চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

চট্টল দরদীর জীবন উদযাপন : মোহাম্মদ ইউসুফ চৌধুরী ১৯২১-২০০৭

প্রফেসর ড. নিজামুদ্দিন আহমেদ

৬ নভেম্বর, ২০১৯ | ২:০৭ পূর্বাহ্ণ

মানুষের অন্তরে সন্নিবেশিত এক জনহিতৈষী, যিনি নিজেকেও ছাপিয়ে গিয়েছিলেন। দশকের পর দশক তিনি ব্যক্তি ও সম্প্রদায়কে বিমোহিত করেছেন।
সমাজের সকল স্তরে সমাদৃত একজন উদ্যোক্তা, বিশিষ্ট ছককাটা কর্মজীবন যাপন করে হয়েছেন তিনি ধন্য। মুদ্রণ শিল্পের প্রতি তাঁর মোহ ম্যাট্রিকুলেশন উত্তর রাউজানের ফকির হাটে ‘ছাত্র বন্ধু লাইব্রেরি’ সূচনার মাধ্যমে প্রকাশ পায়। প্রণেিিদত এবং সঙ্কল্পিত, তাঁর পরবর্তী ব্যবসায়িক উদ্যোগ চট্টগ্রামের জুবিলি রোডস্থ ‘ওরিয়েন্ট স্টোর‘-এ বিক্রি হতো স্টেশনারি, বই এবং সংবাদপত্র। ১৯৪৯ সালে তাঁর পুস্তক বিক্রয়ের অনুকরণীয় দোকান ‘নিউজ ফ্রন্ট’ আলোর মুখ দেখতে শুরু করে। গভীর এক প্রণয় বাস্তবায়িত হচ্ছিল।

নবাবিষ্কৃত ব্যবসায়িক চিন্তা-চেতনা ছিল তার সাফল্যের গতিদায়ক। ১৯৬৪ সালে নিউজ ফ্রন্টকে তিনি চট্টগ্রামে সদ্য নির্মিত বিপণি বিতানে স্থানন্তর করেন। ততদিনে তিনি দেশী-বিদেশী বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা বিক্রয়ের প্রতিনিধিত্ব অর্জন করেন। “দ্য ইলাস্ট্রেটেড উইকলি অব পাকিস্তান“ দিয়ে শুরু করে “নিউজউইক“, “রিডার্স ডাইজেস্ট“, “টাইম“ এবং “দ্য ডেইলি ডন“ বিক্রির স্বত্ত্বও অর্জন করেন। এর পরে আর তাঁকে পিছুপা হতে হয়নি।
নিউজ ফ্রন্ট ক্রমশ বুদ্ধিজীবী এবং প্রগতিশীল সাংস্কৃতি-কর্মীদের মিলনমেলা হয়ে ওঠে। পড়–য়া সবাই যে বই ক্রয় করছিল তা কিন্তু নয়। তেমন আড্ডা থেকে বিবর্তিত ‘লিটল ম্যাগাজিন’ দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে প্রকাশনার তৃষ্ণা মেটাতে ১৯৫৪ সালে সম্পূর্ণ আধুনিক ও স্বয়ংক্রিয় ‘সিগনেট প্রেস লিমিটেড’ প্রতিষ্ঠা করেন। ব্যবসার পাশাপাশি আবেগ নিয়ে চলার কৌশল তিনি জানতেন।
বিচক্ষণ বাণিজ্যিক ব্যাংক কর্তৃক তাঁর ব্যবসায়িক দক্ষতা এবং আর্থিক বিশ্বাসযোগ্যতা স্বীকৃতিসহ হল অভিনন্দিত। আরও বিশাল উদ্যোগ গ্রহণের জন্য কতক ব্যাংক তাঁকে উৎসাহ যোগালো। স্বভাবগতভাবে ধীর এবং স্থিতিশীল, তবে সফল এই ব্যক্তির প্রয়োজন হল দীর্ঘায়িত প্ররোচনা, নিজস্ব সম্ভাব্যতা যাচাই, তারপরই ১৯৮৪ সালে প্রতিষ্ঠিত হল প্যাকেজিং-এর জন্য ‘সিগনেট বক্স ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড’।
একজন স্বপ্নদর্শীকে শ্রদ্ধা করা হয় তাঁর স্পন্দনশীল দর্শনের দীর্ঘস্থায়ী প্রভাবের জন্য। আধুনিকতম সিগনেট প্রেস এক পত্রিকা প্রকাশ করলো যা রাতারাতি গুনাত্বক বিষয়বস্তুতে বন্দর নগরীর বহুকাল আদৃত দৈনিকগুলির সাথে

প্রতিদ্বন্দি¦তায় অবতীর্ণ হতে পেরেছিল। ১৯৮৬ সালে সূচিত হয়ে দৈনিক পূর্বকোণ ক্রমান্বয়ে সংস্কারসাধনের বাহনে
উত্থিত হল। তাঁর প্রতিভাধর বাজারকরণ দক্ষতার মাধ্যমে পত্রিকাটি পুরাতন এবং নতুন পাঠক অর্জন করতে সক্ষম হয়।

এক অগ্রগামী দুগ্ধ কৃষক, তৃণভূমিতে পদচারণা স্থগিত হবার অনেক পরও যিনি সম্মানিত তাঁর সদগুণের কারণে। প্রথম নাতনীর জন্য বিশুদ্ধ দুগ্ধ

নিশ্চিত করতে জাকির হোসেন রোডের নিজ বাড়িতে দুইটি গাভী নিয়ে শুরু করা প্রকল্পে আত্মোৎসর্গ করে বৈজ্ঞানিক কৃষিব্যবসায় পথিকৃত রুপে তাঁর উত্থান। ১৯৯০ সালে নিজস্ব দুগ্ধ খামার, “সুপার ডেইরী ফার্ম এ্যান্ড ফুড প্রোডাকট্স“-এর গোড়াপত্তন করেন, যার ধারণা দ্রুত সমগ্র দেশে ছড়িয়ে পরে। সম্মুখ থেকে নেতৃত্ব দিয়ে, দু’বছর পরে তিনি “চট্টগ্রাম ডেইরি ফার্ম অ্যাসোসিয়েশন“ প্রতিষ্ঠা করেন।
তিনি তার সা¤্রাজ্যের ডানা আরও বিস্তৃত করলেন এই সহস্রাব্দের প্রথম বছরে। তাঁর পরিবার ‘ইউনাইটেড কেমিক্যালস অ্যান্ড ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড’র দায়িত্বভার গ্রহণ করল। তিন জনের মধ্যে কনিষ্ঠ পুত্র চিকিৎসক হওয়ায় সম্ভবত তিনি এদিকটায় ঝোঁকেন।

আত্বকর্মসংস্থানে তাঁর সাফল্যের গাথা উদাহরণ স্বরুপ শিক্ষা মন্ত্রণালয় অধীনস্ত জাতীয় পাঠ্যক্রম এবং পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) উচ্চমাধ্যমিক পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করে।

দ্যুতিমান আলো দ্বারা যাদের জীবন তিনি বদলে দিয়েছেন তাদের মাধ্যমেই এক শিক্ষাব্রতীর জন্ম। নিজ গ্রামে পরিচালিত অনানুষ্ঠানিক শিক্ষার অভিজ্ঞতা, নগরভিত্তিক সাংস্কৃতিক অঙ্গনে প্রকাশনা, গবাদি পালনে সাফল্য, উদ্ভেদী খামারের বাস্তব চাহিদা, এবং আনুষ্ঠানিক শিক্ষা প্রসারে তাঁর আকুলতা সংযুক্ত হয় ১৯৯৫ সালে; স্থাপিত হয় চট্টগ্রাম ভেটারিনারি কলেজ। এক দশকের প্রমাণিত সাফল্য সাত্বেও, ২০০৬ সালে সেই কলেজকে চট্টগ্রাম ভেটারিনারি এ্যন্ড এ্যানিমেল সায়েন্স বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নতি করতে জনপ্রিয় এক আন্দোলনে তাঁর নেতৃত্ব অপরিহার্য হয়ে পরে। দেশব্যাপী শিক্ষাসংক্রান্ত সর্বোচ্চ পর্যায়ে তেমন সমাদৃত বিষয় না হলেও, আন্তর্জাতিক বৈজ্ঞানিক জগতের সাথে বিশ্ববিদ্যালয়টি সম্পর্ক গড়তে সক্ষম হয়েছে।
একজন স্বপ্নদ্রষ্টার সৃজনশীলতা তাঁর অবর্তমানে তাঁর জীয়ন্ত স্বপ্নসমূহ দ্বারা বিবেচিত হয়। জনগণের কল্যাণে যে কোনো বিষয় বাস্তবায়নে, জনমত গঠনে এবং জনপ্রিয় অভিযানের হাল ধরতে তিনি সর্বদা একধাপ এগিয়ে ছিলেন। ‘বৃহত্তর চট্টগ্রাম উন্নয়ন সংগ্রাম কমিটি’র উপযুক্ত চেয়ারম্যান হিসাবে তিনি ছিলেন সর্বদা অগ্রণী। অন্যান্য উদ্যোগের মধ্যে নগরীর যানজট নিরসনে আধুনিক ব্যবস্থা বিকাশের পক্ষে তিনি সহায়ক ভূমিকা পালন করেছিলেন. যথা: কর্ণফুলী সেতু এবং উদ্ভাবনী রিং রোড। নগরীর পানির ঘাটতি, নারকীয় পানি-নিষ্কাশন-ব্যবস্থা, হালদা নদীর বিপন্ন মৎস্য পরিম-ল এবং দূষিত কর্ণফুলী নদী তাঁর হস্তক্ষেপের কারণে সম্ভবত উত্তম সময়ের অপেক্ষায়।

আধুনিক, উদারমনস্ক এক মানুষ, তদুপরি ধর্মপ্রাণ মুসলমান, সাম্প্রদায়িকতাকে পরিহার করে তিনি ছিলেন বিশ্বের মানবিক নাগরিক। ধীরস্থিরীকৃত উচ্চাভিলাষী, মানসিকভাবে বলিষ্ঠ এবং বরকতময় পরিশ্রমী, তিনি ছিলেন স্ব-প্রতিষ্ট এক প্রতিষ্ঠান। যথাযথ রাজনৈতিক সচেতনতা তাঁকে পৌঁছে দিয়েছিল সমাজের চূড়ায়, তবে বিতর্ক তাঁকে কখনো স্পর্শ করেনি। অধ্যবসায়, জীবনযাত্রায় সরলতা, এবং নিরহঙ্কার প্রচার বিমুখতা ছিল তাঁর বৈশিষ্ট্যসূচক গুণ। মিতভাষী মানব, তিনি ধাপে ধাপে জীবনের মই অরোহণ করেছেন, অবিসন্বাদিতভাবে, কারণ তিনি অভীষ্ট লক্ষ্যে ছিলেন অটুট, এবং সমাজের কল্যাণ ছিল তাঁর ক্রিয়া-কেন্দ্র।

প্রায় অর্ধশতাব্দী ধরে বন্দর নগরীর চিন্তাশীল ব্যবসায়ী এবং সমাজ সংস্কারক ছিলেন তিনি, তাই ভক্ত এবং সহকর্মীগণ তাঁকে প্রদান করেন উপাধি চট্টল দরদী। তাঁর জন্মস্থান ঘিরে গ্রামবাসীরা, বৃহত্তর চট্টগ্রাম এলাকার বিভিন্ন ক্ষেত্রের ধন্য সহযোগীরা, এবং তদতিরিক্ত, তাঁকে গুরুগম্ভীরতায় স্মরণ করেন, অধিক ¯েœহশীলতায় এবং প্রশংসায়।

১৯২১ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর রাউজানের ঢেউয়া হাজী বাড়িতে জন্মগ্রহণ করা, মোহাম্মদ ইউসুফ চৌধুরী (চাচা) সুদূর পবিত্র মক্কায় সমাহিত আছেন। সেখানে তিনি বারো বছর আগে (৯ সেপ্টেম্বর, ২০০৭)) ওমরাহ পালনকালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
আঞ্চলিক এই সুবিশাল ব্যক্তিত্বের জন্য একটি উপযুক্ত ‘জাতীয় স্বীকৃতি’ই হবে তাঁর প্রতি যথার্থ শ্রদ্ধাঞ্জলি।

[লেখক: প্রফেসর ড. নিজামুদ্দিন আহমেদ, স্থপতি, কমনওয়েলথ স্কলার ও ফেলো, ব্যাডেন-পাওয়েল ফেলো স্কাউট লিডার এবং মেজর ডোনার রোটারিয়ান]
দি ডেইলি স্টার. বিডি-২৪-১০-১৯

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট