চট্টগ্রাম শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

অনন্য মানুষ, সুযোগ্য সম্পাদক

স্থপতি তসলিমউদ্দিন চৌধুরী

ড. মাহফুজ পারভেজ

১৫ নভেম্বর, ২০১৯ | ১:২৯ পূর্বাহ্ণ

খুবই মায়াবী ছোঁয়া দিয়ে এসেছিল অগ্রহায়ণের প্রথম দিনটি। দিনটি ছিল বুধবার, ১৫ নভেম্বর। অকস্ম্যাৎ সকালটি শোকস্তব্ধ হয়ে উঠলো। পূর্বকোণ সম্পাদক স্থপতি তসলিমউদ্দিন চৌধুরীর মৃত্যু সংবাদে বেদনাহত হলাম। প্রায় তিরিশ বছর পূর্বকোণে কলাম লিখি। নিজের আরেক পরিবারের মতোই পূর্বকোণ। যেহেতু খবরটি সংক্ষেপে জেনেছি, অনলাইন নিউজ পোর্টালে, সেহেতু বিস্তারিত জানতে ফোন করি পূর্বকোণ-এর কর্মীদের। প্রিয় সম্পাদকের মৃত্যু সংবাদ জানাতে গিয়ে টেলিফোনে বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েন অনেকেই। স্বজন হারানোর বেদনায় সকালটি নীল হয়ে গিয়েছিল। তার মৃত্যুদিনের স্মৃতি মনে পড়ল তারই মৃত্যুবার্ষিকীতে।

পিতা পূর্বকোণ-প্রতিষ্ঠাতা-সম্পাদক আলহাজ মোহাম্মদ ইউসুফ চৌধুরীর মৃত্যুর পর যোগ্যতার সাথে স্থপতি তসলিমউদ্দিন চৌধুরী পত্রিকার হাল ধরেছিলেন। পূর্বকোণ-এর ঐতিহ্য ও সমৃদ্ধির জায়গাটিকে অটুট রাখতে তিনি ছিলেন নিরলস। শেষ দিকে শারীরীক অসুস্থতা সত্ত্বেও সম্পাদকের কর্তব্য-কর্ম পালনে তিনি বিন্দুমাত্র শৈথিল্য প্রদর্শন করেন নি। বরং বিভিন্ন সামাজিক ও জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে নিজের উৎসাহ প্রদর্শন করেছেন। পূর্বকোণ-এর সাংবাদিক ও কর্মীদের প্রতিনিয়ত অনুপ্রাণিত করে যথাযোগ্যভাবে নেতৃত্ব দিয়েছেন। শৃঙ্খলা ও গতিশীলতা আনয়নের মাধ্যমে পূর্বকোণকে কেবল চট্টগ্রামেরই নয়, বাংলাদেশের একটি অগ্রণী দৈনিকে পরিণত করতে সচেষ্ট ছিলেন তিনি। তিনি ছিলেন অনন্য মানুষ, সুযোগ্য সম্পাদক।

প্রশাসনিক ও সম্পাদনার কাজে পিতার যোগ্য উত্তরসুরী ছিলেন তিনি। ছিলেন সজ্জন ও বন্ধুবৎসল। পূর্বকোণ-পরিবারের সঙ্গে নানাভাবে জড়িতদের খোঁজ-খবর রাখতেন। কোনও লেখা ভালো হলে প্রশংসা করতেন। লেখা বন্ধ থাকলে কেন লিখছি না, সে খবর নিতেন। বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে দেখা হলে কাছে এসে কুশলাদি জানতেন। তার চেম্বারে গিয়ে চা না খেয়ে আসার অভিজ্ঞতা অন্তত আমার নেই।
পত্রিকার দায়িত্ব-পরিসীমাকে বাড়ানোর জন্য শিল্প, বাণিজ্য, শিক্ষা, আইন-শৃঙ্খলা ইত্যাদি নানা বিষয়ে গভীর ও বিশ্লেষণধর্মী রিপোর্ট প্রকাশ ছাড়াও পূর্ণ পাতাব্যাপী ফোকাস বা গোলটেবিল আলোচনার সূচনাও তিনি পূর্বকোণ-এ করেছিলেন। বিভিন্ন শ্রেণি ও পেশার মানুষের সাথে পত্রিকার মেলবন্ধন দৃঢ়তর করতে তার ছিল নানা উদ্ভাবনী চিন্তা ও উদ্যোগ। শিক্ষা ও ভর্তি সংক্রান্ত গোল টেবিল সমন্বয়ের দায়ত্বও তিনি আমাকে দিয়েছিলেন।
নিজে ছিলেন খুবই উচ্চশিক্ষত ও মার্জিত। আধুনিক ও অগ্রসর চিন্তা, তথ্য, প্রযুক্তি, সর্বশেষ খবরাখবর সম্পর্কে তিনি সব সময় আপটুডেট থাকতেন। পারিপার্শ্বের মানুষদেরকেও তিনি পরিশীলিত ও শাণিত করতে নিরত থাকতেন। একটি উদাহরণ দিলেই সেটা বোঝা যাবে। এখন যে আনোয়ার হোসেন পিন্টু সত্যজিৎ রায়কে নিয়ে চর্চা করেন, তাকে তসলিম চৌধুরীই ১৯৭৪ সালে সর্বপ্রথম সত্যজিতের নাম জানান। উল্লেখ করা অপ্রাসঙ্গিক, তবু বলি, ১৯৭৪ সালে সত্যজিৎ রায় আজকের মতো অত বিখ্যাত ছিলেন না এবং তাকে ভালোভাবে অনেকেই চিনতো না। অথচ চট্টগ্রামের মতো প্রত্যন্ত অঞ্চলে বসে তসলিমউদ্দিন চৌধুরী সেই সত্যজিতের খোঁজ-খবর ১৯৭৪ সালেই রাখতেন। শুধু রাখতেনই না, সত্যজিতের কথা মানুষকে জানাতে ও উৎসাহী করতেও চেষ্টা করতেন।

সন্দেহ নেই, বেশ কিছু ভালো মানবীয় গুণের সমাবেশ ঘটেছিল স্থপতি তসলিমউদ্দিন চৌধুরীর মধ্যে। যদিও তিনি ছিলেন ভীষণ রকম আত্মপ্রচারবিমুখ একজন মানুষ। নিজেকে অন্তরালে রাখতেই তিনি পছন্দ করতেন। আলহাজ ইউসুফ চৌধুরীর যোগ্য উত্তরসুরী ছিলেন তিনি। অবশ্য ইউসুফ চৌধুরী তার সকল সন্তানকেই সুশিক্ষিত ও যোগ্যতর রূপে তৈরি করেছেন। প্রকৌশলী, ব্যবসায় প্রশাসক, চিকিৎসক ইত্যাদি বিশেষায়িত পেশার শীর্ষে পৌঁছেন তার সন্তানেরা। পাশাপশি পূর্বকোণ পরিবারের সদস্য হিসাবেও তারা সব সময় সচল ও সক্রিয় ছিলেন। ইউসুফ চৌধুরীর পর তসলিমউদ্দিন চৌধুরীর মাধ্যমে যে পরম্পরার সৃষ্টি হয়েছে, সেটা তার সুসন্তানেরা অব্যাহত রেখেছেন।

পূর্বকোণ-প্রতিষ্ঠাতা আলহাজ মোহাম্মদ ইউসুফ চৌধুরীর পাশে তার একনিষ্ঠ সন্তান ও পূর্বকোণ-এর যোগ্য সম্পাদক রূপে স্থপতি তসলিমউদ্দিন চৌধুরীও স্মৃতি হয়ে রয়ে যাবেন সকলের অন্তরে। শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় তিনি থেকে যাবেন পূর্বকোণ-এর পাতায়, পাঠকের মনে এবং চট্টগ্রামবাসীর হৃদয়ে। তার বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করি।

ড. মাহফজ পারভেজ কবি ও শিক্ষাবিদ; অধ্যাপক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট