চট্টগ্রাম শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

মিয়ানমারের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে আন্তর্জাতিক আদালতে মামলা

১৬ নভেম্বর, ২০১৯ | ২:২৫ পূর্বাহ্ণ

শেষ পর্যন্ত মিয়ানমারের বিরুদ্ধে জেনোসাইড প্রতিরোধবিষয়ক আন্তর্জাতিক সনদ লঙ্ঘনের সুনির্দিষ্ট অভিযোগে মামলা দায়ের করা হয়েছে। ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিসে (আইসিজে) ৫৭ জাতি ইসলামী সহযোগিতা সংস্থার (ওআইসি) পক্ষে মামলাটি করেছে আফ্রিকার দেশ গাম্বিয়া। মামলায় গাম্বিয়া তাদের ৪৬ পৃষ্ঠার অভিযোগে রাখাইন রাজ্যে জেনোসাইডের উদ্দেশ্যে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী কর্তৃক পরিচালিত ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ, ধর্ষণ এবং সম্প্রদায়গুলোকে ধ্বংস করার অভিপ্রায়সহ বিভিন্ন বিষয় উল্লেখ করেছে। আন্তর্জাতিক ফৌজদারি আদালতে (আইসিসি) পূর্ণ তদন্ত শুরু করার জন্য একজন কৌঁসুলির যে আবেদনটির বিবেচনাধীন ছিল তাও অনুমোদন পেয়েছে। রোহিঙ্গাদের ওপর মিয়ানমার সেনাবাহিনীর দমন অভিযানে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত হয়েছে কি না তা তদন্তের অনুমোদন দিয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি)। প্রসিকিউশনের আবেদনে বিচারকরা এই অনুমোদন দিয়েছেন বলে বৃহস্পতিবার আইসিসির এক বিবৃতিতে জানানো হয়েছে। বিবৃতিতে বলা হয়, এটা বিশ্বাস করার যৌক্তিক ভিত্তি রয়েছে যে, ব্যাপকভাবে এবং/অথবা সিস্টেমেটিক সহিংস কর্মকা- ঘটানো হয়ে থাকতে পারে, যা মিয়ানমার-বাংলাদেশ সীমান্ত পাড়ি দেয়ার পেছনে মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবে গণ্য হয়ে থাকতে পারে। চেম্বার তাই বাংলাদেশ/মিয়ানমারের পরিস্থিতি তদন্তের অনুমোদন দিয়েছে। সন্দেহ নেই, এসব আশাজাগানিয়া সুখবর। এর মাধ্যমে রোহিঙ্গা গণহত্যার বিচারের পথ যেমন উন্মুক্ত হবে, তেমনি রোহিঙ্গাদের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পথও মসৃণ হবে।

উল্লেখ্য, এতোদিন বিভিন্ন দেশ রোহিঙ্গা সংকটের দ্বিপক্ষীয় সমাধানের নামে সমস্যাকে দীর্ঘতর করেছে। বাস্তবতা অস্বীকার করে বা পাশ কাটিয়ে এসবের মাধ্যমে কার্যত মিয়ানমারের দায়মুক্তির মেয়াদকেই দীর্ঘায়িত করা হয়েছে এবং হচ্ছে। ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিসে মামলা এবং অপরাধ তদন্তে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের অনুমোদনের পর এ বিষয়ে ইতিবাচক পরিবর্তনের সুযোগ তৈরি হবে নিশ্চয়ই। যদিও গণহত্যার সংজ্ঞা নিয়ে মিয়ানমার ও তার বন্ধুদেশগুলো অহেতুক বিতর্ক তুলতে পারে, কিন্তু রাখাইনে যে মানবতার বিরুদ্ধে জঘন্য অপরাধ সংঘটিত হয়েছে তা লুকানোর সুযোগ নেই। সে বিষয়ে প্রমাণের জন্যে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমই যথেষ্ট। বিশ্বের সচেতন ও মানবতাবাদী জনগণের মনেও এ ব্যাপারে কোনো সংশয় নেই। মিয়ানমার আইসিসির সদস্য না হলেও আইসিজের সদস্য। দেশটি জেনোসাইড প্রতিরোধবিষয়ক আন্তর্জাতিক সনদে স্বাক্ষর করেছে। কাজেই এই আদালতের সিদ্ধান্ত মানার ক্ষেত্রে মিয়ানমারের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। এসব বিবেচনায় আন্তর্জাতিক আদালতে মামলা এবং আইসিসি’র তৎপরতাসহ নানা কারণে রোহিঙ্গা সংকটের সমাধানে দিগন্তে আলোর রেখা দেখা যাচ্ছে বলে মনে হয়।

উল্লেখ্য, ২০১৭ খ্রিস্টাব্দের ২৫ অগাস্ট রাখাইনে নিরাপত্তা বাহিনীর বেশ কিছু স্থাপনায় ‘বিদ্রোহীদের’ হামলার পর রোহিঙ্গাদের গ্রামে গ্রামে শুরু হয় দেশটির সেনাবাহিনীর পৈশাচিক অভিযান। সেইসঙ্গে শুরু হয় বাংলাদেশ সীমান্তের দিকে রোহিঙ্গাদের ঢল। এর কয়েক মাসের মধ্যে সাত লাখের বেশি রোহিঙ্গা প্রাণ বাঁচাতে বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নেয়। তাদের কথায় উঠে আসে নির্বিচারে হত্যা, ধর্ষণ, জ্বালাও পোড়াওয়ের ভয়াবহ বিবরণ। জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা মিয়ানমারের বাহিনীর ওই অভিযানকে ‘জাতিগত নির্মূল অভিযান’ হিসেবে বর্ণনা করে আসছে। তবে অভিযোগ অস্বীকার করে মিয়ানমার বলে আসছে, তাদের ওই লড়াই ‘সন্ত্রাসীদের’ বিরুদ্ধে, কোন জাতিগোষ্ঠীকে নির্মূল করতে নয়। তবে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ও সরকারের ওই দাবি নাকচ করে দিয়ে জাতিসংঘ গঠিত স্বাধীন আন্তর্জাতিক ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশন বলেছে, রাখাইনে যে ধরনের অপরাধ হয়েছে, আর যেভাবে তা ঘটানো হয়েছে, মাত্রা, ধরন ও বিস্তৃৃতির দিক দিয়ে তা ‘গণহত্যার অভিপ্রায়কে’ অন্য কিছু হিসেবে চালিয়ে দেয়ার চেষ্টার সমতুল্য।

আন্তর্জাতিক ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশনের বিবৃতির পর বিশ^ব্যাপী আওয়াজ উঠে মিয়ানমারকে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো ব্যাপারে। শুরু হয় মানবিক চেতনায় সমৃদ্ধ মানুষদের তৎপরতা। তারই ধারাবাহিতায় আইসিসিতে রাখাইনে সংগঠিত জেনোসাইড তদন্তে আবেদন করা হয়। গত বছর সেপ্টেম্বরে রোহিঙ্গাদের বিতাড়নে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটনের জন্য মিয়ানমারের বিচারের এখতিয়ার হেগের আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের রয়েছে বলে সিদ্ধান্ত দেয়ার পর প্রাথমিক তদন্ত শুরু হয়। প্রাথমিক তদন্ত শেষে পূর্ণ তদন্ত শুরুর জন্য আইসিসির কৌঁসুলি ফাতোও বেনসুদার একটি আবেদন করেন। এখন বিচারকরা সায় দেয়ায় রোহিঙ্গা মুসলমানদের বিরুদ্ধে নৃশংতার অভিযোগের তদন্তে এটাই হচ্ছে প্রথম কোন আন্তর্জাতিক আদালতের উদ্যোগ। এখন এর সাথে যোগ হয়েছে ওআইসি’র পক্ষে দি ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিসে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে গাম্বিয়ার মামলা।
আমরা কোনো সংঘাত ছাড়াই রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান দেখতে চাই। এ ক্ষেত্রে গাম্বিয়ার উদ্যোগ ইতিবাচক। আমরা আশা করবো, বাংলাদেশের মিত্রদেশগুলোর মধ্যে বিশেষ করে চীন, রাশিয়া ও ভারত গাম্বিয়ার এ উদ্যোগের পাশে দাঁড়াবে। বিচারপ্রক্রিয়াকে এগিয়ে নিতে ও কার্যকর করতে সোচ্চারকণ্ঠ হবে বিশ^সম্প্রদায়। আমাদের বিশ^াস, পুরোবিশ্ব মানবিকবোধে উজ্জীবিত হয়ে নির্যাতিত ও বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের টেকসই পুনর্বাসনে সোচ্চারকণ্ঠ হলে সংকটের সম্মানজনক সমাধানে বেশিদিন অপেক্ষা করতে হবে না।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট