চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

স্মৃতির আয়নায় স্থপতি তসলিমউদ্দীন চৌধুরী

ডা. হাসান শহীদুল আলম

১৫ নভেম্বর, ২০১৯ | ১:২৯ পূর্বাহ্ণ

১৯৭৩ সাল। কাজীর দেউড়ী দ্বিতীয় লেইনের শেষ দালানটি। আল’মীন। সাহিত্যিক মাহবুব উল আলমের বাড়ী। অর্থাৎ আমার নানাবাড়ী। চট্টগ্রাম সরকারী কলেজে আই-এস-সি অধ্যয়নরত আমি ক্লাশ শেষে নানাবাড়ীর এক পাশের বড় রুমটিতে চলে আসতাম। বেস্ গীটারের নোটেশান এর গুরুগম্ভীর আওয়াজে পুরো দালানটি ছন্দায়িত হতো। সাজেদ-শাহেদ-এনায়েত-রুডি টমাস-রনি-তাজুল এরা প্রেকটিস করতো। ‘সুরেলা গোষ্ঠী’। যা পরবর্তী নকীব-রউফ-পিলু এদেরকে যোগ করে ‘সোল্স্ ব্যা- গোষ্ঠীতে পরিণত হয়েছিলো। ঐ রুমে আড্ডার মাঝে আমরা আরো একজনকে মাঝে মাঝে পেতাম। তিনি ছিলেন আমাদের তসলিম ভাই। গীটার বাজাতেন। ‘প্রাউড মেরী-লুকিং ফর এ জব্ ইন দি সিডি’ গানটি ভালই বাজাতেন। তিনি তখন বুয়েটে স্থাপত্য বিদ্যা পড়ছেন। গীটার বাজানোর ফাঁকে ফাঁকে তিনি সুন্দর সুন্দর জোক্স্ বলে আমাদের হাসাতেন।

সেই তসলিম ভাই অর্থাৎ ‘দৈনিক পূর্বকোণ’-এর প্রাক্তন সম্পাদক মরহুম আলহাজ¦ তসলিম উদ্দীন চৌধুরী দু’বছর আগে আমাদের ছেড়ে না ফেরার দেশে চলে গেছেন। তাঁকে নিয়ে লিখতে গিয়ে আজ মনটা নস্টালজিক হয়ে পড়ছে।
১৯৭৬ সাল। আমি তখন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে এমবিবিএস প্রথম বর্ষের ছাত্র। ঢাকায় কোন কাজে গেলে বুয়েট-এর হলে পুরানো সহপাঠীদের রুমে থাকতাম। স্থাপত্য বিল্ডিং-এর সামনের সিঁড়ির ধাপে বসে আমরা বন্ধুরা আড্ডা দিতাম। সেখানেও মধ্যমণি হয়ে থাকতেন আমাদের তসলিম ভাই।
২০১০ সাল। আমার বই ‘চিকিৎসা শ্রমিকের দিনলিপি’ বের হলো। বইটি সবার আগে তসলিম ভাইকে দিতে হবে। তাঁর অফিসে চা খেতে খেতে অনেক কথা হলো। তিনি স্মৃতিচারণ করলেন কাজীর দেউড়ির। অল্পক্ষণের জন্য আমরা যেন চল্লিশ বছর আগেকার সেই দিনগুলোতে বিচরণ করেছিলাম।
১৯৫৪ সালের ১ জানুয়ারী চট্টগ্রাম নগরীর রেডক্রিসেন্ট সাবেক মেটারনিটি হাসপাতালে আলহাজ¦ তসলিমউদ্দীন চৌধুরী জন্মগ্রহণ করেন। বাবা পূর্বকোণ পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা মরহুম মোহাম্মদ ইউসুফ চৌধুরী এবং মাতা মরহুমা জহুরা বেগম। সেন্ট মেরিস্ ও সেন্ট প্লাসিড্স্ স্কুল থেকে শিক্ষার প্রাথমিক পর্ব শেষ করে ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজ থেকে বিজ্ঞানে উচ্চমাধ্যমিক সম্পন্ন করে প্রকৌশল বিশ^বিদ্যালয় অর্থাৎ বুয়েট থেকে স্থাপত্যবিদ্যায় ¯œাতক ডিগ্রী অর্জন করেন তিনি।

১৯৮৬ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি দৈনিক পূর্বকোণ প্রকাশিত হয়। ১৯৮৯ সালের ১ ফেব্রুয়ারি তিনি সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। পরবর্তীতে ২০০৭ সালের এপ্রিলে তিনি পূর্বকোণ গ্রুপের চেয়ারম্যান মনোনীত হন। সম্পাদক হওয়া সত্ত্বে তিনি নিজের পরিচয় দিতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন সংবাদপত্রের একজন কর্মী হিসেবে। স্থপতি ও নগর পরিকল্পনাবিদ হিসেবে দেশের অর্থনৈতিক চালিকা শক্তি তাঁর প্রিয় শহর চট্টগ্রামকে তিনি একটি পরিকল্পিত নগরী হিসেবে গড়ে তোলার অভিপ্রায় ব্যক্ত করতেন আমৃত্যু। চট্টগ্রাম উন্নয়ন সংগ্রাম পরিষদের প্রেসিডেন্ট হিসেবে বহু সভা, সেমিনার, সিম্পোজিয়াম করে চট্টগ্রামের মানুষের সুখ-দুঃখের কথা তিনি বলেছেন এবং নাগরিক অধিকার বাস্তবায়নে বিভিন্ন দাবী তুলে ধরেছিলেন।

তাঁর পরামর্শ ছিলো : ১) যারা চট্টগ্রামকে নিয়ে ভাবেন এমন নাগরিকদের মতামতের উপর গুরুত্ব দিতে হবে। ২) সিডিএ, ওয়াসা, সিটি কর্পোরেশনসহ সরকারী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্মধারার মধ্যে সমন্বয় থাকতে হবে। এ ছাড়াও তিনি অসংখ্য শিক্ষা, সেবামূলক ও রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। কলেবর বৃদ্ধি হবে বিধায় তার কিছু উল্লেখ করছি না। তিনি চট্টগ্রাম ভেটেরিনারী ও এনিমেল সায়েন্সেস বিশ^বিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সদস্য, বাংলাদেশ স্থপতি ইনস্টিটিউট চট্টগ্রাম চ্যাপটার-এর প্রাক্তন সভাপতি, চট্টগ্রাম ডায়াবেটিস এসোসিয়েশন-এর আজীবন সদস্য, চিটাগাং ডেইরী ফার্ম এসোসিয়েশন-এর প্রেসিডেন্ট ছিলেন।দেড়যুগেরও অধিক সময় যুদ্ধ করেছেন তিনি মরণব্যাধি ক্যান্সার এর সাথে। প্রতিমাসেই নতুন রক্ত সঞ্চালন করতে হতো তাঁর শরীরে। ফুসফুসে নিতে হতো কৃত্রিম শ^াস-প্রশ^াস। লাঠি হাতে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে তিনি যেতেন দপ্তরে।

এই আধুনিক স্পষ্টবাদী, কর্মবীর মানুষটি ঢাকার ধানম-ি রেনেসাঁ হাসপাতাল এন্ড রিসার্চ ইনসটিটিউটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ২০১৭ সালের ১৫ নভেম্বর বুধবার সকাল পৌণে সাতটায় ৬৪ বছর বয়সে ইহলোক ত্যাগ করেছিলেন। আমাদের প্রিয় তসলিম ভাইয়ের স্বপ্নের শহর বাস্তবায়িত হোক – এই প্রত্যাশা রেখে এবং তাঁর বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করে লেখাটি শেষ করছি। আমীন।

ডা. হাসান শহীদুল আলম চর্মরোগ ও ডায়াবেটিস-এ ¯œাতকোত্তর প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত চিকিৎসক, চট্টগ্রাম।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট