চট্টগ্রাম শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

আমরা শোকাহত বর্ষীয়ান রাজনীতিক চট্টগ্রামপ্রেমী মঈন উদ্দীন খান বাদলের বিদায়

৯ নভেম্বর, ২০১৯ | ৪:১৭ পূর্বাহ্ণ

না ফেরার দেশে চলে গেলেন বর্ষীয়ান রাজনীতিক মুক্তিযোদ্ধা চট্টগ্রামপ্রেমী মঈন উদ্দিন খান বাদল এমপি। দুই সপ্তাহ আগে নিয়মিত চেকআপের জন্য তিনি ভারতে যান। সেখানে বেঙ্গালুরুতে নারায়ণ ইনস্টিটিউট অব কার্ডিয়াক সায়েন্সেস হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় বৃহস্পতিবার তিনি ইন্তেকাল করেন (ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। যুক্তিপূর্ণ বক্তৃতায় সংসদ কাঁপানো এই রাজনীতিক দীর্ঘদিন ধরেই হার্টের সমস্যাসহ স্বাস্থ্যবিষয়ক নানা জটিলতায় ভুগছিলেন। দুই বছর আগে তিনি ব্রেইন স্ট্রোকে আক্রান্ত হন। সবার আশা ছিলো তিনি চিকিৎসাশেষে সুস্থ শরীরে দেশে ফিরবেন। দেশ ও জাতির সেবায় নিজেকে পুনরায় নিবেদিত করবেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সে আশা পূরণ হলো না। তিনি সবাইকে কাঁদিয়ে চলেন গেলেন পরপারে। এ যেন বিনা মেঘে বজ্রপাত।
মৃত্যুকালে মঈন উদ্দিন খান বাদলের বয়স হয়েছিল ৬৭ বছর মাত্র। ষাটের দশকে ছাত্রলীগের ‘নিউক্লিয়াসে’ যুক্ত বাদল একাত্তরে ভারতে প্রশিক্ষণ নেন এবং পরে যোগ দেন মুক্তিযুদ্ধে। চট্টগ্রাম বন্দরে অস্ত্র বোঝাই জাহাজ সোয়াত থেকে অস্ত্র খালাস প্রতিরোধের অন্যতম নেতৃত্বদাতা ছিলেন তিনি। মুক্তিযুদ্ধের পর তিনি সমাজতান্ত্রিক রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হন। জাসদ হয়ে বাসদ এবং পরে আবারও জাসদে ফেরেন। এরশাদের সামরিক শাসনের সময় যেতে হয় কারাগারে। ২০১৬ খ্রিস্টাব্দের ১২ মার্চ হাসানুল হক ইনুর নেতৃত্বাধীন জাসদের জাতীয় কাউন্সিলে দলটি দুই ভাগ হলে একটি অংশের কার্যকরী সভাপতির দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন তিনি। চট্টগ্রামের বোয়ালখালী-চান্দগাঁও আসন থেকে ২০০৮ খ্রিস্টাব্দে মহাজোটের মনোনয়ন পান শরিক দল জাসদের নেতা বাদল। নৌকা প্রতীকে তার বড় জয়ের মধ্য দিয়ে ওই আসনে বিএনপির দীর্ঘদিনের আধিপত্যের অবসান ঘটে। এরপর ২০১৪ এবং ২০১৮ খ্রিস্টাব্দে আরও দুই বার তিনি আসনের এমপি নির্বাচিত হয়ে সংসদে যান। জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন বিষয়ে দৃপ্ত বক্তব্য দেয়া বাদল সমাদৃত ছিলেন একজন দক্ষ পার্লামেন্টারিয়ান হিসেবে। উগ্রসাম্প্রদায়িক মৌলবাদী গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সব সময় সোচ্চার ছিলেন তিনি। কথা বলেছেন সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে। এছাড়া দেশের স্বার্থসংশ্লিষ্ট যে কোন বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন জনপ্রিয় এই নেতা। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ১৪ দল গঠনেও তাঁর ভূমিকা ছিল। তিনবারের সাংসদ বাদল একাদশ জাতীয় সংসদের ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা এবং মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সদস্য হিসেবেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন।
মঈন উদ্দিন খান বাদল ছিলেন সত্যিকারের একজন চট্টগ্রামপ্রেমী। সবসময় তিনি চট্টগ্রামের উন্নয়ন নিয়ে ভাবতেন, কথা বলতেন। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে চট্টগ্রামের অনন্য অবদান তুলে ধরে নীতিনির্ধারনী পর্যায়ে, এবং সংসদে চট্টগ্রামের উন্নয়নের ব্যাপারে সোচ্চারকণ্ঠ থাকতেন। বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ সবাই তাঁর কথা শোনতেন, আমলে নিতেন। চট্টলদরদী আলহাজ মোহাম্মদ ইউসুফ চৌধুরী এবং সাবেক মেয়র মহিউদ্দিন চৌধুরীর পর তিনিই একমাত্র ব্যক্তিত্ব, যিনি চট্টগ্রামের ন্যায্য স্বার্থের ব্যাপারে আপোষ করেননি কখনো। তিনি সবসময় বলতেন, সুপ্রাচীনকাল থেকেই চট্টগ্রামের গুরুত্ব বিশে^ সুবিদিত। বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রাণকেন্দ্র এই চট্টগ্রাম। বন্দরনগরী চট্টগ্রামই দেশের মোট রাজস্বের সিংহভাগের যোগানদাতা। চট্টগ্রামকে উন্নয়নবঞ্চিত রেখে কখনো বাংলাদেশকে এগিয়ে নেয়া যাবে না। উন্নয়নের মহাসড়ক ধরে দেশকে এগিয়ে নিতে চাইলে অবশ্যই চট্টগ্রামের যৌক্তিক হিস্যা দিতে হবে। সর্বাগ্রে চট্টগ্রামের উন্নয়ন করতে হবে। আগে দৈনিক পূর্বকোণের স্বপ্নদ্রষ্টা চট্টলদরদী মোহাম্মদ ইউসুফ চৌধুরীর কণ্ঠেই শোনা যেতো এমন জনকাক্সিক্ষত দাবি। চট্টগ্রামপ্রেমের কারণে তিনি এই জনপদের মানুষের ভালোবাসার সর্বোচ্চ আসনে অধিষ্ঠিত আছেন এবং থাকবেন চিরকাল। মঈন উদ্দিন খান বাদলও চট্টগ্রামপ্রেম ও চট্টগ্রামবাসীর ন্যায্য দাবি বলিষ্ঠ কণ্ঠে জাতীয় সংসদসহ সব প্লাটফর্মে দ্বিধাহীন চিত্তে উপস্থাপন ও আদায়ে পুরোধা ছিলেন বলেই তিনিও জনগণের ভালোবাসায় সিক্ত হয়েছেন। তবে তাঁর একটি আক্ষেপ ছিল প্রায় শতবর্ষ প্রাচীন জরাজীর্ণ কালুরঘাট সেতুর পাশে একটি নতুন সেতু করতে না পারার। স্থানীয় সংসদ সদস্য হিসেবে এজন্য তিনি বিব্রতবোধ করতেন। জাতীয় সংসদে তিনি কালুরঘাটে সড়ক কাম রেলসেতু নির্মাণের দাবিটি বারবার তুলে ধরেছেন। সর্বশেষ চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে কালুরঘাট সেতুর একটি সুরাহা না হলে তিনি সংসদ সদস্য থেকে পদত্যাগ করার ঘোষণাও দিয়েছিলেন। তাঁর স্বপ্নের সেই সেতু নতুন কালুরঘাট সেতু হবে নিশ্চয়ই, তবে তা তিনি দেখে যেতে পারলেন না। আমরা মনে করি, নতুন কালুর ঘাট সেতুটি তাঁর নামেই হওয়া উচিত।
চট্টগ্রামের স্বার্থে, দেশের সাধারণ মানুষের স্বার্থে জাতীয় সংসদ থেকে শুরু করে সর্বত্রই ছিল মঈন উদ্দিন খান বাদলের গর্জন, আন্দোলন-সংগ্রাম। আমাদের বিশ^াস, দেশ ও জাতি গঠনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাঁর সাহসী ও বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। অন্যদের জন্যে পাথেয় হয়ে থাকবে তাঁর জীবনাদর্শ। আমরা মরহুমের শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি গভীর সমবেদনা জ্ঞাপন ও তাঁর বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট