চট্টগ্রাম শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

আবরার ফাহাদ হত্যাকা- অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হোক

ডা. মোহাম্মদ ওমর ফারুক

১৭ অক্টোবর, ২০১৯ | ১২:০৭ পূর্বাহ্ণ

বুয়েট শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদ হত্যাকান্ড নিয়ে চল্ছে সারাদেশে হৈ চৈ। এটি টক অব দ্যা কান্ট্রিতে পরিণত হয়েছে এখন। সারাদেশের শিক্ষার্থীদের মধ্য থেকে বাছাই করা সবচে’ মেধাবী শিক্ষার্থীরাই বুয়েটে পড়ার চান্স পায়-এটা সর্বজনস্বীকৃত। কোন্ পিতা-মাতা না চায় তাঁর ছেলে-সন্তান একটা ভাল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে চান্স পাক। আবরার ফাহাদের পিতা-মাতা সেই সৌভাগ্যবানদেরই একজন। দেশের স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট বিষয়ে একটি স্ট্যাটাসকে কেন্দ্র করে একজন মেধাবী অথচ তরতাজা যুবককে এভাবে পিটিয়ে মারতে হবে, এটা সভ্যসমাজে কোন মতে কাম্য নয়।

যারা আবরারকে পিটিয়ে হত্যা করেছে তারাও মেধাবী শিক্ষার্থীদের কয়েকজন। তারাও সারা দেশের হাজার হাজার মেধাবী শিক্ষার্থীদের মধ্যে বাছাই করা অতি মেধাবী ছাত্র-ছাত্রী। শিক্ষকদের কঠোর অনুশাসন ও অভিভাবকদের কঠোর নজরদারীর মধ্য দিয়ে এ শিক্ষার্থীগুলো ভাল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়ার সুযোগটা পায়। আর এ সুযোগ পেয়ে তারা মহা আনন্দে উচ্চশিক্ষা জীবন শুরু করে। মা-বাবার স্বপ্ন, এ সমস্ত মেধাবীরা বড় প্রকৌশলী হয়ে দেশের মান-সম্মান অক্ষুন্ন রাখবে। কিন্তু বিধিবাম আবরারের মা-বাবাকে খুনিরা সে সুযোগটি দেয়নি। সারাদেশে এ হত্যাকান্ড নিয়ে তোলপাড় চলছে। এ পর্যন্ত ঘটনার সাথে জড়িত থাকার অভিযোগে বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের ১৬ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। শুধু তাই নয়, তাদেরকে ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় কমিটি সংগঠন থেকে আজীবন বহিষ্কার করেছে। গত কয়েকদিন ধরে বুয়েট ক্যাম্পাসে সাধারণ শিক্ষার্থীরা ঘটনার সাথে জড়িত ছাত্রলীগ নেতা- কর্মীদের শাস্তির দাবিতে ও ছাত্র-রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবীতে বিক্ষোভ করছে। এতে সায় দিয়েছে বুয়েট শিক্ষক সমিতি ও বুয়েট এলামনাই এসোসিয়েশন।

ঘটনার সুষ্ট তদন্ত সাপেক্ষে জড়িত দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হোক-এটাই দেশবাসী চায়। যারা এ নির্মম হত্যাকান্ডটি ঘটিয়েছে তাদেরকে কি তাদের পিতা-মাতারা সৎ ও পূর্ণ মানুষ হওয়ার শিক্ষা দেননি? পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ কিতাব মহাগ্রন্থ আল্-কোরআনের বিধান অনুযায়ী জীবন চলার তাগিদ দেননি? এ জীবনের পরে রয়েছে একটি মহাজীবন, মহাকাল-যার কোন অন্ত নেই, সে জীবনে থাকতে হবে চিরকাল। হিসেব-নিকেশ, বিচার-ফয়সালা শেষে দুনিয়ার মানুষকে জান্নাত আর জাহানামে স্থান দেওয়ার নীতিমালা করে দেবেন স্বয়ং রাজাধিরাজ, আকাশ ও জমিনের একচ্ছত্র সিপাহ্শালার মহান রাব্বুল-আলামিন। সেদিন ধর্ম-বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে সবাইকে তাঁর কাছেই হাজির হতে হবে। ‘তারা কি আল্লাহর (দেয়া জীবন) ব্যবস্থার বদলে অন্য কোন বিধানের সন্ধান করছে? অথচ আসমানসমূহ ও জমিনে যা কিছু আছে, তা ইচ্ছায় কিংবা অনিচ্ছায় হোক আল্লাহ্তায়ালার কাছে আত্মসমর্পণ করে আছে এবং প্রত্যেককে তো (একদিন) তাঁর কাছেই ফিরিয়ে নেয়া হবে’- সূরা আল্-ইমরান আয়াত-৮৩। দুনিয়ার জীবনের যে নেক আমল, তার হিসাবের ভিত্তিতেই আখেরাতের স্থায়ী জীবনের জন্য পুরষ্কারের ব্যবস্থা করবেন স্বয়ং আল্লাহ্তায়ালা। এখানে মিলবে না কোন সুপারিশ-সেটাই মহান রাব্বুল আ’লামিন স্পষ্টভাবে আল্-কোরআনে বর্ণনা করেছেন এভাবে, ‘(হে ঈমানদার ব্যক্তিরা) তোমরা সেদিনটিকে ভয় কর, যেদিন একজন আরেকজনের কোন কাজে আসবে না, একজনের কাছ থেকে আরেকজনের (পক্ষে) কোন সুপারিশও গ্রহণ করা হবে না, (মুক্তির জন্যে) কারো কাছ থেকে কোন মুক্তিপণ নেয়া হবে না-না তাদের (সেদিন কোন) সাহায্য করা হবে’-সূরা বাকারা আয়াত- ৪৮। আবরার ফাহাদের ঈমানের জোর ছিল এত বেশি যে, দেশের পক্ষে কথা বলতে গিয়ে সে এতটুকু দ্বিধা করেনি, ভয় পায়নি। সে স্বাধীনতার পক্ষে স্লোগান দিয়েছে, দেশের পক্ষে স্লোগান দিয়েছে, আর যারা তাকে হত্যা করেছে নির্মমভাবে- তারা ইতিহাসের পাতায় সবচেয়ে নিকৃষ্ঠ ও ঘৃণিত নরকীট হিসাবে পরিচিতি পেয়েছে।

হত্যাকারীদের পিতা-মাতারা কি এ জঘন্য হত্যাকান্ডের সংবাদ ও ছবির শিরোনাম গণমাধ্যমের পাতায় দেখছেন না? তাদের বুক কি জ্বলছে না? আবরারের মতন তাঁদের সন্তানদের যদি কেউ নির্মমভাবে হত্যা করে, তাঁদের ভূমিকা কি হবে-এটা এখন তাদের প্রতি দেশবাসীর প্রশ্ন। যদি পরকালের জীবন, আখেরাতের শাস্তি, হত্যাকান্ডের নির্মম শাস্তি কি হতে পারে ইত্যাদি আবরার হত্যাকারীদের পিতা-মাতারা তাদের সন্তানদের ছোটবেলায় কোরআন হাদিসের মাধ্যমে শিক্ষা দিতেন তাহলে হয়তো এ ধরনের জঘন্য অপকর্ম থেকে সরে আসতে বাধ্য হত খুনিরা। আফসোস, পৃথিবীর সবচেয়ে দামী পুস্তক, মহাবিশ্বের মহাবিস্ময় এ কোরআন আজ নিগৃহীত, অবেহেলিত-এ কোরআন থেকে আমরা কোন শিক্ষা নিই না।

কোরআনের প্রেসক্রিপশন মানি না, কোরআনের বিধান মানি না। এজন্যেই সারা বিশ্বে আজ চল্ছে মহা হত্যাযজ্ঞ অথচ ১৫শ’ বছর আগেই আল্লাহ্তায়ালা পবিত্র কোরআনে বলেছেন, ‘যারা আল্লাহর নাযিল করা আইন অনুযায়ী বিচার ফয়সালা করে না, (তারাই হচ্ছে) কাফের’ -সূরা আল্-মায়েদা আয়াত-৪৪। ‘সেখানে আমি তাদের জন্য (এ ফৌজদারী) বিধান নাযিল করেছিলাম যে-প্রত্যেক জানের বদলে জান, চোখের বদলে চোখ, নাকের বদলে নাক, কানের বদলে কান, দাঁতের বদলে দাঁত (শাস্তি প্রয়োগের সময় এ শারীরিক) যখমটাই কিন্তু আসল দন্ড (বলে বিবেচনা করবে); অবশ্য (বাদি পক্ষের) কেউ যদি এ দন্ড মাফ করে দিতে চায়, তাহলে তা তার (নিজের গুনাহখাতার) জন্যে কাফ্ফারা (হিসেবে পরিগণিত) হবে ; আর যারা আল্লাহর নাযিল করা বিধান অনুযায়ী বিচার ফয়সালা করে না, তারাই জালেম।’ সূরা আল্-মায়েদা আয়াত- ৪৫। আল্লাহর নাযিল করা বিধান পবিত্র আল্-কোরআনের ৬,৬৬৬ টি আয়াতের মধ্যে যদি কেউ ১টি আয়াতও অমান্য বা অস্বীকার করে বা কৌশলে গোপন করে বা অযুহাতে প্রচার না করে তাহলে তার মুসলমানিত্ব থাকবে কিনা যথেষ্ট সন্দেহের অবকাশ রয়েছে। সে কথাটিই আল্লাহ্তায়ালা সু-স্পষ্ট ঘোষণা করেছেন এভাবেই, ‘নিসন্দেহে যারা আল্লাহর নাযিল করা কিতাবের অংশ-বিশেষ গোপন করে রাখে এবং সামান্য (বৈষয়িক) মূল্যে তা বিক্রি করে দেয়, তারাই হচ্ছে সে সব লোক যারা আগুন দিয়ে নিজেদের পেট ভর্তি করে, কেয়ামতের দিন আল্লাহ্তায়ালা তাদের সাথে কথা বলবেন না, তিনি তাদের পবিত্র করবেন না, এদের জন্য রয়েছে ভয়াবহ আযাব।’ সূরা বাকারা আয়াত-১৭৪।

বিশ্বনবী হযরত মোহাম্মদ (সা.) এর প্রাণপ্রিয় কন্যা হযরত ফাতেমা (রা.) এর ওফাতের পর যখন তার মরদেহ কবরের দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল তখন প্রসিদ্ধ সাহাবি হযরত আবু যর গিফারী কবরকে উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন, ‘হে কবর, তোমার মাঝে আজ বিশ্ব জাহানের মহীয়সী নারী, নবীজির প্রাণের ধন, হযরত আলীর সহধর্মিনী ফাতেমাকে রাখা হচ্ছে, বেয়াদবী করিস্ না। এভাবে তিন তিনবার বলার পর কবর থেকে আওয়াজ উঠল, ‘আমি ফাতেমা বুঝিনা, নবীজির কন্যা বুঝি না-আমি বুঝি কবরবাসীর নেক আমল।’ যেখানে আমার নবীজির প্রাণপ্রিয় কন্যার এ অবস্থা সেখানে আমাদের মতন নরাধমদের কি অবস্থা হবে, তা সহজেই অনুমেয়। নবীজির বিবি হযরত হযরত খাদিজাতুল কোবরাকে কবরে শায়িত করার পর কবরের পাড় থেকে বিশ্বনবী আসতে চাচ্ছিলেন না, মুসলিম জাহানের প্রথম খলিফা হযরত আবু বক্কর সিদ্দিক (র) রাসূল (সা.) কে উদ্দেশ্যে করে বলেছেন, ‘হে রাসূল (সা.) অনেক তো হল, এবার চলেন যাই, রাসূল (সা.) বললেন, না আবু বক্কর তুমি চলে গেলে যেত পার-আমি যাব না।’ খাদিজা যদি ফেরেশতাদের তিনটি প্রশ্নের উত্তর না দিতে পারে তা আমি জবাব দিয়ে তারপরে যাব। সাথে সাথে মহান রাব্বুল আ’লামিন হযরত জিব্রিল আমিন এর মাধ্যমে রাসূল (সা.) এর কাছে সংবাদ পাঠালেন, হে আল্লাহর প্রিয় হাবিব আপনি চলে যান, খাদিজা যদি কবরের ফেরেশতাদের প্রশ্নের উত্তর দিতে না পারেন তবে মহান আল্লাহ্তায়ালা আরশে আজিমের উপর থেকে জবাব দিয়ে দেবেন। রাসূলের প্রাণপ্রিয় স্ত্রী খাদিজাকে নিয়ে আল্লাহর রাসূল (সা.) এর যে উৎক›ঠা, তাতে আমাদের জন্য রয়েছে অনুকরণীয় শিক্ষা।

এ দুনিয়ায় যারা অপকর্ম করে, বিনা অপরাধে মানুষ হত্যা করে, বিপর্যয় সৃষ্টি করে তাদের জন্য রয়েছে সু-নির্দিষ্ট সংবাদ। আবরার ফাহাদ আজ নেই। রয়ে গেছে তার অনুপম আদর্শ, ঈমানী চেতনায় উজ্জীবিত তার শ্রেষ্ঠ কথামালা। আবরার হতে পারে দেশপ্রেমিক ছাত্র যুবাদের অনুকরণীয় আদর্শ, আমরা হারাতে চাই না আর কোন আবরার। এখন থেকেই আমরা ছুটে চলব সেই মহাগ্রন্থ আল্ কোরআনের দিকে, যার শিক্ষা গ্রহণ করলে আমাদের জীবন হবে আলোকিত, মুক্তি পাবো আখেরাতের কঠোর শাস্তি থেকে। সম্মানিত পিতা-মাতাদের উদ্দেশ্যে আমি বলব-এখন থেকেই আপনার সন্তানদের লাগাম টেনে ধরুন, প্রযুক্তির ছোঁয়ায় ভেসে যাওয়া যুবকদের হাতে তুলে দিন অর্থসহ কোরআনের একটি খন্ড-যেখান থেকে তারা পাবে শান্তির পরশ, বেহেশ্তি জীবনের অমোগ আকর্ষণ আর এতেই তাদের জীবন পাল্টে যাবে নিমিষেই। হৃদয়ে হৃদয়ে অনুরণন হবে উর্মিমালা। আসুন, ‘সেই দিনটিকেই ভয় করি, যেদিন তোমাদের সবাইকে আল্লাহর দিকে ফিরিয়ে নেয়া হবে, অতপর সেদিন প্রত্যেকটি মানুষকে (তার) কামাইর ফলাফল দেয়া হবে, তাদের উপর কোন ধরনের জুলুম করা হবে না- সূরা বাকারা আয়াত-২৮১।’

ডা. মোহাম্মদ ওমর ফারুক সভাপতি, রাউজান ক্লাব; জুনিয়র কনসালটেন্ট (ইএনটি), জেনারেল হাসপাতাল, রাঙ্গামাটি।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট