চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

বিশ্বনবীর (সা.) জীবনদর্শন

ডা. মোহাম্মদ ওমর ফারুক

৯ নভেম্বর, ২০১৯ | ৪:১৭ পূর্বাহ্ণ

হে ঈমানদার ব্যক্তিরা, ‘কখনো নিজেদের আওয়াজকে নবীর আওয়াজের ওপর উঁচু করো না এবং নিজেরা যেভাবে একে অপরের সাথে উঁচু আওয়াজ ব্যবহার করো, নবীর সামনে কখনো সে ধরনের উঁচু আওয়াজে কথা বলো না, এমন যেন কখনো না হয় যে, তোমাদের সব কাজকর্ম (এ কারণেই) বরবাদ হয়ে যাবে এবং তোমরা তা জানতেও পারবে না’। (সূরা আল্ হুজুরাত, আয়াত-২)। বিশ্বনবীর রওজা শরীফের উপরে লেখা এ কথাটি যুগ যুগ ধরে বছরব্যাপী হাজীদের দৃষ্টি কাড়ে। রাসূল (সা.) এর রওজা শরীফ অতিক্রম করার সময় পৃথিবীর সমস্ত আবেগভরা কান্না এসে দু’ চোখ ভরে যায়, যেন চিৎকার করে আমার রাসূল (সা.) এর জন্য কাঁদি। কিন্তু পবিত্র কোরআনের আয়াতটি চোখে পড়লেই সেই কান্না ভেসে যায় ইথারে ইথারে। ইসলামের প্রথম ও দ্বিতীয় খলিফা হযরত আবু বক্কর সিদ্দিক (রা.) ও হযরত ওমর (রা.) এর মধ্যকার একটি ঘটনার সূত্রপাত থেকে মহান রাব্বুল আ’লামিন উপরোক্ত আয়াতটি নাযিল করেন। হযরত আবু মোলাইকা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, এমন অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল যে, দুই মহান ব্যক্তি অর্থাৎ আবু বকর (রা.) ও উমার (রা.) যেন প্রায় ধ্বংসই হয়ে যাচ্ছিলেন, যেহেতু তাঁরা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সামনে তাঁদের কন্ঠস্বর উঁচু করেছিলেন যখন বনী তামীম গোত্রের প্রতিনিধি হাযির হয়েছিলেন। তাদের একজন মুজাশিহ গোত্রের হাবিস ইব্ন আকরার (রা.) এর প্রতি সমর্থন করেন এবং অপরজন সমর্থন করেন অন্য একজনের প্রতি। বর্ণনাকারী নাফি’ (রা.) এর তাঁর নাম মনে নেই।

তখন আবু বকর (রা.) উমারকে (রা.) বলেন ঃ ‘আপনি তো সব সময় আমার বিরোধিতাই করে থাকেন।’ উত্তরে উমার (রা.) আবু বকরকে (রা.) বলেন ঃ ‘আপনার এটা ভুল ধারণা।’ এভাবে উভয়ের মধ্যে তর্কের ফলে তাদের কন্ঠস্বর উঁচু হয়। তখন এই আয়াতটি অবতীর্ণ হয়। আবদুল্লাহ ইব্ন যুবাইর (রা.) বলেন, ‘এরপর উমার (রা.) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে এত নি¤œস্বরে কথা বলতেন যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দ্বিতীয়বার তাঁকে জিজ্ঞেস করতেন।

ইসলামের খলিফাগণের চারিত্রিক সৌন্দর্য ছিল এমনি। মুসলিম জাতির পিতা হযরত ইব্রাহিম (আ.) আমার রাসূল (সা.) এর জন্য দোয়া করেছেন তাঁর জামানায় এভাবে, ‘হে আমাদের রব, তাদের (বংশের) মধ্যে তাদের নিজেদের মাঝ থেকে তুমি (এমন) একজন রাসূল পাঠাও, যে তাদের কাছে তোমার আয়াতসমূহ তেলাওয়াত করবে, তাদের তোমার কিতাবের জ্ঞান ও প্রজ্ঞা শিক্ষা দেবে, উপরন্তু (তা দিয়ে) সে তাঁদের পবিত্র করে দেবে (হে আল্লাহ, তুমি আমাদের দোয়া কবুল করো); অবশ্যই তুমি মহাপরাক্রমশালী, পরম কুশলী’ সূরা বাকারা আয়াত- ১২৯। মুসনাদ আহমাদে রয়েছে যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘আমি তখন থেকেই শেষ নবী যখন আদম (আ.) মাটির আকারে ছিলেন। আমি তোমাদেরকে আমার প্রাথমিক কথার সংবাদ দিচ্ছি। আমি আমার পিতা ইব্রাহীমের (আ.) প্রার্থনা, ঈসার (আ.) সুসংবাদ এবং আমার মায়ের স্বপ্ন।’ আমার মা স্বপ্নে দেখেন যে, তার মধ্য হতে যেন একটি আলো বেরিয়ে সিরিয়ার প্রাসাদগুলিকে আলোকিত করে দিল এবং তা দৃষ্টিগোচর হতে থাকল।’ বনী ইসরাঈলের শেষ নবী ঈসা রুহুল্লাহ (আ.) বনী ইসরাঈলের মধ্যে খুৎবা দেওয়ার সময় পরিষ্কারভাবে তাঁর নামও বলে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘আমি তোমাদের নিকট আল্লাহর রাসূল (সা.) এবং আমার পূর্ব হতে তোমাদের নিকট যে তাওরাত রয়েছে আমি উহার সমর্থক এবং আমার পরে আহমাদ নামে যে রাসূল (সা.) আসবেন আমি তাঁর সুসংবাদদাতা’-সূরা সাফফ, ৬১ ঃ ৬। পবিত্র কালামে পাকে আমার রাসূল (সা.) এর নাম মোহাম্মদ (সা.) হিসেবে রয়েছে ৪ বার, আহমদ রয়েছে ১ বার এবং অন্যান্য নাম যেমন: বাশিরান, নাজিরান, মোদ্দাস্সের, মোয্যাম্মেল, ইয়াসিন ইত্যাদি নামে রয়েছে সাড়ে ৪শ বার। বিশ্বনবী এসেছেন পৃথিবীর সমগ্র মানবজাতির মুক্তির দূত হিসেবে, মহান রাব্বুল আ’লামিন যেমন সমগ্র সৃষ্টিকূলের রব-তেমনি রাসূলুল্লাহ (সা.) ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সব মানুষের রাসূল। আঁধার ও পাপাচারে নিমজ্জিত মানুষদের আলোর পথ দেখানোর মহান ব্রত নিয়ে আবির্ভূত হয়েছিলেন যাযিরাতুল আরবের সময় মা আমেনার কোলে। সেই রাসূল (সা.) এর চরিত্র ছিল নিষ্কলুষ, মাসুম বাচ্চার মতন। তাঁর দুধমাতা হযরত হালিমাতুস্ সাদিয়ার কাছে যখন ছিলেন, ৬ বছর বয়সে তাঁর বক্ষ বিদারণ হয়েছিল হালিমার বাসগৃহের অদূরে। যেটা দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল ২০১৭ সালে ওমরাহ্ হজ্জের সময়-যখন আমরা তায়েফ ভ্রমনে ছিলাম।
হযরত হালিমার বাসস্থানটিও দেখার দুর্লভ সৌভাগ্য হয়েছে আমাদের। মা হযরত আয়েশা সিদ্দিক (রা.) কে যখন সাহাবিরা জিজ্ঞেস করেন, বিশ্বনবীর চরিত্র কেমন? মা আয়েশা বললেন, বিশ্বনবীর চরিত্র বিশ্বমানবতার হেদায়াত গ্রন্থ পবিত্র কোরআনুল করিমের মতন। যখন বিশ্বনবী হেঁটে যেতেন তখন যেন মনে হয়ে আল্-কোরআন হেঁটে যায়। সুবহানাল্লাহ্।

বিশ্বনবীকে (সা.) আল্লাহতায়ালা ৫টি গুণে গুণান্বিত করেছেন, যা সহিহ্ বোখারী শরীফের ৩২৩ নম্বর হাদিসে বর্ণিত আছে। হযরত যাবের ইবনে আব্দুল্লাহ্ থেকে বর্ণিত নবী করীম (সা.) বলেছেন, আমাকে এমন পাঁচটি বিষয় দেয়া হয়েছে যা আমার পূর্বে আর কাকেও দেয়া হয়নি। ১. আমাকে একমাসের রাস্তায় ভীতি দ্বারা সাহায্য করা হয়েছে। ২. আমার জন্য মাটিকে মসজিদ ও পবিত্র বানান হয়েছে। কাজেই আমার উম্মতের কারও যেখানেই নামাযের সময় হয়ে যাবে সেখানেই নামায পড়ে নিবে। ৩. আমার জন্য গণীমতের মাল হালাল করা হয়েছে, যা ইতোপূর্বে কারও জন্য হালাল ছিল না। ৪. আমাকে শাফায়াতের অধিকার দেয়া হয়েছে। ৫. প্রত্যেক নবী প্রেরিত হতেন কেবল তার সম্প্রদায়ের জন্য কিন্তু আমি প্রেরিত হয়েছি সমগ্র মানবজাতির জন্য। এছাড়াও আমার রাসূল (সা.)কে হাওজে কাউছারের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে মহান আল্লাহ্র পক্ষ থেকে। যে হাওজের প্রশস্থতা একমাসের পথসদৃশ। তার পানি দুগ্ধের চেয়ে অধিক সাদা এবং তার ঘ্রাণ কস্তুরীর চেয়েও সুঘ্রাণযুক্ত এবং এর পানপাত্রগুলো আকাশের নক্ষত্রের ন্যায় (অধিক এবং উজ্জ¦ল)। যে একবার তা থেকে পান করবে সে আর কখনো পিপাসার্ত হবে না। (সহিহ্ বোখারী- ৬১২৫)। হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে মাসউদ (রা) থেকে বর্ণিত: নবী করীম (সা.) বলেছেন, আমি হাওজে কাওছারে তোমাদের অগ্রগামী প্রতিনিধি। তোমাদের মধ্যকার কতিপয় লোককে হাজির করা হবে। তারপর তাদেরকে আমার নিকট থেকে টানা-হেচঁড়া করে নিয়ে যাওয়া হবে। আমি বলব, এরা আমার উম্মত। আমাকে বলা হবে, তুমি জান না যে, তোমার অবর্তমানে তারা (ধর্মবিরোধী) কত নুতন কাজ করেছে-সহিহ্ বোখারী- ৬১২২। হযরত সাঈদ ইবনে মুসাইয়্যাব (রা.) কয়েকজন সাহাবী (রা.) হতে বর্ণনা করেছেন: নবী করীম (সা.) বলেছেন, কতিপয় উম্মত হাওজের কাছে আমার নিকট হাজির হবে। আর তাদেরকে হাওজ হতে দূরে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হবে। আমি বলব, হে মাবুদ! এরা তো আমার উম্মত।

আল্লাহ বলবেন, তুমি জান না, তোমার পরে এরা কতোসব নতুন নতুন কথা ও কাজ সৃষ্টি করেছিল আর ইসলাম ত্যাগ করে পূর্বাবস্থায় ফিরে গিয়ে মুরতাদ হয়ে গিয়েছিল-সহিহ্ বোখারী- ৬১৩০। তখন রাসূলুল্লাহ (সা.) তাদেরকে উদ্দেশ্যে করে বলবেন, সুহকন সুহকন লিমান গাইয়্যারা বা’দি। পবিত্র কালামে পাকে আল্লাহতায়ালা স্পষ্টভাবে বলেছেন, ‘আজ আমি তোমাদের জন্যে তোমাদের দ্বীন পরিপূর্ণ করে দিলাম, আর তোমাদের ওপর আমার (প্রতিশ্রুত) নেয়ামতও আমি পুরো করে দিলাম, তোমাদের জন্যে জীবন বিধান হিসাবে আমি ইসলামকেই পছন্দ করলাম’-সূরা আল্-মায়েদা আয়াত-০৩। বিশ্বনবী তাঁর জন্মদিনে রোজা রাখতেন। তিনি সোমবার এ দুনিয়ায় এসেছিলেন। মহান আল্লাহর কাছে শুকরিয়াস্বরুপ এ রোজাটি রাখতেন। বিশ্বনবীকে অনুসরণ করে এদিন তাঁর এ দুনিয়ায় আগমনের শুকরিয়াস্বরুপ রোজা রাখা উত্তম। হে আল্লাহ আমাদের সবাইকে বিশ^নবীর (সা.) আর্দশ ধারণ করে জীবন পরিচালনার তৌফিক দিন। আমিন।

ডা. মোহাম্মদ ওমর ফারুক সভাপতি, রাউজান ক্লাব; জুনিয়র কনসালটেন্ট (ইএনটি), জেনারেল হাসপাতাল, রাঙ্গামাটি।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট