বুলেন্সটি আনোয়ারা উপজেলার চাতরি বাজার এলাকায় পোঁছলে বিকট শব্দে গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরিত হয়ে গটনাস্থলে ৩ জন নিহত হয় এবং অপর ৩ জন গুরুতর আহত হয়। কিছু স্বার্থান্বেষী পরিবহন মালিক গ্যাস সিলিন্ডার ঞবংঃরহম না করে ৫ বা ৮ বছরের অধিক ব্যবহার করার ফলে দেশবাসীকে নিশ্চিত মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণের কারণ হিসেবে শুধু মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়া বা পুনরায় ঞবংঃরহম না করানো নয়, তার পাশাপাশি খানা খন্দকে ভরা রাস্তা, অসম উচ্চতার স্পিড ব্রেকারও দায়ী। কেন না মসৃণ রাস্তা না হলে সিলিন্ডারের উপর যে চাপ বা প্রভাব পড়ে তাতে বিস্ফোরণের মতো মারাত্মক দুর্ঘটনার মাত্রা বেড়ে যাচ্ছে। তবে এ ক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষের কঠোর নজরদারি এবং বেহাল অবস্থার সড়কগুলো নিয়মিত পরিচর্যার আওতায় আনলে উপরোক্ত বিপদ থেকে দেশের মানুষ রক্ষা পেতে পারে। দ্বিতীয় পয়েন্টটি হচ্ছে গাড়ির হাইড্রোলিক হর্ন। অতর্কিতে বিকট হর্নের শব্দ মানুষের শ্রবণশক্তি কেড়ে নিতে পারে। এমনকি অজ্ঞান করে দিতে পারে। মানুষের স্বাভাবিক শ্রবণসীমা ৪৫ ডেসিবল পর্যন্ত। তার অতিরিক্ত শব্দ হলে মানবদেহে বিভিন্ন সমস্যার সৃষ্টি হয়। তারমধ্যে মস্তিষ্কের রোগ, কাজ করার সক্ষমতা কমে যাওয়া, ক্রোধ বেড়ে যাওয়া, উচ্চ রক্তচাপ, আলসার, দুর্বলতা এবং হার্টের সমস্যা অন্যতম। হাইকোর্ট থেকে হাইড্রোলিক হর্ন নিষিদ্ধ করা হয়েছে। জরিমানার বিধানও আছে। তবুও ক্রমগতভাবে নিষিদ্ধ হাইড্রোলিক হর্ন ব্যবহারের ফলে সৃষ্ট শব্দদূষণ বেড়ে চলেছে। বেড়ে চলেছে সাধারণ মানুষের চরম ভোগান্তি। বিশেষ করে শিশুকিশোরদের জীবনে অন্ধকার নেমে আশার শংকা বহুলাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে। ভুক্তভোগীরা বলছেন জরিমানার পরিমাণ কম হওয়াতে শব্দ দূষণকারীরা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। গাড়ির হর্ন বাজানোর ক্ষেত্রে চালকদের যেন কোন তোয়াক্কাই নেই। এ ব্যপারে রাস্তায় চলাচলকারীদের হতে হবে অনেক বেশি সচেতন। যাতে হর্ন বাজিয়ে রাস্তা ছেড়ে দেয়ার জন্যে বলতে না হয়। এমনি পরিস্থিতিতে শব্দদূষণ তথা গাড়ির হর্নের শব্দ নিয়ন্ত্রণে কঠোর আইন ও আইনের প্রয়োগ তরান্বিত করা খুবই জরুরি। বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতে গাড়ির হর্ন বাজানোকেও একটি জবাবদিহিতার আওতায় আনা হয়েছে যাতে খুব প্রয়োজন না হলে হর্ন বাজানো না হয়। তাই সেখানে হর্নের শব্দ শোনা যায়, কদাচিৎ। আমাদের দেশে হরহামেশা দেখা যায় গাড়ি সিগন্যালে, যানজটে কিংবা ধীরে চলা গাড়ির পেছনে পরলে পাল্লা দিয়ে হর্ন বাজানো শুরু হয়। যে যত বেশী হর্ন বাজাতে পারে যেন সে তত বড় বাহাদুর। বাংলাদেশের নব্বই ভাগ কিংবা তারো বেশি গাড়ি চালকদের শব্দদূষণ সম্পর্কে জ্ঞাত আছে বলে মনে হয় না। আসলে শব্দদূষণের ক্ষতিকর প্রভাব যে তাদের জীবনকেও অতিষ্ঠ করে দিচ্ছে সে বিষয়ে কোন সচেতনতাই নেই।

সড়ক পরিবহন আইন যা আগে ছিল এবং বর্তমানে নতুনভাবে ঢেলে সাজানো আইনের কিছু কিছু ক্ষেত্রে তারতম্য দেখা যাচ্ছে। যেমন রেজিস্ট্রেশনবিহীন এবং ফিটনেসবিহীন গাড়ির সংশ্লিষ্টতা সরাসরি মালিক পক্ষের সাথে। দু’টি ক্ষেত্রে পুরনো আইনে যেখানে জরিমানার পরিমান ছিল ২,০০০ টাকা সেখানে নতুন আইন মোতাবেক রেজিস্ট্রেশনবিহীন গাড়িতে ২৫ ভাগ বাড়িয়ে ৫০,০০০ টাকা এবং ফিটনেসবিহীন গাড়িতে ১২.৫ ভাগ বাড়িয়ে করা হয়েছে ২৫,০০০ টাকা। একিইভাবে ভুয়া লাইসেন্স নিয়ে গাড়ি চালানোর ক্ষেত্রে ৫০০ টাকার জরিমানা ২০০ থেকে ১,০০০ ভাগ পর্যন্ত বাড়িয়ে করা হয়েছে ১-৫ লাখ টাকা। বিজ্ঞজনদের অভিমত হচ্ছে ফিটনেসবিহীন গাড়ির সাথে জন-জীবনের শতভাগ ঝুঁকি থাকা সত্বেও সেখানে মাত্র ২৫,০০০ টাকা কোন যৌক্তিক মানদন্ডে নির্ধারণ করা হলো। একজন গাড়ি চালকের ৫ লাখ টাকা জরিমানা দেয়ার সামর্থ থাকলে তার জীবিকার ব্যবস্থা নীজেই করতো। নতুন সড়ক পরিবহন আইনে অবৈধ পার্কিং এবং হেলমেট ছাড়া মোটর বাইক চালালে পাঁচ হাজর এবং দশ হাজার টাকা জরিমানার কথা বলা হয়েছে। এ দু’টি ক্ষেত্রে ২৫০০ টাকা করে তাৎক্ষণিক জরিমানা আদায়ের ব্যবস্থা করতে পারলে অধিক সুফল পাওয়া যাবে বলে মনে করেন অভিজ্ঞ মহল। চালক গাড়ি চালানো অবস্থায় ফোনে কথা বললে ১০,০০০ টাকা জরিমানা করা উচিৎ বলেও মত দিয়েছেন বিভিন্ন মহল। কেননা দুর্ঘটনার কয়েকটি অন্যতম কারণের মধ্যে এটিও একটি বলে চিহিৃত হয়েছে। আরেকটি তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, রাস্তা পারপারের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ২,০০০ টাকা তাৎক্ষণিক জরিমানা আদায় যৌক্তিক হিসেবে মনে করেন দেশের মানুষ। তবে এরিই সাথে একটি বড় প্রশ্ন রয়ে গেছে দেশবাসীর মনে। সেটি হচ্ছে রাস্তা পারাপারের সুবন্দোবস্ত করা। বর্তমানে দেশ আধুনিক প্রযুক্তির দিকে এগুলেও এক সময়কার জনপ্রিয় ও জন গুরুত্বপূর্ণ জেব্রা ক্রসিং তবনৎধ ঈৎড়ংংরহম অনেকাংশে হারিয়ে গেছে। যেমনি হারিয়ে গেছে নির্দিষ্ট স্থানে গাড়ি থামানোর পদ্ধতি। মাঝে মধ্যে জেব্রা ক্রসিংয়ের পরিবর্তে ঋড়ড়ঃ ঙাবৎ ইৎরফমব দেখা যায়। কিন্তু প্রবীণ বা বয়স্ক মা-বাবা, শিশু, কিশোর, অনেক যুবক যাদের কোমর ব্যথা হাঁটু ব্যথা আছে এমনি অনেকে ফুট ওভারব্রীজ ব্যবহার করতে পারেন না। হবু মা ও শ্বাস কষ্টের কারণে বহু লোকের পক্ষে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠাও সম্ভব হয় না। সুতরাং দেখা যাচ্ছে জেব্রা ক্রসিং একটি প্রয়োজনীয় বিষয়। জেব্রাক্রসিং পারাপারের সময় ইঙ্গিত ওহফরপধঃরড়হ স্বরূপ ক্রসিংয়ের দু’পাশে দু’টি খুঁটিতে হাঁটার চিহ্ন এবং বিশেষ ধরনের শব্দের ব্যবস্থা করা দরকার। যাতে বধির এবং সাদা ছড়ি ওয়ালা অনায়াসে রাস্তা পার হতে পারেন। তবে এ ব্যপারেও চালকদের প্রশিক্ষণের বিকল্প নেই। উল্লেখিত বিষয়ে সুপরিকল্পনা গ্রহণ এবং তা শতভাগ বাস্তবায়ন করা যোগাযোগ মন্ত্রণালয় ও তদসংশ্লিষ্ট বিভাগ সমূহের দায়িত্ব। সড়কে মৃত্যুর হানা এবং পরিবহন সেক্টরের নৈরাজ্য কিছুতেই সফলতার লক্ষণ নয়।

সত্যিকারভাবে দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যথাযথ দায়িত্ব পালন করলে সড়ক থাকতো নিরাপদ। গাড়ি এবং গাড়ি চালকের কাগজপত্র নিয়মিত পরীক্ষা করে আইনকে সঠিক প্রয়োগের মাধ্যমে কার্যকর ভূমিকা রাখার দায়িত্ব সরকারি বাহিনীর। জনগণের জান-মালের হেফাজত করাই এ বাহিনীর শপথ।

অত্যন্ত খারাপ নজীর হলেও এ কথা সত্য যে, আমাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সৎ, সাহসী ও সংযমী হলে টাকার বিনিময়ে পার পেয়ে যাওয়ার যে মানসিকতা দুষ্টচত্রের মাঝে বিরাজমান তার অবসান হতো এবং আইন মেনে চলতেই হবে এমনি মাসিকতার জন্ম নিতো। পাশাপাশি আরো একটি বিষয় গুরুত্ব বিবেচনায় প্রাসঙ্গিক যা নিরাপদ সড়ক ও সাধারণ যাত্রীদের স্বস্তি দিতে পারে-তা হচ্ছে সুদক্ষ, প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত আর শিক্ষাগত যোগ্যতা (নূন্যতম ৮ম শ্রেণি) সম্পন্ন চালক। উদাহরণ স্বরুপ পাঠাও, উবার চালকদের অনেকেই শিক্ষিত কিংবা মোটামুটি স্তরের শিক্ষিত এবং বিদেশ ফেরত যুবক। যাদের মধ্যে কিছু সংখ্যক আবার গাড়ির মালিকও। তাদের মার্জিত ব্যবহার আর গাড়ি চালনায় সতর্কতাই বলে দেয় কিছুটা হলেও শিক্ষা দিক্ষা তারা নিয়েছে।
সর্বশেষ অপপরফবহঃ জবংবধৎপয ওহংঃরঃঁঃব-অজও এর গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে চালকের বেপরোয়া মনোভাব এবং অতিরিক্ত গতিতে গাড়ি চালানোই নব্বই শতাংশ দুর্ঘটনার জন্যে দায়ী। অর্থাৎ মূল কারণ শনাক্ত হয়েছে। এখন বাস্তবায়ন চায় সড়ক পরিবহন আইনের যদি কোন সুফল আসে। এ ধরনের আশা করাটা দেশের মালিক জনগণের খুবই যৌক্তিক।

সৈয়দ মুহাম্মদ জুলকরনাইন রাজনীতিক, প্রাবন্ধিক।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট