চট্টগ্রাম শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪

মা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ শিক্ষক

অধ্যাপক আয়েশা পারভীন চৌধুরী

১২ মে, ২০১৯ | ১:০৪ পূর্বাহ্ণ

‘‘মাকে মনে পড়ে আমার, মাকে মনে পড়ে’’। মাকে অনেক মনে পড়ে। যতদিন যাচ্ছে ততই মায়ের প্রতি টানটা বেড়ে চলেছে। নিজের জীবনে একজন মায়ের ভূমিকা কতটুকু পালন করতে পারছি সেই চিন্তাটুকুও বার বার মনে করিয়ে দেয়। আমার মা একজন সাধারণ ঘরের মেয়ে। সেই গ্রাম থেকে বাবার হাত ধরে শহরে আসে। চট্টগ্রাম শহরে এসে সংসার শুরু করেন। ছয়জন সন্তানকে একই নিয়মে বড় করে তোলেন। ছয়জনের মধ্যে পাঁচ জনই সর্বোচ্চ ডিগ্রীধারী। সবাই প্রতিষ্ঠিত মায়ের আদর-যতেœ ও বাবার আদর্শে আমরা এখন কর্মক্ষেত্রে যেমন সুপ্রতিষ্ঠিত তেমনি পারিবারিক ও সামাজিকভাবেও সকলের কাছে প্রিয় ব্যক্তিত্বে নিজেদের তৈরী করতে পেরেছি।
আমাদের এগিয়ে যাওয়ার পিছনে মায়ের শিক্ষার বিকল্প নেই। শৈশবের সুশিক্ষায় নিজেদের এভাবে সাজানোর পিছনে আমার অল্প শিক্ষিত মায়ের ভূমিকা উল্লেখযোগ্য। নিজে এত লেখাপড়া না জানলেও এবং আধুনিকতার ছোঁয়ায় নিজের জীবনকে সাজাতে না পারলেও, মা আমাদেরকে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলেন। তাঁর কর্মজীবনের ধারা থেকে বুঝেছি, শুধুমাত্র পুঁথিগত বিদ্যা দিয়ে কখনও সত্যিকারের মানুষ হওয়া যায় না। সত্যিকারের মানুষ হতে পারিবারিক শিক্ষাটাই আসল। ¯েœহময়ী মা ও আদর্শ বাবাই সেই শিক্ষা দিতে পারেন বলে দেশে সুনাগরিক তৈরী হয়।
মা-বাবার মিলিত প্রচেষ্টায় একেক জন রত্ন সন্তানের সৃষ্টি হয়। সেই রত্ন সন্তানরাই কখনো কখনো সু-সন্তানের পরিচয় দিয়ে থাকেন না। বর্তমানে বৃদ্ধাশ্রমগুলোতে দেখা যায়, সে সব হতভাগী- মায়েরা বৃদ্ধাশ্রমে অবস্থান করছেন, তাদের সন্তানরা স্ব স্ব ক্ষেত্রে সু-প্রতিষ্ঠিত। বিভিন্ন উচ্চ পদস্থ কাজে তারা নিয়োজিত হয়ে দেশের উন্নয়ন ধারাকে তরান্তিত করে চলছে। অথচ তার বিশাল ফø্যাট অথবা সখের বাড়িতে মা-বাবার থাকার জায়গা নেই। আমাদের মাঝে অনেক রত্নগর্ভা মা আছে, যারা বৃদ্ধ বয়সে বৃদ্ধাশ্রমে দিন কাটাচ্ছেন। চোখের পানি মুছে মুছে নিজেকে সান্ত¡না দেন- তার আদরের সন্তানটি বউ-বাচ্চা নিয়ে সুখে থাকুক।
একজন মা তার সন্তানের সুখের চিন্তায় নিজের সুখের দিনগুলো কাটায়। মায়ের অক্লান্ত পরিশ্রম ও অব্যক্ত ভালবাসা মাকে পৃথিবীর সর্বোচ্চ স্থানে অধিষ্ঠিত করেছে। যে কোন ধর্মে ও যে কোন বর্ণের মানুষের কাছে ‘‘মা’’ শ্রেষ্ঠ। ইসলাম ধর্মের মতানুযায়ী , ‘‘মায়ের পায়ের নিচে সন্তানের বেহেস্ত ’’। আর অন্য সব ধর্মেও মাকে মর্যাদার দিকে সর্বোচ্চ স্থান দিয়েছেন।
পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ প্রাণী হচ্ছে মানুষ। এই বিবেকবান জাতিকে সকল বিষয়ে শিক্ষা-দীক্ষা, আদব-কায়দা, আচার-আচরণ এবং সকল মানবিক গুণাবলীর শিক্ষা দিয়ে থাকেন একজন মা। মা হচ্ছেন পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ শিক্ষক। মানব ইতিহাসের শুরু থেকেই প্রজন্মের পর প্রজন্মের ধারাবাহিকতায় মায়ের ভূমিকা বিশেষভাবে স্বীকৃত। আর্থিক সমর্থন না হলে একজন মায়ের পক্ষে তার সন্তানকে একা একা বড় করে তোলা অনেক কষ্টকর। কিন্তু একজন মা সেই সকাল থেকে রাত অবধি অক্লান্ত পরিশ্রম করে সংসারকে সাজিয়ে রাখে। নিজের জন্য তেমন কিছু না করেও আপন আনন্দে সন্তানদের আনন্দ দিয়ে যান। তবু মায়ের ভূমিকাকে অনেকে স্বীকৃতি দিতে চায় না। পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের কাছে মায়েদের অর্থনৈতিক ভূমিকার কোন স্বীকৃতি নাই।
নানা জুলুম-নির্যাতন, ও সীমাহীন যন্ত্রণা সয়েও মায়ের মুখে অমলিন হাসি লেগে থাকে। এদের মধ্যে যারা নিরন্তন পরিশ্রম, সাধনা ও ত্যাগ স্বীকার করে সন্তানকে সুশিক্ষিত করে, ন্যায়পরায়ণ, যোগ্য, প্রতিষ্ঠিত সন্তান রূপে গড়ে তুলতে সক্ষম হোন তারা রত্নগর্ভা মা হিসেবে অভিষিক্ত হোন। তবে, অন্য মায়েদের অবদান যে কম তা নয়। তাদের সন্তানরাও দেশকে সমৃদ্ধ, উন্নত ও মর্যাদাশীল জাতি নির্মাণে যথাযথ ভূমিকা রাখতে পারে। কিংবদন্তী রাষ্ট্রনায়ক নেপোলিয়ান বোনার্পাট বলেছিলেন—- “এরাব সব ধহ বফঁপধঃবফ সড়ঃযবৎ ও ংযধষষ মরাব ুড়ঁ ধহ বফঁপধঃবফ হধঃরড়হ”. শিশুর প্রথম শিক্ষক হচ্ছেন মা। সু’সন্তান ও সুনাগরিক প্রতিষ্ঠায় মায়ের ভূমিকার সমান আর কিছুই নেই।
আন্তজার্তিক ভাবে স্বীকৃত দিবসগুলোর মধ্যে ‘‘মা’’ দিবস একটি। ১৯০৮ সালের ১১ মে মার্কিন নারী আন জার্ডিস এর উদ্যোক্ত। এই দিবসের মাধ্যমে মাকে মূল্যায়ন করতে গিয়ে নারীদের প্রতি ইতিবাচক ভূমিকার ব্যাপারটি সর্বাগ্রে বিবেচনায় আনা হয়। কারণ, এই মায়েরা এক একজন নারী। নারীদের অবহেলা ও অবজ্ঞা করে কখনো সুনাগরিক সন্তানের আশা করা যায় না। বাংলাদেশের অনেক গুরুত্বপূর্ণ পদে নারীরা কর্মরত আছেন। নারী উন্নয়নে আন্তজার্তিক স্বীকৃতির মধ্যে এম ডি জি পুরস্কার ২০১০, সাউথ সাউথ এ্যাওয়ার্ড ২০১১, ইউনেস্কোর পিস ট্রি এ্যাওয়ার্ড ২০১৪, জাতিসংঘের চ্যাম্পিয়ন অব দ্যা আর্থ পুরস্কার ২০১৫ ইত্যাদি যে আমাদের প্রধানমন্ত্রী পেয়েছিল তা আমাদের নারী উন্নয়নের বিশ^স¦ীকৃতি স্বরূপ। বাংলাদেশের নিরাপদ মাতৃত্ব কর্মসূচী জাতিসংঘ কর্তৃক প্রশংসিত হয়েছে। তবে, মনে রাখা আবশ্যক, মায়ের সঠিক পরিচর্যা ছাড়া সু’সন্তান লাভ সম্ভব নয়।
প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিঙ্কন মায়ের ভূমিকাকে স্বীকৃতি দিয়ে বলেছিলেন, ‘‘আমি আজ যা হয়েছি কিংবা হতে পারি, তার জন্য পুরোপরি ঋণী আমার সোনামণি মায়ের কাছে’’।
আমাদের মায়েদের সার্থকতা তাদের অতীত স্মৃতিকে আনন্দে ভরিয়ে তোলে। মায়ের ভূমিকায় বিশে^র সকল মায়ের অবদানই অতুলনীয়। মায়ের ঋণ শোধ করবে এমন ধারণা যারা করে তাদেরকে বলছি, মায়ের ঋণ শোধের নয়। সন্তানের অকৃত্রিম সাহচর্য, সেবা ও আজীবন ভালবাসাই মায়ের সারাজীবনের শান্তি।

লেখক ঃ কলামিস্ট ও অধ্যাপক, ইংরেজী বিভাগ
ডাঃ ফজলুল-হাজেরা ডিগ্রী কলেজ, চট্টগ্রাম।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট