চট্টগ্রাম শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

কুর্দিগ্রামে তুরস্কের সামরিক অভিযান : প্রসঙ্গকথা

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

অধ্যাপক শাব্বির আহমদ

১৯ অক্টোবর, ২০১৯ | ১:১৫ পূর্বাহ্ণ

তাই আশেপাশের রাষ্ট্রেও কুর্দিরা যাতে কোনভাবেই স্বাধীনতার স্বাদ না পায় সে ব্যাপারে সদা সতর্ক। কারণ তাঁর ঢেউ তুর্কির কুর্দি অধ্যুষিত অঞ্চলেও আচড়ে পড়তে পারে এবং এতে করে কৌশলগত প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ ঐ এলাকা হাতছাড়া হওয়ার আশংকা। তাই তুর্কিসীমান্তবর্তী সিরিয়ার কুর্দিদের নিয়ে তুরস্কের এতো ভয়। ইয়েমেনে সৌদি আরবের মতো চোরাবালিতে আটকে পড়ার মতো বিশাল ঝুঁকি মাথায়ও নিয়েও তুরস্কের সিরিয়া অভিযান! অবশ্যই এ ভীতি ইরাক, সিরিয়া ও ইরানেও ক্রিয়াশীল। এককথায়, তাদের কারোই কাম্য নয় ‘স্বাধীন কুর্দিস্তান’। অবশ্য এবারের সিরিয়ার কুর্দি বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে অভিযানের পেছনে তুরস্কের অন্য একটি বিষয়ও কাজ করছে। গৃহযুদ্ধের পর প্রায় ৩৫ লক্ষ সিরিয়ান উদ্বাস্তু তুর্কিতে আশ্রয় নেয়। বিশাল শরণার্থী নিয়ে মহাসঙ্কটে তুর্কি সরকার, যাদের নিয়ে জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক মহলের তেমন কোন উদ্বেগের কথা শোনা যায়না। এমতাবস্থায় প্রেসিডেন্ট এরদোগান তুরস্কে আশ্রিত বিশাল উদ্বাস্তুদের সিরিয়ায় পুনর্বাসনে আন্তর্জাতিক মহলের চাপ, হুমকি ও সমালোচনার তোয়াক্কা না করে চলতি অভিযানটি পরিচালনার কঠিন সিদ্ধান্ত নেন।

ইরাকি কুর্দিদের অবস্থা অন্যদের তুলনায় অনেকটা ভাল। এই ভাল হওয়ার পিছনে তাদেরকে লড়াই-সংগ্রামও করতে হয়েছে সবচাইতে বেশি। ১৯২৩ সালে তারা ইরাকীদের অধীনে যাওয়ার পর থেকেই অধিকার আদায়ে অধিক সোচ্চার ছিল। ১৯৪৬ সালে কুর্দিরা ইরাকের কাছ থেকে স্বায়ত্তশাসন লাভের জন্য মাসুদ বারজানীর নেতৃত্বে কুর্দিস্তান ডেমোক্রেটিক পার্টি (কেডিপি) গড়ে তোলে। তাদের আন্দোলনের মুখেই ইরাকী সরকার কুর্দিদের নাগরিকত্ব দান করতে সম্মত হয়। পরবর্তীতে নানা চড়াই উতরাই পেরিয়ে সাদ্দামের যুগে প্রবেশ করে। সাদ্দামের সাথেও তাদের বিরোধ বাধে। ফলে ইরান-ইরাক যুদ্ধে কুর্দিরা ইরানকে সমর্থন দেয়। ১৯৮৮ সালে সাদ্দাম হোসেন প্রতিশোধপরায়ন হয়ে কুর্দি দমনে উঠেপড়ে লেগে যান। এমনকি তিনি রাসায়নিক বোমার মাধ্যমে ধ্বংস করেন গ্রামের পর গ্রাম। এতে প্রায় ৫০ হাজারের অধিক কুর্দি নিহত হয়। পরবর্তীতে ২০০৩ সালে সাদ্দাম হোসেনকে আটকের জন্য অভিযানে যুক্তরাষ্ট্রকে সহায়তা করেছিলো কয়েকটি কুর্দি সংগঠন। সে ঘটনার পরেই কুর্দিস্তান আঞ্চলিক সরকার গঠিত হয়। সেই সরকার দোহুক, ইরবিল এবং সুলাইমানিয়া প্রদেশে শাসনের অনুমতি পায়। মাসুদ বারজানি সেই অঞ্চলের প্রেসিডেন্ট হিসেবে নিয়োজিত হন এবং জালাল তালেবানী প্রথম ইরাক বহির্ভূত প্রাদেশিক প্রধান বলে নিয়োজিত হন। ১৯৯১ সালে ইরাকী কুর্দিরা তাদের বহুল প্রতীক্ষিত স্বায়ত্তশাসন লাভ করে। এরপরই তারা স্বাধীনতার জন্য নতুন করে সোচ্চার হয়ে উঠে। যার ফলে ২০১৭ সালে কুর্দিস্তানে স্বাধীনতার প্রশ্নে গণভোট হয়। এই গণভোটে ৯২% কুর্দিরা স্বাধীনতার পক্ষে ভোট দেয়, কিন্তু ইরাকী সরকার এই গণভোটকে অবৈধ বলে আখ্যা দেয় এবং আমেরিকা, তুরস্কও গণভোটের বিপক্ষে কথা বলে। ফলে ইরাকী কুর্দিদের স্বাধীনতার প্রশ্ন এবারও আটকে যায়।

২০১১ সালে প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদ’র বিরুদ্ধে গণজাগরণ শুরুর আগ পর্যন্ত কুর্দিরা দামাস্ক, আলেপ্পো, কোবেন,

আফরিন এবং কামিশলি শহরের উত্তর-পূর্ব অংশে বসবাস করত। সিরিয়ান কুর্দিদের বহুকাল ধরে মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করেছে সিরীয় সরকার। ১৯৬০ সাল থেকে এখন পর্যন্ত প্রায় ৩ লাখ কুর্দিকে সে দেশের নাগরিকত্ব দেওয়া হয়নি, তাদের অনেক জমি জোরপূর্বক দখলও করা হয়েছে। গণজাগরণের শুরুতে কুর্দিরা কোন পক্ষের সমর্থন করেনি। ২০১২ সালের মধ্যবর্তী সময়ে কুর্দি অধ্যুষিত এলাকায় আইএস এর উত্থান ঘটলে এবং আসাদবাহিনী পিছু হটলে কুর্দিদলগুলো আমেরিকার সাহায্যে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে আইএসকে হটিয়ে এলাকার নিয়ন্ত্রণ নেয়। ২০১৪ সালে ডমিন্যান্ট ইউনিয়ন পার্টিসহ কয়েকটি কুর্দি দল ঘোষণা দেয়- তারা আফরিন, কোবেন এবং জাজিরায় স্বায়ত্বশাসন চালু করতে চায়। ২০১৬ সালের মার্চে তারা আরো ঘোষণা করে যে, সিরীয় ও তুরস্কের যে অঞ্চলগুলো আইএস-এর হাত থেকে ছিনিয়ে আনা হয়েছে সেখানে নিজেদের সরকার ব্যবস্থা চালু করবে তারা। এই দুটি ঘোষণাই সিরিয়ার সরকার, তুরস্ক এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রত্যাখ্যান করেছিল। সীমান্তবর্তী এলাকায় সিরীয় কুর্দিদের এমন তৎপরতায় বিচলিত তুর্কি সরকারের নির্দেশ পেয়ে কালবিলম্ব না করে শক্তিশালী তুর্কি সেনাবাহিনী সিরিয়ার গভীর অভ্যন্তরে ঢুকে সশস্ত্র কুর্দিদের বিরুদ্ধে অভিযানে নেমে। ঐ সময় আমেরিকার হস্তক্ষেপে কুর্দি মিলিশিয়াদের শেষ রক্ষা হয়।

গত ৯ অক্টোবর থেকে শুরু হওয়া অভিযানের মাধ্যমে তুর্কি সীমান্ত থেকে কুর্দিদের সিরিয়ার আরো গভীরে ঠেলে দিয়ে সেখানে তুরস্কে আশ্রিত সিরিয়ার প্রায় ৩৫ লক্ষ আরব শরণার্থীদের পুনর্বাসনের মাধ্যমে সীমান্তকে কুর্দি মুক্ত করে নিজ দেশে যেকোন প্রকারের বিচ্ছিন্নতাবাদী তৎপরতা রোধের মহাপরিকল্পনা নিয়ে প্রেসিডেন্ট এরদোগান এগুচ্ছেন বলে আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অভিমত। উল্লেখ্য, তুরস্কে আশ্রিত সিরীয় আরব শরণার্থীদের অধিকাংশই সুন্নী। সুন্নীদের প্রতি সংবেদনশীল এরদোগান আশেপাশের শিয়া ও কুর্দিদের উপর মোটেও ভরসা রাখতে পারছেন না। কুর্দিরা সুন্নী হলেও দীর্ঘদিন ধর্মনিরপেক্ষ ও মার্ক্সবাদী ভাবধারার নেতৃত্বে পরিচালিত হওয়ার ফলে ধর্মীয় পরিচয় তাদের কাছে গৌণ। এমতাবস্থায় ৩৫ লক্ষ সুন্নী সিরীয় আরব শরণার্থীদের সীমান্ত এলাকায় সেটেল করতে পারলে তাদের সুরক্ষা দেওয়া যেমন সহজ হবে, তেমনি নিজ দেশের সীমান্তও কন্টক মুক্ত থাকবে।

ইরানের কুর্দিদের অবস্থাও একই। ইরান যেহেতু শিয়া অধ্যুষিত অঞ্চল, তাই সুন্নি কুর্দিরা এখানে উপযুক্ত মর্যাদা পাবে না এটাই স্বাভাবিক হিসেবে ধরতে হবে। বাস্তবতাও তাই। ইরান সর্বদা কুর্দিদের উপর তীক্ষè নজর রাখে। তাদের দাবী দাওয়া কঠোর হাতে দমন করে। ফলে ইরানে কুর্দিরা শোষণ আর বঞ্চনার প্রতীক হয়েই আছে।

কুর্দিদের ভবিষ্যত এত আলোচনার পরেও প্রশ্ন থেকে যায় এই অঞ্চলের কুর্দিদের ভবিষ্যৎ কী? আগামীতে কি ঘটবে তাদের ভাগ্যে? এসব প্রশ্নের আপাতত: কোন উত্তর না মেললেও এতটুকু বলা যায়-কুর্দিদের স্বাধীনতার স্বপ্ন সুদূর পরাহত। দৈবিক কিছু না ঘটলে কুর্দিদের স্বাধীনতা লাভের আশা একেবারে নেই বললেই চলে। একমাত্র আলোচনাই পারবে এই সমস্যার সুষ্ঠু সমাধান এনে দিতে, যেখানে সকল পক্ষই লাভবান হবে এবং স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা না করেও কুর্দিরা তাদের ন্যায্য অধিকার আদায় করতে পারবে। (সমাপ্ত)

অধ্যাপক শাব্বির আহমদ শিক্ষক ও কলামিস্ট

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট