চট্টগ্রাম শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

শিশুর মানসিক বিকাশ

সঞ্জয় চৌধুরী

১৭ নভেম্বর, ২০১৯ | ৩:১৫ পূর্বাহ্ণ

কালের পরিক্রমায় মানুষের চাহিদার পরিবর্তন হয় এবং সাথে সাথে পরিবর্তন হয় তাদের জীবনযাত্রার মান সমূহ। সবাই চান তার সন্তান ভবিষ্যতে টিকে থাকার সংগ্রামে যেন উত্তীর্ণ হয়ে একজন আদর্শ নাগরিক হিসেবে গড়ে উঠে। কিন্তু ঐ সন্তান বাস্তব জীবনে কতটুকু সফলতা অর্জন করতে পারবে তা নির্ভর করবে একমাত্র তার শৈশবকালীন মানসিক বিকাশের উপর। সাধারণত একজন শিশুর মাতৃগর্ভে থাকা অবস্থা থেকে তার মানসিক বিকাশ শুরু হয় এবং এ সময় অধিকাংশ নিউরন বৃদ্ধি পায়। জন্মের পর থেকে এই নিউরন বৃদ্ধির হার আস্তে আস্তে কমতে থাকে। এজন্য ভবিষ্যৎ সন্তানের শারীরিক ও মানসিক সুস্থতা নিশ্চিত করার প্রথম ও গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হলো গর্ভকালীন মায়ের সুস্থতা নিশ্চিত করা। জন্মের পর শিশুর বিভিন্ন ক্রিয়া-কলাপ এবং পরিবেশের ছোঁয়ায় উদ্দীপনা সৃষ্টির মাধ্যমে নিউরনের সংযোগের ফলে এগুলো সক্রিয় হয় এবং সঙ্গে সঙ্গে মানসিক বিকাশও শুরু হয়।

মনোবিজ্ঞানীদের মতে শিশুর জন্মের পর থেকে ৫-৬ বছর পর্যন্ত প্রায় ৮০-৯০ শতাংশ মানসিক বিকাশ সাধিত হয়। এ কারণে এই সময়টুকুতে তার আবেগের বহিঃপ্রকাশ এবং অন্যের ভাবভঙ্গী উপলব্ধির মাধ্যমে যেন তার সামাজিক যোগাযোগের ক্ষেত্র সৃষ্টি হয় সে লক্ষ্যে তাদের সাথে হাসি খুশির ছলে গল্প গুজবের মাধ্যমে সময় কাটিয়ে তাদের আবেগের বহিঃপ্রকাশ ঘটানো উচিত। এই সময় গল্পের ছলে যদি কিছু নৈতিকতার উদাহরণ সংশ্লিষ্ট দৃষ্টান্ত তাদের সামনে তুলে ধরা যায় তাহলে এদের মধ্যে ধীরে ধীরে এসব গুণাবলী বিকাশিত হতে থাকবে। এক সময় দেখা যেত অভিভাবকরা তাঁদের সন্তানের মাঝে ঐ সমস্ত গুণাবলীর প্রতিফলন ঘটানোর জন্য প্রাথমিক অবস্থায় হাতে রাম সুন্দর বসাক প্রণীত ‘‘বাল্যশিক্ষা’’ ধরিয়ে দিতেন। এটি অধ্যয়ন করে একজন শিশু জীবনের প্রাথমিক অবস্থায় বিনয়, শৃঙ্খলা, মমতা ও গুরুজনের প্রতি শ্রদ্ধাবোধের মত মানবিক গুণাবলীসমূহ চর্চা করত। এই সমস্ত বইয়ে শিশুর মনমানসিকতার দিকে স্ক্ষ্মু নজর রাখা হত। যেমন অসৎ সঙ্গ ত্যাগ করা, দরিদ্রকে দয়া করা, ক্ষমা মহত্ত্বের লক্ষণ ইত্যাদি নীতিবাক্যগুলো এই বাল্য শিক্ষায় লিপিবদ্ধ থাকত যা শিশুদের কোমল মনে গ্রোথিত হয়ে মানবতার মত মহৎ গুণাবলীকে অনুশীলন করতে পারত। প্রাথমিক অবস্থায় শিশু যা শেখে তা পরবর্তী জীবনে তার পথ চলার পাথেয় হিসেবে কাজ করে।

কিন্তু বর্তমানে বাস্তবে আমরা তাকালে দেখি রামসুন্দর বসাক প্রণীত সেই বাল্যশিক্ষাগুলোকে অভিভাবকরা জাদুঘরে রেখে কিন্ডার গার্টেনগুলোতে প্লে, নার্সারি ইত্যাদি শ্রেণিতে ভর্তির মাধ্যমে গাদায় গাদায় বই দিয়ে তাদের কাঁধের ব্যাগগুলোকে ভারী করে মানসিক চাপ বাড়ানো হচ্ছে, যা আমাদের জন্য মোটেই কাম্য নয়।

যেখানে আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শিশুদের উপর মানসিক চাপ কমানোর জন্য তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত বিদ্যালয়ের প্রচলিত পরীক্ষাসমূহ বন্ধ করার নির্দেশ দিয়েছেন সে ক্ষেত্রেই সমস্ত শ্রেণিতে এসব গাদায় গাদায় বই চাপিয়ে দেয়া কতটুকু যুক্তিসঙ্গত তা প্রশ্ন থেকে যায়। এবার আমরা একজন শিশুর বহির্জগতের দিকে দৃষ্টি দিলে দেখি এরা সবচেয়ে বেশি বিশ্বাস করে তাদের শিক্ষকদের কথা এবং শিক্ষক হলেন তাদের কাছে সবচেয়ে আকর্ষণীয় ও অনুকরণীয় ব্যক্তিত্ব। শিশুর চেতনার ছোট জগতটি যদি একজন শিক্ষক সুষম জ্ঞানে সমৃদ্ধ করেন তাহলে সেই শিশুর চিন্তা হবে অধিকতর বস্তনিষ্ঠ, মানস জগৎ হবে পৃথিবীর বাস্তবতায় বিকাশমান। প্রায় সময় দেখা যায়, শিশুর মত প্রকাশে স্বাধীনতা দেয়া হয় না এবং বড়দের মাঝে ছোটদের নাক গলাতে নেই বলে ধমক দিয়ে তাড়িয়ে দেওয়া হয়। আমাদের মনে রাখতে হবে মত প্রকাশের স্বাধীনতা শিশুর মানসিক বিকাশে খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। মনোবিজ্ঞানীরা বলেছেন, হাসির মাধ্যমেই শিশু সামাজিকতা বুঝতে শেখে। আত্মবিশ্বাস অর্জন ও মানসিকতা বিকাশে এটির ভূমিকা কোন অংশে কম নয়। তাই কোন শিশু যাতে আত্মবিশ্বাস ও হীনম্মন্যতায় না ভোগে সেদিকে আমাদেরকে খেয়াল রাখতে হবে।
অনেকে আছেন শিশু যদি বিদ্যালয়ের পরীক্ষায় ভালো ফলাফল অর্জন না করে তাহলে তাকে শারীরিক ও মানসিক শাস্তি দেন। মনে রাখতে হবে এটি শিশুর বিকাশে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। এগুলোর মাধ্যমে ইট পাথরে গড়া এই যান্ত্রিক পরিবেশে আমরা তাদের যান্ত্রিক মানবে পরিণত করছি। আমরা তাদের বন্দী খাঁচায় ডানাকাটা পাখির মত বন্দী করে রেখেছি। বন্দী পাখির যেমন একটা আকুতি থাকে মুক্ত আকাশে ডানা মেলে উড়ে বেড়াতে, তেমনি প্রতিটি শিশুর ইচ্ছা থাকে বিশাল আকাশের নিচে মুক্ত পরিবেশে সহপাঠিদের সাথে খেলাধুলা ও দৌড়াদৌড়ি করতে। এটি তাদের বয়সের চাহিদা। আমরা মা-বাবারা এটি বুঝেও না বোঝার চেষ্টা করি।

শিশুর কোন কথাকে হেয় করে উড়িয়ে না দিয়ে তাকে সুন্দরভাবে বুঝিয়ে উৎসাহ দিতে হবে। তাদেরকে খেলাধুলাও অন্যান্য শিশুর সঙ্গে মেলামেশার সুযোগ করে দিতে হবে। এতে তাদের সামাজিকতার মনোভাব ও নেতৃত্বের গুণ সমৃদ্ধ হয়ে অনুসন্ধিৎসুর মত মহৎ গুণাবলী অর্জিত হবে। অনেক সময় আমরা দেখি সন্তানদেরকে নামীদামী স্কুলে পড়াতে হবে।

এ প্লাস পেতে হবে, পাশের বাসার অমুকের যে সন্তান আছে তার চেয়ে ভালো রেজাল্ট করতে হবে ইত্যাদি অসুস্থ প্রতিযোগিতায় তাদের দাঁড় করিয়ে দিই। এ কারণে স্কুলের হোমওয়ার্ক, এ পরীক্ষা, সে পরীক্ষা ইত্যাদির মানসিক চাপে সে রাতে ঠিকমতো ঘুমাতেও পারে না। এখন আমাদের সময় হয়েছে এ সমস্ত চাপ থেকে তাদেরকে মুক্ত রাখতে। যদি এটিকে আমরা সম্ভব করতে পারি তবেই আজকের শিশু মানসিক ভারসাম্যতায় সমৃদ্ধ হয়ে প্রকৃত জ্ঞানার্জনের মাধ্যমে আগামীদিনের সুন্দর একটি পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারবে। পরিশেষে আমি শুধু এটুকু বলব চাপ মুক্ত পরিবেশে আজকের শিশুকে উপযুক্ত নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলে আমাদেরকে বেছে নিতে হবে মানব উন্নয়নের টেকসই পথ।

সঞ্জয় চৌধুরী শিক্ষাবিদ ও কলামিস্ট

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট